রোজী আরেফিন
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:০৯ পিএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৩২ পিএম
পোশাক ও ছবি : রঙ বাংলাদেশ মডেল : পূর্ণিমা বৃষ্টি, মৃধা সাহা মম, শুভ, আমায়া সাহা, অরিক্ত রায়
ফ্যাশন জগতে একুশে ফেব্রুয়ারি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা এখন পোশাকের রঙ ও নকশায় ফুটে উঠছে। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে একুশের পোশাক নিয়ে। বিভিন্ন বয়সির মাঝে এ দিবস কেন্দ্র করে বেড়েছে ফ্যাশন সচেতনতা। একুশের ফ্যাশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন রোজী আরেফিন-
ফেব্রুয়ারির শুরুতেই নীলার মনটা ভীষণ খারাপ। তার ছোট ভাই আদিত্যের একুশের অনুষ্ঠানে কালো পাঞ্জাবি লাগবে, কিন্তু এখনও সে পাঞ্জাবিটা কিনতে পারেনি। নীলার হাতে টাকা খুব বেশি নেই, তবু ভাবল কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। শহীদ মিনারের পাশে ছোট্ট দোকানটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলা। সাদা অক্ষরে লেখা ‘একুশ’খচিত কালো পাঞ্জাবিটা দেখে তার চোখ ভিজে গেল। পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে নীলার মনে ভেসে উঠল ১৯৫২ সালের সেই দিনটির কথা। বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের রক্তের ইতিহাস যেন এ পোশাকের বুননে কথা বলে। আদিত্য এটা পরে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে, ভাবতেই নীলার গর্ব হলো। দাম কিছুটা বেশি হলেও সে পাঞ্জাবিটা কিনল। ভাইয়ের মুখে হাসি দেখার আনন্দের দাম তো আর টাকা দিয়ে হিসাব হয় না!
২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নীলা এবং তার ভাইয়ের ভাষা ও ভাষাশহীদদের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান কি কেবল ফেব্রুয়ারিতেই থাকে? না, বরং এ চেতনা সব সময়, সারা বছর আমাদের সঙ্গী। নীলার মতোই সব বাঙালি জানে, একুশের চেতনা শুধুই এক দিনের নয়, এটা প্রতিদিনের অহংকার, প্রতিদিনের অনুভূতি।
একুশের পোশাকে বাংলা ভাষা
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির চেতনায় অম্লান এক গৌরবগাথা। ভাষার জন্য রক্তদানের এ দিনটি শুধু শোকের নয়, স্বাধিকার আন্দোলনের স্পর্ধিত ইতিহাস। কিন্তু এ ইতিহাস আজ কেবল স্মৃতিসৌধ বা গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং মিশে গেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা অঙ্গনে। বিশেষ করে পোশাক-পরিচ্ছদে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন উজ্জ্বল মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
শাড়ির আঁচলে, পাঞ্জাবি ও টি-শার্টের গায়ে, শিশুর পোশাকে এমনকি ফ্যাশন র্যাম্পেও বাংলা বর্ণের হরেকরকম উপস্থিতি নতুনভাবে জাগিয়ে তুলছে একুশের চেতনা। আর এ শৈল্পিকতার মাঝে লুকিয়ে আছে বর্ণের খেলাÑ লাল, সাদা, সবুজ, নীলের সমারোহে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য।
একসময় পোশাকের নকশা মানেই ছিল ফুল-লতা-পাখি বা পাশ্চাত্য ডিজাইন। কিন্তু এখন ভাষার সৌন্দর্যও রঙিন সুতোয় বুনছেন ডিজাইনাররা। ঢাকাই জামদানি কিংবা অন্যান্য শাড়ির নকশায় একসময় শুধুই কারুকার্য থাকত। আজ সেখানে যুক্ত হয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কিংবা ‘বাংলা ভাষা’ লেখার মতো প্রতীকী ব্যবহার।
একুশের চেতনার প্রতিফলন, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংযোগ
শুরুতে একুশের পোশাক ছিল সাদামাটাÑ সাদা-কালো শাড়ি, পাঞ্জাবি কিংবা ফতুয়া। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজাইন ও রঙেও এসেছে নতুন মাত্রা। লাল, সবুজ, নীলের সংযোজন একুশের পোশাক আরও অর্থবহ ও ট্রেন্ডি করে তুলেছে। বাংলা বর্ণমালার ছাপ, একুশের প্রতীকী ডিজাইন, এমনকি শহীদ মিনারের কাঠামোও এখন পোশাকের নকশায় জায়গা করে নিয়েছে। তবে রঙ ও নকশা যতই বদলাক, একুশের চেতনা একটুও বদলায়নি। এটি শুধু ফ্যাশন নয়, আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আমরা যখন এ পোশাক পরি, তখন বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি গর্ব, আবেগ ও আত্মমর্যাদার অনুভূতি বহন করি।
একুশের পোশাক শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, এটি গভীরভাবে প্রতীকীও- লাল রঙ ভাষাশহীদদের রক্তস্রোতের স্মৃতি, সাদা শান্তি ও বিশুদ্ধতার প্রতীক, সবুজ বাংলার প্রাণপ্রকৃতি আর নীল অসীম কিছু ও স্বপ্নের প্রতীক।
তরুণ-তরুণীদের পছন্দ : আজকাল তরুণ-তরুণীরা শুধু কালো পাঞ্জাবি বা সালোয়ার-কামিজে থেমে থাকে না। গাঢ় নীল টি-শার্ট, যার গায়ে লেখা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’, এ ধরনের স্টাইলও এখন জনপ্রিয়। মেয়েরা আবার লাল পাড়ের শাড়িতে কালো ক্যালিগ্রাফিতে লেখা কবিতা পরতে পছন্দ করে।
বয়স্কদের পছন্দ : বয়স্করা এখনও একুশের দিন কালো বা সাদা পোশাকই পরতে বেশি পছন্দ করেন, কিন্তু অনেকেই এখন শাড়ি, পাঞ্জাবি বা ফতুয়ায় বাংলা লিপির ডিজাইনও রাখতে শুরু করেছেন।
শিশুদের পোশাক : এখন ছোটদের জন্যও আছে বিশেষ ‘একুশে কালেকশন’, যেখানে ছোট মেয়েদের ফ্রক বা ছেলেদের শার্টেও বাংলা বর্ণমালা বা ভাষা আন্দোলনের বার্তা দেওয়া হয়।
এ বছর একুশের পোশাক ডিজাইন করার সময় কোন কোন বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাস বলেন, ‘এবারের একুশের পোশাক ডিজাইন করা হয়েছে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা থিমে। একুশে ফেব্রুয়ারি যেহেতু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই পোশাকে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষার বর্ণমালাকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কালার হিসেবে সাদা ও কালোর সলিড রঙ ছাড়াও বিভিন্ন সেডকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। স্ক্রিনপ্রিন্ট, ব্লকপ্রিন্ট, কাট অ্যান্ড সিউ ভ্যালু অ্যাডেড করা হয়েছে প্রতিটি পোশাকেই। বর্তমানে আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে ফেব্রিক্স হিসেবে কটনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’
কী ধরনের স্টাইল সবাই পছন্দ করছেÑ এর মন্তব্যে তিনি জানান, ‘বর্তমানে সবাই ম্যাচিং পোশাক বেশি পছন্দ করছে। যেহেতু পরিবারের সবাই একই থিম বা কালারের পোশাক পরতে পছন্দ করে ফলে সব উৎসবেই পরিবারের সবার জন্য ম্যাচিং ফ্যামিলি পোশাক থাকে রঙ বাংলাদেশে। ট্র্যাডিশনাল পোশাকগুলোর চাহিদা সব সময়ই রয়েছে কিন্তু আমরা যেহেতু মডার্ন ট্রেন্ডও মাথায় রাখি ফলে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।’
ফ্যাশনে একুশ ও বাংলা বর্ণের বৈশ্বিক প্রভাব
এখন একুশের চেতনা শুধু বইমেলা, কবিতা আবৃত্তি বা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ফ্যাশনেও জায়গা করে নিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা এখন পোশাকের রঙ ও নকশায় ফুটে উঠছে। কালো পাঞ্জাবিতে সাদা হরফে লেখা ‘একুশ’, লাল পাড়ের শাড়িতে কালো ক্যালিগ্রাফিতে কবিতা, কিংবা টি-শার্টের বুকে আঁকা বাংলা বর্ণমালাÑ এসব ফেব্রুয়ারির ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে।
একসময় পোশাকে শুধুই ইংরেজি লেখা দেখা যেত, এখন দৃশ্যপট বদলেছে। তরুণ প্রজন্ম গর্বের সঙ্গে বাংলা অক্ষর পরছে, ভাষা নিজের শরীরে ধারণ করছে। বাংলা বর্ণমালার এ ব্যবহার শুধু ফ্যাশন ট্রেন্ড নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিচিহ্ন।
বাংলা বর্ণের পোশাক এখন শিল্প ও বাণিজ্যের মেলবন্ধনেও কাজ করছে। স্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো ‘একুশে কালেকশন’ নামে বিশেষ পোশাকের সিরিজ বাজারজাত করছে। হ্যান্ড-পেইন্টেড শাড়ি, ডিজিটাল প্রিন্টের টুপি সবকিছুতেই বাংলা লিপির ব্যবহার বাড়ছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বাংলার ব্যবহার পোশাকে এ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যখন পশ্চিমা ফ্যাশনের আধিপত্যে স্থানীয় সংস্কৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলা হরফের পোশাক এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করছে। এটিকে এখন বলা যায় আমাদের ভাষা ও পরিচয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরার শক্তিশালী মাধ্যম।
পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। যখন সে পোশাকে জড়িয়ে যায় মাতৃভাষার বর্ণমালা, তখন তা হয়ে ওঠে চেতনার বহিঃপ্রকাশ। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস আজ পোশাকে বর্ণময় হয়ে হাজির হয়Ñ কখনও লাল সুতোয় বোনা কবিতার ছন্দে, কখনও সবুজ-সাদার সমন্বয়ে। একুশের এ পোশাক উৎসব শুধু ফ্যাশন নয়, একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ও সংগ্রামের দলিল। বাংলা বর্ণের এ রূপায়ণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা কখনও নিভে যায়নি; বরং নতুন রূপে প্রজ্বলিত হচ্ছে প্রতিদিন।
পোশাক ও ছবি : রঙ বাংলাদেশ
মডেল : পূর্ণিমা বৃষ্টি, মৃধা সাহা মম, শুভ, আমায়া সাহা, অরিক্ত রায়