অরণ্য ইমতিয়াজ
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:০৬ পিএম
হাট শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে মাছ, শাকসবজি, তরিতরকারির দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। কেউ মাছ কিনছে, কেউ সবজি। কিন্তু করটিয়া হাট সে রকম নয়। তবে কিছু অংশের আগের দৃশ্যপট খুঁজে পাওয়া গেলেও করটিয়া হাট বিখ্যাত অন্য কারণে। একটু পরে আসছি সে কথায়। আমরা সাধারণত হাটের সঠিক অর্থ ঘেঁটে দেখি না। হাট মানে সাধারণের কেনাবেচার স্থান, প্রচুর আমদানি, সমাবেশ। করটিয়া হাটের বৈশিষ্ট্য এদিক দিয়ে শতভাগ যথার্থ। এ হাট সাধারণের কেনাবেচার স্থান, প্রচুর আমদানি হয়, বহু মানুষের সমাবেশও হয়ে থাকে।
এখন আসি আসল কথায়। করটিয়া হাট কেন বিখ্যাত? এ হাটে বিভিন্ন রকমের জিনিস পাওয়া গেলেও এটি মূলত শাড়ির জন্যই বিখ্যাত। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের শাড়ি মানে তাঁতের শাড়ির জন্য করটিয়া হাটের পরিচিতি টাঙ্গাইল ছাড়িয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বাইরেও এর পরিচিতি রয়েছে।
করটিয়া নামকরণের ইতিহাস
করটিয়া হাটের ইতিহাস জানার আগে জানা দরকার করটিয়া নামের ইতিহাস। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন করটিয়া। করটিয়ার লোকজন তাদের জমিদার পন্নী পরিবারকে ‘কর’ প্রদান করত। আর ‘কর দেয়দের’ বাসভূমিকে মূলত তখন করটিয়া বলা হতো। সেই থেকে এখানকার নাম হয় করটিয়া। আবার অন্য ব্যাখ্যাও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, একসময় এখানকার জমিদারবাড়িতে প্রচুর টিয়াপাখি থাকত। স্থানীয়রা জমিদারদের যে কর দিত তার অনেকটা অর্থ টিয়ার খাবারের জন্য ব্যয় করা হতো। সেই ‘কর’ শব্দের সঙ্গে ‘টিয়া’ যুক্ত হয়ে পরে এলাকার নামকরণ হয় করটিয়া।
হাটের ইতিহাস
করটিয়া হাটের বিস্তারিত কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ইতিহাস পাওয়া গেলেও সেখানে কিছু বিভ্রান্তিও দেখা যায়। সব জায়গায় বলা হয়েছে হাটের বয়স প্রায় ২০০ বছর। আর হাটের প্রতিষ্ঠাতা করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। কিন্তু ওয়াজেদ আলী খান জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭১ সালের ১৪ নভেম্বর। সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স ১৫৪ বছর। সুতরাং তার জন্মের আগে অর্থাৎ ২০০ বছর আগে তিনি কীভাবে হাট প্রতিষ্ঠা করেন! তবে হাটের বয়স অন্তত ২০০ বছর, এ তথ্য সঠিক। তাহলে প্রতিষ্ঠাতা কে? এ নিয়ে ইতিহাস পর্যালোচনা করে করটিয়া হাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী ও করটিয়া হাট পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে খুঁজে পাওয়া যায় হাটের প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ জমিদারি প্রথমে পাঁচসাল বন্দোবস্ত দেওয়ার আগে সৈয়দ খাঁ থেকে অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ খোদানেওয়াজ খাঁ আটয়া পরগনার খাজনা ভোগ করতেন। এরপর আটিয়ার মূল জমিদারি বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জমিদারের অংশভুক্ত হয়ে যায়।
জমিদারদের পরবর্তী বংশধর সা’দত আলী খান পন্নী বেশ দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। প্রজাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তিনিই করটিয়ায় হাটের গোড়াপত্তন করেন। তখন ৩ একর জায়গায় হাটের কার্যক্রম শুরু হয়। তবে প্রথম অবস্থায় এত পরিচিতি পায়নি হাটটি। অন্যান্য হাটের মতোই সপ্তাহে এক দিন (বৃহস্পতিবার) বসে হাট। বিভিন্ন শাকসবজি, গবাদি পশু, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং স্বল্পপরিসরে কাপড়ের দোকান গড়ে ওঠে। বিশেষ করে পাবনার মোটা শাড়ি এবং টাঙ্গাইলের বিভিন্ন তাঁতসমৃদ্ধ এলাকার কিছু তাঁতি কাপড় নিয়ে বিক্রি শুরু করেন। তখনও সাপ্তাহিক হাট হিসেবেই চলতে থাকে করটিয়ার হাট।
এদিকে সা’দত আলী খাঁর নাতি ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া জমিদারি গ্রহণ করার পর তিনি হাটের উন্নয়নে আরও জায়গা দান করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ একর জায়গায় খোলা আকাশের নিচে হাট চলতে থাকে। আস্তে আস্তে হাটের পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাড়তে থাকে লোকসমাগম। কেউ কেউ ভিটির ওপর টিনের ছাউনি দিতে থাকেন। পরে টিনের ঘর তোলেন কেউ কেউ।
ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ছিলেন করটিয়ার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাহিতৈষী। তিনি ১৯২১ সালে ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সভাপতি, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সহসভাপতি এবং নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আজাদি আন্দোলন করে কারাবরণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ়তার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তার তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে, One who dified the british.
