হারুন মিয়া
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:১৭ এএম
নিজের মুরগির খামারে সফল কৃষি উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবদুস সালাম
মোহাম্মদ আবদুস সালাম। পেশায় ছিলেন পান বিক্রেতা। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের দাড়িয়াপুর গ্রামে। শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে প্রাইমারির গণ্ডি পেরোনো। জীবনজীবিকার তাগিদে ১৯৯৩ সালে ১২ বছর বয়সে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। কখনো কারখানায়, কখনো কৃষিকাজ করে পরিবার সামলেছেন। পরবর্তীতে মুদি দোকান দিলেও নিজের সরলতা আর সত্যবাদিতার কারণে হয়েছেন বিফল। অতপর ২০০৯ সালে গৌরীপুর পৌর শহরে কালীখলা এলাকায় এক হোটেলের কর্ণধারের সহায়তায় পান বিক্রি শুরু করেন তিনি। একই সঙ্গে নিজের অল্প জমিতে পরিবারের জন্য সবজি ফলাতেন। পাশাপাশি পান বিক্রির টাকায় কিনেছেন দুটি গরু। ২০১৫ সালে দুটি গরু থেকে চারটি হয়। স্বপ্ন দেখেন ছোট একজন খামারি হওয়ার। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার সময় গরুগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার। চারটি গরুর মধ্যে দুটি মারা যায় আর দুটির চিকিৎসা করিয়ে কম দামে বিক্রি করে দেন। এ অবস্থায় ভেঙে পড়েন তিনি। সালাম ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একই হোটেলের বারান্দায় পান বিক্রি করে আসছিলেন সালাম। কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন একদিন কৃষি উদ্যোক্তা হবেন তিনি।
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর তার দোকান ছেড়ে দেওয়ার শেষ দিন ছিল। তার পানের গ্রাহক ছিল দৈনিক ৩ শতাধিক। উপজেলার নানা প্রান্তের মানুষ এখনও তার পান খেতে ছুটে আসে। তার সততা, ব্যবহার আর নৈতিকতায় মুগ্ধ ছিল স্থানীয়রা। যে কারণে তার বিদায় স্মরণীয় করে রাখতে এ সংবর্ধনার আয়োজন করে তারা। পান দোকানির বিরল কর্মকাণ্ডে খুশি হন তার গ্রাহকরা। তারা তাকে নানান উপঢৌকন উপহার দেন।
দোকানের প্রায় ১২০ জন গ্রাহকের কাছে বকেয়া আছে ৫৭ হাজার টাকার বেশি। তার এ টাকা কেউ কেউ পরিশোধ করতে চাইলেও তিনি নিতে অপারগতা জানান। জানতে চাইলে পান দোকানি সালাম বলেন, ‘আমার সব গ্রাহকের কাছ থেকে আমি ১৫ বছরে পান বিক্রি করে অসংখ্য টাকা লাভ করেছি। কারও কাছে এখন হাজার টাকা অথবা ৫০০ টাকার বেশি আমার পাওনা নেই। আমি মনে করি এ টাকা না নিলে আমি খুশি হব অনেক।’ জালাল হোটেলের কর্ণধার জলিল মিয়া বলেন, ‘বাবার ব্যবসাজীবন থেকে আমার ব্যবসাজীবনে এ হোটেলের বারান্দায় সালাম ভাই-ই একমাত্র বেশিদিন থেকে গেছেন তার সততা আর নৈতিকতার কারণে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সালাম ভাইয়ের মতো সৎমানুষ হয় না। তার নতুন কর্মজীবনে তিনি সুখী হোন সেটাই আমার চাওয়া।’
এরপর সালাম পৌর শহর থেকে দোকান ছেড়ে এসে এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। দোকান ছেড়ে দেওয়ার পরপরই গ্রামে এসে ৩ লক্ষাধিক টাকা খরচ করে মুরগির ফার্ম দেন। প্রথম অবস্থায় পনেরশ মুরগির বাচ্চা তোলেন। অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত হয়ে ৫০টির বেশি বাচ্চা মরে গেলেও পূরণ হচ্ছে সালামের স্বপ্ন। বর্তমানে মুরগিগুলোর ওজন ১ কেজির মতো। বিক্রিযোগ্য মুরগিগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই বাজারে পাইকারি বিক্রি করলেও খরচ বাদে মুনাফা পাবেন লক্ষাধিক টাকা। বাড়ির পাশে ৪ শতাংশ জায়গায় মুরগির খামার আর বাকি জায়গায় সুপারি, টমেটো, বেগুন, সূর্যমুখী ফুলের গাছ লাগানো আছে। সবজি বিক্রির পাশাপাশি নিজের হাতে তৈরি বাগান থেকে পরিবারেরও খাওয়া চলে।
আবদুস সালামের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে ইয়াসিন ২০২১ সালে গৌরীপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। মেয়ে সালমা আক্তার স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
পান দোকানি সালামের জীবনের লক্ষ্য কীÑ জানতে চাইলে বলেন, ‘সারা জীবন যেন আমি সততার সঙ্গে চলতে পারি এমনটাই আমার চাওয়া ওপরওয়ালার কাছে। এ এলাকাবাসী একজন পান দোকানি হিসেবে আমার প্রতি যে ভালোবাসা আর সম্মান দেখিয়েছেন তা আমি সারা জীবন মনে রাখব।’
বর্তমানে জালাল হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেছে নানা কারণে। এর আগেই এ স্থান থেকে চলে গিয়ে সালাম তার স্বপ্ন বুনেছেন গ্রামে। মুরগির খামারের পাশাপাশি স্বপ্ন দেখছেন গরুর খামার দেওয়ার এবং বাড়ির পাশেই একটি মুদি দোকান দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর।