বাংলাদেশের বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
মেরিলিন ফারজানা আহমেদ
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১২:৪২ পিএম
আজকালকার এই দ্রুত চলমান সময়ে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ যেন এক অভিন্ন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, গৃহিণী কিংবা বয়স্ক সবার জীবনেই কোনো না কোনোভাবে এ মানসিক চাপ জেঁকে বসেছে। তবে এ চাপ মোকাবিলার প্রস্তুতি, সচেতনতা ও সহায়তামূলক কাঠামো দেশভেদে ভিন্ন। বাংলাদেশে মানসিক চাপ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা এখনও অনেকটাই প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থান করছে, যেখানে উন্নত দেশগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক সুসংগঠিতভাবে।
বাংলাদেশে মানসিক চাপ দীর্ঘদিন ধরেই একটি অবহেলিত বিষয়। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা একেবারে হয় না বললেই চলে। উল্টো একে বরং দুর্বলতা বা লজ্জার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ মানসিক চাপে ভুগলেও তা লুকিয়ে রাখে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য নেয় না। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পারিবারিক জীবনে চাপ দিনদিন বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার চাপে, চাকরিপ্রার্থীরা অনিশ্চয়তার চাপে এবং কর্মজীবীরা কাজের চাপে স্ট্রেসে আক্রান্ত হচ্ছে। উপরন্তু ডিজিটাল সমাজমাধ্যমগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের মধ্যে অবচেতনভাবে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ও অসন্তুষ্টি তৈরি করছে। নিজেকে সব সময় সেরা দেখানোর চাপ মানসিক ক্লান্তি ও স্ট্রেস বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্য কেয়ার লাইন ‘শোনো’র বিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ তানজিনা চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে স্ট্রেসকে এখনও সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। কিন্তু এ চাপ দীর্ঘমেয়াদে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ এবং শারীরিক অসুস্থতা পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে।’
মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, মনোযোগের ঘাটতি, ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ, ক্ষুধাহ্রাস বা অস্বাভাবিক খাওয়ার অভ্যাস এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব। অনেক সময় মানুষ সামাজিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে শুরু করে এবং একাকিত্বে ভোগে।
শারীরিকভাবে এ চাপের প্রভাবও স্পষ্টÑ মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, হজমে সমস্যা, পেশিতে টান বা ব্যথা, এমনকি উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এ স্ট্রেস উদ্বেগজনিত রোগ, হৃদরোগ এমনকি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে। স্ট্রেস আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। কাজের দক্ষতা কমে যায়, সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। অনেক সময় এ চাপ আত্মহানি বা আত্মঘাতী চিন্তার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। তাই মানসিক চাপকে অবহেলা না করে এর লক্ষণগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা এবং যথাযথ সহায়তা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা, সহানুভূতি এবং প্রয়োজনে পেশাদার সহায়তার মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
উন্নত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব
উন্নত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যকে শরীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা কর্মসূচি এবং অনলাইন কাউন্সেলিং প্ল্যাটফর্ম সবই মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাজ্যে যেমন মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র করে ‘মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড’ ট্রেনিং চালু রয়েছে। এ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সহকর্মীরা অন্য কর্মীদের মধ্যে মানসিক অস্বস্তির প্রাথমিক লক্ষণ ও আচরণগত পরিবর্তনগুলো বুঝতে এবং প্রাথমিক সহায়তা দিতে প্রশিক্ষিত হন। চাপ বা মানসিক সংকটে থাকা সহকর্মীদের সঙ্গে বিনা সমালোচনায়, সহানুভূতির সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে আত্মঘাতীমূলক প্রবণতা থাকলে তা সতর্কভাবে মূল্যায়ন করতে এ প্রশিক্ষণটি কাজে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মস্থলে নিয়মিতভাবে Wellness Days রাখা হয়, যেখানে কর্মীরা মানসিক প্রশান্তি ও বিশ্রামের জন্য একটি দিন পান। এ ছাড়া স্ট্রেস রিলিফ ওয়ার্কশপ, মেডিটেশন সেশন এবং থেরাপিস্টের সহায়তা অনেক প্রতিষ্ঠানেই সহজলভ্য।
