× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ধ্বংসস্তূপ ঘিরেই চলে জীবন-জীবিকা

রাসেল মাহমুদ

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৫ ১২:৪৩ পিএম

ধ্বংসস্তূপ ঘিরেই চলে জীবন-জীবিকা

গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের প্রধান বাহন হচ্ছে ট্রলার। তাই সাগরে যাত্রার মহাকর্মযজ্ঞে প্রধান বাহনটি সুসজ্জিত করার জন্য সবাই আসেন ডক ইয়ার্ডে। ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ- এই তিন মাসে ডক ইয়ার্ডে থাকে প্রাণচাঞ্চল্য। ট্রলার ও নৌকা নির্মাণ শ্রমিকরা কেউ ট্রলারের গুঁড়া লাগাচ্ছেন, কেউ কাঠ মসৃণ করছেন, কেউ তক্তা জোড়া লাগানোর কাজ করছেন। মিস্ত্রিদের হাতুড়-বাটালের আওয়াজে মুখরিত হচ্ছে এসব জেলেপল্লী।

নতুন ট্রলার তৈরির কাজ চলছে এবং পুরাতন ট্রলার মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে। এসব ট্রলার মেরামতের কাজে নিয়োজিত রয়েছে বরগুনার প্রায় তিন শতাধিক কাঠমিস্ত্রি।

বর্ষার আগমনে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে বড় প্রস্তুতি নিচ্ছে বরগুনা জেলার মৎস্যজীবীরা। এতে নতুন ট্রলার তৈরি ও পুরাতন ট্রলার মেরামত করে ব্যস্ত সময় পার করছেন কাঠমিস্ত্রিরা। নৌকা তৈরিতে সময় কম লাগলেও একটি নতুন ট্রলার তৈরি করতে দুই মাসের মতো সময় লাগে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ আর ব্যস্ততা জেলেপল্লীতে। এতে উচ্ছ্বসিত জেলেপল্লীর নৌকা ও ট্রলার শ্রমিকের পাশাপাশি মৎস্যজীবীরা।

আগুনে পুড়ে যেমন খাঁটি সোনা তৈরি হয় তেমনি ট্রলার আগুনে পুড়ে আলকাতরা দেওয়া হয়। সবশেষে সুসজ্জিত করে প্রস্তুত করা হয় জেলেদের মাছ শিকার করার যানবাহন।

উত্তপ্ত গরমে আলকাতরা যেমন গলে যায়, তেমনই ট্রলার কারিগরের শরীরজুড়ে ঘাম বের হয়। এত উত্তপ্ত গরমে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চলে জীবনসংগ্রাম। জীবনযুদ্ধে হার না মেনে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় ধ্বংসস্তূপে।

ডর্ক ইয়ার্ড মিস্ত্রি মো. বাচ্চু বলেন, ‘মোর জীবনের ৩০ বছর পার করে দিছি ভাঙাগড়ার খেলায়। যখন পুরানো ট্রলারে কাজ করি মনে হয় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আছি। সেই ধ্বংসস্তূপকে নতুন রূপ দেওয়া মোগো কাজ। প্রচণ্ড গরমে যখন আলকাতরার কাজ করি তখন মনে হয় মরুর দেশে আছি। গরমে কলিজা সিদ্ধ হয়ে যায়Ñ এভাবেই মোগো জীবন চলে।’

পানিতে চলাচলের জন্য যেকোনো ধরনের যান তৈরি বা মেরামতের জন্য প্রস্তুত করা হয় বা যেখানে নৌযান নির্মাণ, মেরামত বা আধুনিকায়ন ইত্যাদি কাজ করা হয় সেটাকে ডর্ক ইয়ার্ড বলে।

বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালীর ডক ইয়ার্ডে চলছে ফিশিং বোট তৈরি ও মেরামতের কাজ। উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিভিন্ন উপজেলায় এ-রকম ১৫টি ডক ইয়ার্ড রয়েছে।

ট্রলার-নৌকার আকার ও প্রকারেভেদে মজুরি দেওয়া হয় শ্রমিকদের। একটি ট্রলার তৈরি করতে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার বেশি মজুরি আসে। ট্রলার মালিকদের কাছ থেকে কাঠমিস্ত্রির বেতন দৈনিক জনপ্রতি ১৩০০ টাকা ও সহকারীদের ১০০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

২৫ বছরের অভিজ্ঞ কাঠমিস্ত্রি নিজাম বলেন, জীবনের অর্ধেক সময় এই ডকে পার করছি, শরীর পাথর হয়ে গেছে। গরম শরীরে লাগে না, বাড়িতে বসে থাকলে তখন গরম বেশি লাগে। ৩ মাস কাজ বেশি থাকে বাকি মাসগুলোতে কাজ কম থাকে। প্রতিদিন ১২/১৩ শত করে হাজিরা পাই। জীবন কোনো রকম চলে যায়।

