আব্দুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:২৪ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ধলেশ্বরী টোল প্লাজা। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর টোল দেওয়ার সময় একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেখানে অপেক্ষমাণ যানবাহনকে চাপা দিলে মৃত্যুবরণ করে শিশুসহ এক পরিবারের চারজনসহ পাঁচজন। এ ঘটনায় মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের কমপক্ষে ১৫ যাত্রী গুরুতর আহত হন।
১৯ ডিসেম্বরের আরেকটি ঘটনা। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় ডাম্প ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হয়েছে। একই বছর ১৬ ফেব্রুয়ারির কথাই যদি বলি, এদিন দেশের ছয় জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহে বাস-সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পরিবারের তিনজনসহ সাতজন, বগুড়ায় তিনজন, জামালপুরে দুজন, মৌলভীবাজারে তিনজন, ফরিদপুরে একজন ও চুয়াডাঙ্গায় একজন।
সদ্য সমাপ্ত বছরটিতে দুর্ঘটনার এমন খবর প্রতিদিনই সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই প্রাণ হারিয়েছে কেউ না কেউ। সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যেন মৃত্যুর মিছিল চলছিল। এভাবে সড়কে আর কত প্রাণ ঝরবেÑ এ প্রশ্নের উত্তর নেই যেন কারও কাছে।
গত বছর সড়কে কত প্রাণ ঝরেছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারিভাবে সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে বেশ তফাত দেখা যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৫ হাজার ৩৮০ জনের। কিন্তু বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ সংখ্যা ৭ হাজার ২৯৪। এ ছাড়া বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর নিহত হয় ৮ হাজার ৫৪৩ জন। সংখ্যার গরমিল থাকলেও সড়কে প্রাণহানি যে বাড়ছে, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই।
সড়কে প্রাণহানি বেড়ে চললেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর সড়কে প্রাণহানি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু ছয় মাস পার হলেও সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বিআরটিএর তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। এ সময় সড়কে মারা গেছে ৫ হাজার ৩৮০ জন। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল ২০২১ সালে, ৫ হাজার ৮৪ জনের। এ ছাড়া ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৫ হাজার ২৪ জনের এবং ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৬৩৬।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে ৬ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ১২ হাজার ১৯ জন।
সংগঠনটি বলছে, ২০২৪ সালে এসব দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের ক্ষতির আর্থিক মূল্য ২১ হাজার ৮৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
রোড সেফটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে নারী ৮৯৩ জন আর শিশু ১ হাজার ১৫২টি। এ বছর ২ হাজার ৭৬১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ৬০৯ জন। এটি মোট নিহতের প্রায় ৩৬ শতাংশ। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার প্রায় ৪০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৩৫ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২১ শতাংশের বেশি। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯৮৪ জন। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ১১৮টি নৌ দুর্ঘটনায় ১৫২ জন নিহত, ১৬১ জন আহত হয়েছে আর ৩৯ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৩৪৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২৪ জন নিহত এবং ২৭৭ জন আহত হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি হয়েছে আঞ্চলিক সড়কে, এর সংখ্যা ২ হাজার ৭৩৬। এটি মোট দুর্ঘটনার ৩৯ শতাংশের বেশি। আর ২ হাজার ৩৫৭টি হয়েছে জাতীয় মহাসড়কে, ৯৭২টি গ্রামীণ সড়কে, ৭৮৪টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৭৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ২ হাজার ৯০৮টি। এ ছাড়া ১ হাজার ৫২৭টি মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং ১ হাজার ৫৬২টি পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এবার বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দৃষ্টি ফেরানো যাক। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছর ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১২ হাজার ৬০৮ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আর আহতের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছর রেলপথেও ৪৯৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫১২ জন নিহত এবং ৩১৫ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ২৩৭ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
যাত্রীকল্যাণ সমিতি চলতি বছরের প্রথম মাসে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ৬৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৭৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ২৭১ জন। রেলপথে ৫৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫৯ জন, আহত হয়েছে ২৩ জন এবং নৌপথে ১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮ জন, আহত নয়জন এবং নিখোঁজ হয়েছে পাঁচজন।
জানুয়ারিতে সর্বমোট সড়ক, রেল ও নৌপথে ৭৩২টি দুর্ঘটনায় ৭৫৪ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩০৩ জন আহত হয়েছে। এ মাসে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয় ঢাকা বিভাগে, সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে। এর মধ্যে ২৮৯ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩০১ জন নিহত ও ২৩৯ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৬ বাস দুর্ঘটনায় ১৫৯ নিহত ও ৪৫২ জন আহত হয়েছে এবং ১৬৩ ব্যাটারিচালিত-ইজিবাইক-নসিমন-অটোরিকশা-মাহিন্দ্রা দুর্ঘটনায় ১৩৯ জন নিহত ও ৩৩৬ জন আহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছিল তুমুল ছাত্র আন্দোলন। এর পরই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও সড়ক নিরাপদ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করে। যদিও পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগে দুর্বলতা আর গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। উল্টো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে ২০২৪ সালে। চব্বিশের আন্দোলনের ফলস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে জনমানুষের অন্যতম প্রত্যাশা ছিল শৃঙ্খলা ফিরে নিরাপদ হবে সড়ক, কমে আসবে প্রাণহানি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বদল হলেও পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে কেবল, ফিটনেসহীন যানবাহন সড়কে চলছে, আইনের অপপ্রয়োগ চলছে। বিআরটিএ রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত, ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা আদায়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যাবতীয় উপাদান সড়কে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কেবল সভাসমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের নানা প্রকার অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ হতাহত হচ্ছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাবে দায়ীদের শাস্তি হচ্ছে না। সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনাই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।