যুক্তরাষ্ট্রে এপ্রিলকে ‘ন্যাশনাল স্ট্রেস অ্যাওয়ারনেস মান্থ’ বা জাতীয় মানসিক চাপ সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া এ বার্ষিক উদ্যোগের মূল লক্ষ্য স্ট্রেসের কারণ, প্রতিকার এবং এর প্রভাব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এটি মানুষকে আলোচনা করতে উৎসাহিত করে এবং মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা ও আত্মপরিচর্যার গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
জাপানে ‘কারোশি’ বা অতিরিক্ত কাজের চাপে মৃত্যু একটি চিহ্নিত সামাজিক সমস্যা। এটি মোকাবিলায় সে দেশে সরকারিভাবে কাজের ঘণ্টা সীমিত করা, বিশ্রামকাল বাধ্যতামূলক করা এবং কাউন্সেলিং সেবা সরবরাহ করা হয়।
চীনেও কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ সহায়তাকল্পে নিয়মিতভাবে মনঃস্বাস্থ্য কর্মশালার আয়োজন করা হয়। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিটেশন ও মনঃসংযোগ বৃদ্ধির ক্লাস চালু করেছে চীন সরকার। সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য হটলাইন ও কাউন্সেলিং সেবাও সহজলভ্য করা হয়েছে জনগণের জন্য।
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতনতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা একযোগে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শদাতা নিয়োগ এবং লাইফ স্কিলভিত্তিক শিক্ষা চালু রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মেডিটেশন সেশন, ওয়ার্কশপ এবং কাউন্সেলিং সুবিধা চালু রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। আয়ুর্বেদ, যোগ ও ধ্যানের মতো প্রাচীন চর্চাগুলোও ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস ব্যবস্থাপনায় কিছু কাঠামোগত এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখনও অনেক মানুষ সচেতনতার অভাবে, মানসিক চাপকে গুরুত্ব দেয় না বা বুঝতে পারে না যে সেটি সমস্যা সৃষ্টি করছে। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা এখনও খুব কম, বিশেষ করে জেলা ও গ্রাম পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত সেবার অপ্রতুলতা চোখে পড়ার মতো।
সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে আমাদের দেশে প্রায়ই ছোট ছোট মানসিক সমস্যা পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর রূপ ধারণ করে। তখন অনেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চাইলেও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে না। কারণ তা ব্যয়বহুল মনে হয়।
মানসিক অসুস্থতা আমাদের দেশে পাগলামি বা দুর্বলতা হিসেবে দেখার প্রবণতা এখনও বহাল। এসব কারণে মানসিক চাপের মতো সামান্য ব্যাপারও স্টিগমা বা কুসংস্কার হিসেবে পরিগণিত হয়।
করণীয়
এ সমস্যার উন্নয়ন ও সমাধানে ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিছু সম্ভাব্য উদ্যোগ হতে পারে যেমন স্কুল পর্যায়ে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা যা শিক্ষার্থীদের শুরু থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে ধারণা দেবে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়ক পরিবেশে কর্মচারীদের জন্য স্ট্রেস রিলিফ কার্যক্রম, হেল্পলাইন ও কাউন্সেলিং সেবা চালু করা। এ বিষয়ে গত বছর থেকে বিভিন্ন প্ৰতিষ্ঠানে ‘শোনো’ আয়োজন করে যাচ্ছে ‘মাইন্ড ম্যাটার্স’ শীর্ষক একটি কর্মশালা।
স্থানীয় পর্যায়ে সেবা বিস্তারের জন্য জেলা ও উপজেলায় মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ প্রয়োজন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইন কাউন্সেলিং, অ্যাপস বা হেল্পলাইন চালু করা, যেগুলো সহজে নাগাল পাওয়া সম্ভব।
শোনোর মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শক তন্বীতা ঘোষ বলেন, ‘মানুষকে শুধু রোগ শনাক্তের পর নয়, বরং প্রতিরোধ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই সহায়তা করতে হবে। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করা হলে মানসিক রোগের সংখ্যাও অনেক কমে আসবে।’
"মানসিক স্বাস্থ্যই আসলে সব স্বাস্থ্যের মূল। শরীর ভালো রাখতে চাইলে, মনকেও ভালো রাখতে হবে।"
— তানজিনা চৌধুরী, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শোনো।
লেখক : কো-ফাউন্ডার, সিইও, শোনো
একটি মানসিক স্বাস্থ্য কেয়ার লাইন