শেখ সোহেল
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:০৮ পিএম
পঞ্চাশোর্ধ্ব জরিনা বেগম, বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুরের রহিমাবাদ গ্রামে এক চিলতে ঘরে বাস তার। ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম জীবনসঙ্গী। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা, মাঠে কাজ করা, বাধার মধ্যে পড়তে না পারা, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, স্বামীর নির্যাতনসহ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে হাল ছাড়েননি কখনও।
কিছুদিন আগে এ প্রতিবেদকের কথা হয় জরিনা বেগমের সঙ্গে। জরিনা বেগমের জন্ম বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার পাটরপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে। তার বাবার নাম শাহেন তালুকদার ও মা আছিয়া বেগম। ১২ ভাইবোনের সংসারে অভাবই ছিল নিত্যসঙ্গী। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যেত, তখন তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করতেন। অন্যের জমিতে ধান কুড়ানো, নদীতে মাছ ধরা, মাঠের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করা এসবই ছিল তার দৈনন্দিন কাজ।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় ছোটন শেখের সঙ্গে। তিনি পেশায় মাহিন্দ্রাচালক। কিন্তু বিয়েতেও সুখের দেখা পাননি জরিনা। বিয়ের কয়েক মাস পরই স্বামীর আসল চেহারা প্রকাশ পায়। তিনি ছিলেন মাদকাসক্ত। দিনরাত অত্যাচার করতেন, এমনকি গাছের সঙ্গে বেঁধেও নির্যাতন চালাতেন। শিশু সন্তানদের সামনে অসহ্য নির্যাতন সহ্য করেও জরিনা সংসার ছাড়েননি, বাবার বাড়িতেও ফিরে যাননি। তিন সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিন্তু একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে চলে যান ঢাকায়। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ নেন। সন্তানরা ছোট থাকায় তাদের বাসায় আটকে রেখে কাজে যেতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে যান। বড় মেয়ে একটু বড় হলে সেও কাজে যোগ দেয়। সুন্দরভাবে জীবন চলতে থাকে। কিছু টাকাও জমা রাখেন। কয়েক বছর পর স্বামী অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসেন জরিনার কাছে। অতীতের সব ভুল ভুলে তিনি তাকে গ্রহণ করেন এবং সন্তানদের নিয়ে গ্রামে ফেরেন। কিন্তু ফিরে আসার কিছুদিন পরই স্বামীর ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসার জন্য তার কাছে যা জমানো টাকা ছিল সবই খরচ করেন, সন্তানদের ঢাকায় পাঠিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। যখনই সুখের দেখা পাবেন তখন দুঃখের ছোঁয়া এসে পড়ে। ২০২২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসার চালানো নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েন জরিনা বেগম। কিন্তু তখনও তিনি মনোবল হারাননি। তার ছোটবেলা থেকেই জেদ ছিল সবাই যা পারে আমি কেন পারব না। এরপর মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে চলে সংসার। মানুষের বাড়িঘরে, মাঠে, রাস্তায় কাজ করে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফের শুরু হয় তার বেঁচে থাকার লড়াই। এমন কঠিন সময়ে বছর দুয়েক আগে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে গরু কিনে দেয় তাকে। সেই শুরু তার নতুন স্বপ্নের পথচলা। শুরু করেন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন ও বিভিন্ন সবজি চাষ। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তার জীবনযুদ্ধের চাকা। করেছেন ভাগ্য পরিবর্তন। কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজের ভাগ্য বদলেছেন তিনি।
জরিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী যখন মারা যায় তখন আমার মনে হলো আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ল। আসলে আমার স্বামী আমাকে নির্যাতন করত তার পরও সে আমার স্বামী। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, ওপরওয়ালার কাছে দোয়া করি যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। আমার আর আমার মেয়ের জমানো কিছু টাকা সব আমার স্বামীর চিকিৎসা বাবদ খরচ করি। স্বামী মারা যাওয়ার পর খুব অভাব-অনটন ছিল সংসারে। কীভাবে সংসার চালাব ও ছেলেমেয়েদের মানুষ করব এ নিয়ে খুব চিন্তা হতো। কী করব, না করব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। সে সময় পাশে এসে কেউ দাঁড়ায় নাই। কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেয় নাই আমাকে। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে এবং কারও কাছে যেন সাহায্যের হাত পাততে না হয়, সেজন্য পরিশ্রম করে এখন এ পর্যায়ে এসেছি।’
একটা সময় যিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন, আজ তিনি গবাদি পশুর খামার করে স্বাবলম্বী। শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের ভবিষ্যৎও গড়ে তুলেছেন নতুনভাবে। তার এ সাফল্য দেখে স্থানীয়রাও এখন খুশি।
জরিনা বেগমের মেয়ে সুলতানা বলেন, ‘আমার মায়ের মতো এমন অসহায় মা আমি দেখি নাই। আমার বাবা আমার মাকে অনেক নির্যাতন করত গাছের সঙ্গে বেঁধেও পিটিয়েছে, তার পরও মা আমাদের ছেড়ে যায়নি। আসলে মা এমনই হয়।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. দেলোয়ার বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করেছেন জরিনা। মাঠে-ঘাটে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু পালন করছেন। আমরা তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হই।’
ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের সংগঠক পূর্ণিমা পাল বলেন, ‘আমি এ দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পেরে খুশি। আমাদের প্রতিটা মানুষের উচিত জরিনা বেগমের মতো ভেঙে না পড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া।’
যাত্রাপুর শাখার ব্র্যাক আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের এ শাখায় ১৯০ জন এই জরিনা বেগমের মতো পরিবার রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য গবাদি পশু পালনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, গোয়ালঘর করার জন্য টিন, ষাঁড় গরু, গরুর কৃমিনাশক, রুচিবর্ধক, ভিটামিন ডিবি পাউডার, ডিসিবি পাউডার ও ৫টি মারাত্মক রোগের ভ্যাকসিন; ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক ২ হাজার টাকার খাদ্যসহায়তা, ঘর মেরামতের জন্য ৬ হাজার টাকার টিন, ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশনের জন্য গোয়ালঘরের মেঝে পাকা করতে, বালু-খোয়া ও সিমেন্ট, লবণাক্ত জায়গায় সবজি চাষের জন্য বস্তা, সবজির চারা, নেট, গোখাদ্যের জন্য ৪০০ টাকা, ঘাস চাষের জন্য ঘাসের বীজসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয়।’
বাগেরহাট শাখা ব্র্যাকের রিজিওনাল ম্যানেজার মারুফা খাতুন বলেন, ‘বর্তমানে বাগেরহাটের নয়টি উপজেলায় আমরা কাজ করছি। এখানে ১ হাজার ৯০৪ জন হতদরিদ্র পরিবার নিয়ে কাজ করছি। এদের আমরা গবাদি প্রাণী পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসায় এবং কৃষি ইন্টারপ্রাইজের ওপর সাপোর্ট প্রদান করি। এদের মধ্যে আমরা যে সাপোর্ট দিই তার অর্ধেক আমরা রিটার্ন নিই আর অর্ধেক তাদের প্রদান করে থাকি।’