বড় নতুন ট্রলার ৩৪ ফুট লম্বা, ১৫ ফুট চওড়া। ট্রলার তৈরি করতে প্রয়োজন প্রায় ৫০০ সেফটি মেহগনি ও রেইন্ট্রি কাঠ। প্রায় ১৫০ কেজি আলকাতরা। ট্রলারে ৪০ গড়া একটি চায়না ইঞ্জিন ও একটি ২৬ গিয়ার সংযুক্ত করতে হয়। ছোট আকৃতির একটি ট্রলার তৈরিতে প্রায় ১২ লাখ ও বড় আকৃতির সমুদ্রগামী একটি ট্রলার তৈরিতে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছরে ইলিশে না থাকায় এ বছর তুলনামূলক নতুন ট্রলার তৈরি কম হচ্ছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মিস্ত্রি ও হেলপার এনে ট্রলার তৈরি করেছেন ট্রলার মালিকরা।

আব্দুল মন্নান মাঝির নতুন একটি ট্রলার তৈরির কাজে নিয়োজিত কাঠমিস্ত্রি বলেন, জেলায় প্রায় ১ শতাধিক ট্রলার নির্মাণের কাঠমিস্ত্রি রয়েছেন। পাশপাশি তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক সহকারী। ট্রলার-নৌকার প্রকারভেদে তার অনেক মেরামতের কাজ বা নতুন নির্মাণ করা বেশিরভাগই মালিক পক্ষের সঙ্গে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন তারা।

সামনের মৌসুমে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য এখানকার মৎস্যজীবীরা সাগর যাত্রার মহাকর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৎস্য আড়ত মালিকদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ নতুন ট্রলার বানাচ্ছেন কেউ-বা পুরোনো ট্রলার মেরামত করছেন। জেলেদের মনে বড় আশা- সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি আড়তদারের দাদন পরিশোধ করে থাকেন।

তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি প্রস্থের লম্বা লম্বা কাঠের জোড়ায় জোড়ায় সুতার সলতে ঢোকানোর কাজকে বলা হয় গাইনি। এক ধরনের চিকন লোহা আর হাতুড়ি দিয়ে এ কাজ করা হয় অতি সূক্ষ্মভাবে। গাইনির কাজ শেষে চলে পুটিংয়ের কাজ। কেরোসিন, ধূপ আর পানির সংমিশ্রণে আঠালো এক ধরনের তরল পদার্থ ওইসব সলতের ওপর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যাকে বলা হয় পুটিং। এ কাজটিও চলে বেশ কয়েকদিন ধরে। এরপর চলে মারামত (মেরামত নয়)। পুরো ট্রলারটির নিচের অংশে আলকাতরা লাগানো হয়।

জেলেরা ট্রলারে চড়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। বৈরী আবহাওয়ায় ঝড়-তুফানের মধ্যেও দিনের পর দিন টিকে থাকে যে ট্রলার সেই ডক ইয়ার্ডের মিস্ত্রি আর শ্রমিকের শ্রমের প্রতীক।

ডক ইয়ার্ডের কারিগর-শ্রমিকরা বলেন, সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ডক ইয়ার্ডে মাছ ধরার ট্রলারের মেরামতের জন্য এখন ভিড়Ñ এ কারণে বেড়েছে কাজ। তারা আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালীন ট্রলারগুলো ঘাটে আসে। তাই এই সুযোগে মালিকপক্ষ ট্রলার মেরামত করে নেয়। মালামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌযান মেরামতের খরচও বেড়েছে। প্রতিটি নৌযান মেরামত করতে আকারভেদে ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

ট্রলার মালিক মুসফিকুর রহমান বলেন, প্রতিবছর কমপক্ষে দুবার ট্রলার মেরামত করাতে হয়। এতে খরচ হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। মূলত, লবণপানিতে ট্রলারের কাঠ বেশি নষ্ট হয়, তাই মেরামত করা হয়। মেরামত না করালে লোনায় সব নষ্ট হয়ে যায়। 

বরগুনা জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন বলেন, সাগরযাত্রার মহাকর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে। এতে কেউ নতুন এবং কেউ পুরাতন ট্রলার মেরামত করছেন। এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কাঠমিস্ত্রিরা। ট্রলার মেরামতের জন্য এবং কাঠমিস্ত্রিদের কাজের সুবিধার্থে এ জেলায় সরকারিভাবে কোনো ডক ইয়ার্ড দেওয়া যায় কি না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা