আরাফাত হোসাইন
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:১১ এএম
আমিয়াখুম
পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে নেমে আসছে জলধারা। দুধসাদা রঙের ফেনা ছড়িয়ে তা বয়ে চলেছে পাথরের গা বেয়ে। নিমেষেই ভিজিয়ে দিচ্ছে পাশের পাথুরে চাতাল। সঙ্গে অবিরাম চলছে জলধারার পতন আর প্রবাহের শব্দতরঙ্গ। লোকালয় ছেড়ে গহিন পাহাড়ের পাদদেশ ঘুরে এসে লিখেছেন
অবিরাম চলছে জলধারার পতন আর প্রবাহের শব্দতরঙ্গ। লোকালয় ছেড়ে গহিন পাহাড়ের মাঝে এমন দৃশ্য, একবার দেখলে মনের গভীরে গেঁথে থাকবে আজীবন। প্রকৃতি এমন অপার সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বসে আছে আমাদের এই সবুজ-শ্যামল বাংলায়, বান্দরবানে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে ‘আমিয়াখুম জলপ্রপাত’কে দেখা হচ্ছে বাংলার ভূস্বর্গ হিসেবে। কারও কারও মতে, এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। এর অবস্থান বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম নাক্ষিয়ং নামক স্থানে।
দারুণ কিছু খুম আর তার পাশে ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছি আমরা। থাকবে খুমের পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি, জঙ্গলে ক্যাম্প ফায়ার, তাঁবুতে রাত নিবাস আর সঙ্গে থাকবে তারার আলোয় নতুন এক উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা।
দেখব : থানচি, সাঙ্গু নদ, রাজাপাথর, রেমাক্রিফলস, সাতভাইখুম, আমিয়াখুম, নাইক্ষংমুখ, ভেলাখুম, দেবতাপাহাড়, নাফাখুম।
প্রথম দিন
বাস থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করলাম পান বাজারে। নাশতা শেষ করে ডিম পাহাড় হয়ে থানচি যাওয়ার জন্য জিপ ভাড়া করলাম। জিপে চেপে ডিম পাহাড় গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ ছবি তুলে ফের রওনা দিলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, চারপাশে পাহাড়, সবুজের সমারোহ সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর ও ভালো লাগা কাজ করছিল। আরও দুই জায়গায় আর্মি চেকপোস্টে এন্ট্রি দিয়ে থানচি পৌঁছে গেলাম। জিপ ভাড়া পরিশোধ করে সোজা চলে গেলাম আগে থেকে ঠিক করা গাইডের কাছে (আমার এক বন্ধুর মামা ঠিক করে দিয়েছিলেন)। তিনি আমাদের নিয়ে থানায় গিয়ে ফরমের ১০০ টাকা ও পরিচয়পত্র জমা দিলেন। থানার কাজ শেষ করে সোজা একটা দোকানে ঢুকে ট্রেকিং জুতা, অ্যাংলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবার কিনলাম। তারপর গাইড দাদার ঠিক করা দুই বোটে চড়ে আমরা পদ্ম ঝিরির উদ্দেশে রওনা হলাম। ৪০ মিনিটের মধ্যে পদ্মমুখ চলে এলাম। সেখান থেকে ট্রেকিং শুরু করলাম তখন ঘড়িতে ১২টা ২০ মিনিট। ঝিরিপথ, ছোট টিলার মতো অসম্ভব সুন্দর, গা ছমছমে রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। এক ঘণ্টা হেঁটে ১০ মিনিটের ব্রেক দিয়ে হালকা খাবার খেয়ে আবার হাঁটা ধরলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর প্রথম একটা পাহাড় পার হলাম, যা খুবই কষ্টকর ছিল। তারপর আরও দুটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে একটা পাড়ায় গিয়ে বিশ্রাম নিলাম এবং হালকা খাবার খেলাম। পাহাড়ি পেঁপে কিনে খেলাম, যা ছিল এক কথায় অমৃতের মতো। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। বিকালবেলা আরেকটা পাড়ার দোকানে বিরতি দিয়ে আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝিরিপথ দিয়ে হাঁটা ধরলাম। বিকাল ৫টার দিকে পৌঁছে গেলাম থুইসাপাড়ায়। এখানেই আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেখানে পৌঁছে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে পাহাড়িদের মাচাংঘরে সবাই বিশ্রাম নিলাম। রাতের খাবার প্রস্তুত হলে গাইড দাদা আমাদের নিয়ে খাবার খাওয়ার স্থানে গেলেন। একসঙ্গে ১০ জন রাতের খাবার শেষ করলাম। খাবারের মেন্যুতে ছিল জুম চালের ভাত, মুরগির মাংস, ডাল। (থুইসাপাড়ার ওপরের পাড়ায় বিজিবি ক্যাম্প ছিল ওখান থেকে মুরগির মাংস কেনা হয়েছিল, তাই হারাম হবে কি নাÑ এ নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি)। খাওয়া শেষ করে দ্রুত নাপা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কারণ পা অনেক ব্যথা করছিল। পরদিন ভোর সাড়ে ৫টায় গাইড দাদা আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিলেন।
দ্বিতীয় দিন
দ্রুত ঘুম থেকে উঠে যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করলাম। সকালের নাশতায় ছিল ডিম-খিচুড়ি। খাওয়া শেষ করে দেবতা পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম, যেখানে আছে ভ্রমণের প্রধান আকর্ষণ আমিয়াখুম, সাতভাইখুম, ভেলাখুম। আমরা আমাদের দুপুরের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে নিলাম আমিয়াখুমের পাশে বসে খাব বলে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর দেবতা পাহাড়ের ওপর পৌঁছালাম। তারপর শুরু হলো আসল অ্যাডভেঞ্চার। ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে নামা শুরু করলাম। সে অনেক ভয়ংকর পরিস্থিতি ছিল, দুই-তিনজন স্লিপ করেছিল কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেই কঠিন রাস্তাগুলো পার হয়ে ঘণ্টা দেড়েক পরে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম ভেলার কাছে, এক ভেলায় করে ১০ জন চলে গেলাম ভেলাখুমে। সেখানে কিছুক্ষণ ছবি তুলে, ঝরনায় মাতামাতি করে চলে এলাম আমিয়াখুমে। সে কী সুন্দর দৃশ্য যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। স্বচ্ছ হালকা সবুজ পানি, মিষ্টি রোদে বসে কলাপাতায় দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, ছবি তুললাম। আমরা সকাল সাড়ে ৮টায় ভেলাখুম আমিয়াখুমে পৌঁছে ছিলাম, যখন অন্য কোনো দল এসে পৌঁছেনি। শুধু আমরাই ছিলাম আর পাশে স্থানীয় কয়েকজন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের দলগুলো আসতে লাগল। আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ করে যখন রওনা দিলাম, তখন সময় সাড়ে ১১টার মতো। আমরা যখন দেবতা পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম তখন বেশিরভাগ মানুষ আসা শুরু করছে এবং কিছু সময়ের মধ্যে পুরো খুমে ভিড় লেগে গেছে। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা দেবতা পাহাড়ের ওপর পৌঁছালাম। এই পাহাড় নামতে সময় বেশি লাগে, কিন্তু ওঠা কোনো ব্যাপারই না।
মারমা ভাষায় ‘খুম’ মানে জলপ্রপাত। ঝরনার পানি শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে গেলেও খুমের পানি শুকায় না। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের পাশে আমিয়াখুম জলপ্রপাতকে দেখা যায় বাংলার ভূস্বর্গ হিসেবে। অপরূপ রূপের পসরা নিয়ে আমিয়াখুম দাঁড়িয়ে আছে বান্দরবানের থানচি উপজেলার নাক্ষিয়ং নামক স্থানে। পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের গা ঘেঁষে দ্রুতগতিতে নেমে আসে ঝরনাধারা। দুধসাদা রঙের ফেনা তুলে তা নিমিষেই আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেন, আমিয়াখুম হলো সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। বান্দরবান থেকে বাস বা জিপে সোজা চলে যাবেন থানচিতে।
থানচি নেমে প্রধান কাজ হলো একজন গাইড ঠিক করা। এবার থানচি থেকে নৌকা নিয়ে রেমাক্রি বাজারে চলে যান। যদি থানচি থেকে সকাল সকাল রওনা দেন, তাহলে রেমাক্রি নেমে হাঁটা ধরুন নাফাখুম ঝরনার উদ্দেশে। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা হাঁটলে আপনারা পেয়ে যাবেন নাফাখুমের দেখা। এখানে কিছুক্ষণ ছবি তুলে, বিশ্রাম নিয়ে এবার সাজিয়াপাড়ার দিকে রওনা হয়ে যান। নাফাখুম ঝরনা থেকে হাঁটা শুরু করলে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই আপনারা পৌঁছে যাবেন সাজিয়াপাড়া। সাজিয়াপাড়ায় রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল উঠে পড়ুন এবং সাজিয়াপাড়া থেকে একজন গাইড নিয়ে রওনা হয়ে যান আমিয়াখুমের উদ্দেশে। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা অসাধারণ সব রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন আমিয়াখুম ঝরনা।
তারপর দ্রুত পা চালিয়ে থুইসাপাড়াতে ফিরে এলাম। যেহেতু দুপুরের খাবারপর্ব আমিয়াখুমেই শেষ, তাই দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে পাড়ার খরচ পরিশোধ করে নাফাখুমের উদ্দেশে পা বাড়ালাম। তখন সময় ২টার কাছাকাছি, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর নাফাখুমপাড়ায় পৌঁছালাম।
নাফাখুমকে বলা হয় বাংলাদেশের নায়াগ্রা। কারণ নাফাখুম জলপ্রপাতে পানি প্রবল বেগে ছুটে আসে। আর এখানে পানি পড়ার পরিমাণ বেশি। এটি বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত। থানচি বাজার থেকে নৌকা দিয়ে রেমাক্রি গিয়ে নাফাখুম দেখতে হয়। রেমাক্রি থেকে নাফাখুম জলপ্রপাতে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়।
নাফাখুমের পথটা তুলনামূলক সহজ পদ্মঝিরির চেয়ে। কেননা বড় কোনো পাহাড় নেই, পুরোটাই ঝিরি। মাঝপথে দুবার বিরতি দিয়েছিলাম স্থানীয় দোকান থেকে কিছু খাওয়ার জন্য।
তারপর দ্রুত নাফাখুমপাড়ায় আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করলেন গাইড দাদা। একটা মাচাংঘরের বিশাল বারান্দা দেওয়া হলো আমাদের। ১০ জন আরাম করেই থাকা গেছে। পাড়ায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঘরে ঢুকলাম। রাতে আমাদের খাবার দিল ভাত, ডিম ও ডাল। খাওয়া শেষ করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।
তৃতীয় দিন
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবারপর্ব শেষ করলাম ডিম-খিচুড়ি দিয়ে। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে পাড়ার খরচ পরিশোধ করে সোজা রেমাক্রির পথ ধরলাম। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর একটা দোকানে ঢুকে হালকা খাবার খেয়ে আবার হাঁটা ধরলাম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রেমাক্রি পৌঁছে ছিলাম। সেখানে পানির প্রবাহ তেমন ছিল না, যেমনটা বর্ষাকালে থাকে।
তারপর কিছু ছবি তুলে বোটে উঠে পড়লাম। এক ঘণ্টা পর নেটওয়ার্কে প্রবেশ করলাম মানে থানচি চলে এলাম। তারপর বোটের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে থানচি বাজারে একটা রেস্টুরেন্টের মতো আছে যেখানে ট্যুরিস্টরা জামা-কাপড় পাল্টানো ও ফ্রেশ হতে পারে। এখান থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলাম আবার এখানে ফিরে এসে গাইড দাদার পাওনা মিটিয়ে একটা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করলাম, গন্তব্য বান্দরবান শহর। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা আমাদের নিয়ে ছুটে চলল চাঁদের গাড়ি। পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি হলো কয়েকবার, যেখানে পরিচয়পত্র জমা দেওয়া লেগে ছিল।
বান্দরবান শহরে নামার সময় ঘড়ির কাঁটায় ৪টা বাজে। একটু খোঁজাখুঁজি করে সৌদিয়া পরিবহনে ১০টা টিকিট কাটলাম, গাড়ি ছাড়ার সময় ছিল রাত সাড়ে ৮টায়। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার খেলাম। খাওয়া শেষ করে কেউ কেউ আশপাশে ঘুরল, কেউ কাউন্টারে বিশ্রাম নিল।