তার দানশীলতা, অবদান ও উদারতার কারণে একসময় এলাকার মানুষ তাকে আটিয়ার চাঁদ বলে অভিহিত করেন। তিনি প্রজাদের কাছে হয়ে ওঠেন ‘চাঁদ মিয়া’। আর এজন্য অনেকে মনে করেন করটিয়া হাটও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি হাট প্রতিষ্ঠা করেননি। করেছেন তার দাদা সা’দত আলী খাঁ। তবে ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর আমলে তার বদান্যতায় হাটের প্রসার ও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে।
কীভাবে করটিয়া হাট শাড়ির জন্য খ্যাত হয়
স্বাধীনতা-পূর্ববতী সময়েও করটিয়া হাট স্বাভাবিক হাটের মতোই চলতে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর করটিয়া হাটে তাঁতিদের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়তে থাকে। তখনও তারা ভিটি ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করে তাঁত শাড়ি বিক্রি করতে থাকেন।
করটিয়া শাড়ির হাটের আগে আরেকটি হাটের ইতিহাস জানা দরকার। বসাক সম্মিলনী লিমিটেডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ ব্যবসায়ী কার্তিক চন্দ্র বসাক জানান সে ইতিহাস। টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা বংশপরম্পরায় নিখুঁত ডিজাইনের তাঁতের শাড়ি তৈরি করেন। সদর উপজেলার বাজিতপুর, সুরুজ, ঘারিন্দা, তারটিয়া; দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চণ্ডী, মঙ্গলহোড়, নলশোধা; কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতিরা নিখুঁত ডিজাইনে শাড়ি তৈরি করতেন। প্রথম দিকে তারা তাদের উৎপাদিত শাড়ি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন গ্রামগঞ্জে ও শহরের বিভিন্ন শাড়ির দোকানে। ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলের তাঁতিরা সদর উপজেলার পুটিয়াজানি এলাকার ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় তাঁতের শাড়ি বিক্রি শুরু করেন। ভালোই চলছিল তাদের বিকিকিনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শাড়ি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে থাকেন। সে সময় তাঁতের শাড়ির পরিচিতি জেলার সীমানা ছাড়িয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁতিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে থাকেন। সেই সঙ্গে অনেক তাঁতির কাছ থেকে জোর করে শাড়িও ছিনিয়ে নেওয়া হতো। এ নিয়ে তাঁতিরা প্রতিবাদ করলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাঁধে। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান না হওয়ায় পরে আদি টাঙ্গাইল এলাকার তাঁতিরা পুটিয়াজানি বাজারে শাড়ি বিক্রি বন্ধ করে দেন। তারা পুটিয়াজানি থেকে সরে গিয়ে আদি টাঙ্গাইল এলাকার মাঝখানে খোলা জায়গায় অস্থায়ীভাবে হাট বসিয়ে শাড়ি বিক্রি শুরু করেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর ১৯৪৫ সালে এ এলাকার বসাক সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী তাঁত ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে আদি টাঙ্গাইল এলাকার বাজিতপুরে শাড়ির হাট বসানো হয়। প্রায় ২২ গ্রামের মানুষ এ হাটে সহায়তা করেন। প্রায় ৭৫ শতাংশ জায়গাজুড়ে এ হাট বসে।
আবদুল গফুর করটিয়া হাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা মঙ্গলহোড় গ্রামে। তার কাছ থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় সা’দত কলেজের প্রফেসর আবদুল মজিদ করটিয়া হাটের উত্তরপাশের রাস্তা ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিম দিকের মাঝামাঝি জায়গায় একটি বিল্ডিং নির্মাণ করেন। তিনি পাথরাইল, মঙ্গলহোড়সহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতিদের ডেকে এক সভা করেন। তিনি তাঁতিদের করটিয়ায় তার বিল্ডিংয়ে শাড়ি বিক্রি করার জন্য ব্যবস্থা করে দেন। তাঁতিরাও রাজি হয়ে যান। এ খবর আস্তে আস্তে টাঙ্গাইলের অন্য তাঁতিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারা মহাজনদের বলেন। সব তাঁতি, মহাজন আসতে থাকেন এখানে। আবদুল মজিদ তাঁতিদের জন্য ভিটির ব্যবস্থা করে তা হস্তান্তর করেন। শুরু হয়ে যায় করটিয়ায় শাড়ির ব্যাপক বিক্রি। আস্তে আস্তে অন্যরাও বিল্ডিং নির্মাণ করে শাড়ি বিক্রির জন্য ভাড়া দেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এমনকি পাশের দেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও পাইকাররা আসতে থাকেন, কিনে নিয়ে যান শাড়ি। এভাবে একদিন করটিয়া হাট শাড়ির হাট হিসেবেই বিখ্যাত হয়ে যায়।
প্রথম অবস্থায় প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার হাট বসলেও মানুষের সমাগম বেড়ে যাওয়ায় পাইকারদের জন্য মঙ্গল ও বুধবার শাড়ি বিক্রির জন্য এবং বৃহস্পতিবার স্বাভাবিক হাট হিসেবে করটিয়া হাটের কার্যক্রম চলতে থাকে।
করটিয়া হাটে বর্তমানে ৫ হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত অর্ধেক দোকানে শাড়ি বিক্রি করা হয়। প্রতি হাটে প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো শাড়ি বিক্রি হয় বলে জানান করটিয়া হাট পরিচালনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হেলালুল ইসলাম হেলাল। তিনিও করটিয়া হাট সম্পর্কে আবদুল গফুরের উল্লেখ করা করটিয়া হাটে শাড়ি বিক্রির ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।