ধামাইল সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার
ইসমাইল মাহমুদ
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:১৬ এএম
নিজের হাতে গড়া ধামাইল একাডেমির শিল্পীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ সরকার
সিলেটি লুপ্তপ্রায় ধামাইল নৃত্যগীতের সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার। বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের রুস্তমপুর গ্রামে। বৃহত্তর সিলেটে তার পরিচিতি ধামাইলপ্রেমিক হিসেবে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা তার পরিবারের। এ অবস্থায়ও লুপ্তপ্রায় লোকগীত খুঁজতে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেট বিভাগের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘নব নাগরী ধামাইল সংঘ’ ও ‘ধামাইল একাডেমি’। সংগঠনগুলো পরিচালনা করছেন পুরোপুরি নিজের অর্থায়নে। প্রতি শুক্রবার সংগঠনের উদ্যোগে নৃত্যশিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। ধামাইল নিয়ে সম্পাদনা করেছেন ‘সিলেটি ধামাইল গীত’ নামে একটি গ্রন্থ। ধামাইল নৃত্যগীত পুনরুজ্জীবিত করার প্রাণপুরুষ রামকৃষ্ণ সরকার এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার শরীরে বাসা বেঁধেছে বিরল মাল্টিপল মায়লোমা (এমএম) প্লাজমা কোষের ক্যানসার। এ ছাড়া কিডনি রোগেও আক্রান্ত তিনি। ধারদেনা ও মানুষের সহায়তায় রামকৃষ্ণ সরকারকে প্রথমে সিলেট, পরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল; সেখান থেকে পুনরায় সিলেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের ৫ নভেম্বর বুক ও পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে ভর্তি হন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় সিলেটের রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরে বাসা বেধেছে মাল্টিপল মায়লোমা (এমএম) প্লাজমা কোষের ক্যানসার। উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও অর্থাভাবে ঢাকা থেকে আবারও সিলেটের একটি হাসপাতালে আনা হয়। বর্তমানে সেখানেই চলছে তার চিকিৎসা।
১৯৭১ সালে রুস্তমপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম রামকৃষ্ণ সরকারের। বাবা ছিলেন দিনমজুর। রামকৃষ্ণের শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। আর্থিক টানাপড়েনে লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেননি। কৈশরেই শুরু করেন ধামাইলের জনক রাধারমণ দত্তের হারিয়ে যাওয়া গান সংগ্রহ। ঘুরে বেড়ান সিলেট অঞ্চলের গ্রাম থেকে গ্রামে। আর্থিক টানাপড়েনে অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা উপোস কাটাতেন। তবু তিনি তার নেশা থেকে একটুও পিছপা হননি। ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম তার কুঁড়েঘরের একটি অংশে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ধামাইল একাডেমি’ ও ‘নব নাগরী ধামাইল সংঘ’। এ সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ধামাইল নৃত্যগীতের প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নে নিরলস কাজ করা রামকৃষ্ণ এ পর্যন্ত সংগ্রহ করেছেন ৫ শতাধিক ধামাইলসহ অন্যান্য লোকজ গান। এ গানগুলো অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। তার সংগঠনের শিল্পীদের ধামাইল পরিবেশনা সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক প্রশংসিত। অর্থনৈতিক উন্নতি না হলেও জরাজীর্ণ ঘরের ভাঙা শোকেসে রয়েছে অসংখ্য সম্মাননা ও ক্রেস্টে।
রামকৃষ্ণ সরকারের স্ত্রী শুকলা রানী সরকার বলেন, ‘আমাদের সংসারে চরম অভাব-অনটন। অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা ব্যয় ও পরিবারের ভরণপোষণে চোখে অন্ধকার দেখছি। সবার সহযোগীতায় তাকে ঢাকায় নিয়ে ভর্তি করা হয়। আর্থিক কারণে আবার তাকে সিলেট নিয়ে আসি। ধারদেনা করে স্বামীর চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। জানি না কতদিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারব।’
রামকৃষ্ণ সরকারের ছোট মেয়ে ঝুমি সরকার বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে লোকজ সংস্কৃতির একটি বড় অংশ ধামাইল নৃত্যগীত বাঁচিয়ে রাখতে সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি এটিই বাবার একমাত্র দুঃখ। নিজের টাকা খরচ করে ধামাইল বাঁচিয়ে রাখতে ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেটের পথে পথে। তৈরি করেছেন ধামাইল সংগঠন। এ সংগঠনের সদস্যদের নিজের টাকায় দিয়েছেন প্রশিক্ষণ। অভাব-অনটনের সংসারে বাবা লোকগীতি বাঁচাতে তার সারাটা জীবন চেষ্টা করেছেন। এখন সেই লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে সবার প্রতি সার্বিক সহযোগিতার আবেদন জানচ্ছি।’
রামকৃষ্ণ সরকারের সহপাঠী জয়ন্ত কুমার দেবনাথ বলেন, ‘ধামাইল নৃত্যগীত বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে অমানুষিক শ্রম দিয়েছেন রামকৃষ্ণ সরকার। বর্তমানে তিনি বিরল মাল্টিপল মায়লোমা নামক রোগে ভুগছেন। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সবার সহায়তা প্রয়োজন।
মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. বিনেন্দু কুমার ভৌমিক বলেন, ‘সিলেট বিভাগের লোকসংগীতের সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকার ভুগছেন মরণব্যাধি ক্যানসারে। এ রোগের চিকিৎসা অনেক দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল। রামকৃষ্ণ সরকারের পরিবারের দ্বারা এ রোগের চিকিৎসা করানো অসম্ভব। প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।’
লোকগীতি সংগ্রাহক রামকৃষ্ণ সরকারের চিকিৎসায় সহায়তার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।