সেলিম আল রাজ
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৩৮ পিএম
হারুন পাঠাগারের গল্পটা অন্যরকম। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য একজন চা বিক্রেতা নিজ উদ্যোগে গড়েছেন একটা পাঠাগার। যেখানে চাইলেই পড়া যায় বই, পত্রপত্রিকা। নেওয়া যায় পছন্দের বই। এতে লাগে না কোনো প্রকার জামানত। উপরন্তু পাঠকদের করানো হয় আপ্যায়ন। মাস শেষে সেরা পাঠকদের দেওয়া হয় উপঢৌকন।
নিঃস্বার্থভাবে মহতী এ কাজটা করে যাচ্ছেন হারুন পাঠাগারের কর্ণধার ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার চা দোকানি হারুন মিয়া। অভাবের তাড়নায় মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। পরিবারের হাল ধরতে ২০১২ সালে গৌরীপুর শহরে একটা ভাতের হোটেলের সামনে পাতেন চায়ের দোকান। তখনও পড়ার জন্য আকুপাকু করত তার মন। হয়ে ওঠেন চা বিক্রেতা। নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। চা পান করতে আসা বিদ্যানুরাগী কয়েকজনের বিশেষ অনুপ্রেরণায় আবারও স্বপ্ন দেখেন পড়াশোনার। ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি প্রোগ্রামে। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম শেষে রাতে পড়াশোনা করেন। ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়েন পাঠ্যবইয়ের বাইরের অন্যান্য বইয়ের প্রেমে। দিনের বেলায় চা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে পড়েন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। নিজের আগ্রহে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথোপকথনের প্রচেষ্টা করেন মাঝে মাঝে। ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে তাক লাগিয়ে দেন হারুন মিয়া। এরপর ভর্তি হন এইচএসসি প্রোগ্রামে। ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এখন তিনি বিএ প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত।
বইপ্রেমী হারুন মিয়া টানাপড়েনের সংসার সত্ত্বেও মাস শেষে দোকানদারি থেকে আসা আয়ের একটা অংশ দিয়ে শুরু করেন বিভিন্ন লেখকের বই কেনা। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া করুণ চিত্র হারুন মিয়াকে কাঁদায়। মাদকের ভয়াল ছোবল, মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে বর্তমান প্রজন্মর বইবিমুখ। উপলব্ধি করেন কীভাবে শিক্ষার্থীদের ফেরানো যায় পাঠাভ্যাসে। সে লক্ষ্য ও প্রবল আগ্রহে নিজস্ব অর্থায়নে ২০২৩ সালে গড়ে তোলেন নিজ নামে ‘হারুন পাঠাগার’। প্রথম দিকে ছিল না কোনো বুক শেল্ফ। বস্তাবন্দি অবস্থায় থাকা বইগুলো থেকে পাঠকদের তুলে দিতেন বই। একসময় একটা শেলফের ব্যবস্থা করেন। রাখেন দোকানের এক কোণে। পাঠাগারের স্লোগান করেন ‘মোবাইলের আসক্তি ছেড়ে বই পড়ুন’। শতাধিক বই দিয়ে শুরু করা হারুন পাঠাগারে বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা পনেরো শতাধিক। নিয়মিত রাখেন নয়টি স্থানীয়-জাতীয় পত্রিকা, সাময়িকী ও ম্যাগাজিন। পাঠাগার আন্দোলন পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও সমসাময়িক আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে লেখে যাচ্ছেন বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম। পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করতে নিয়েছেন বেশ কিছু উদ্যোগ।এক মাসে চার থেকে পাঁচটি বই পাঠ শেষে তার ওপর রিভিউ দিলে পেয়ে যান সৌজন্য উপহার। প্রতিবার বই পড়া ও নেওয়ার সময় পাঠাগারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় চা-বিস্কুটের ফ্রি সেবা। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বই দিবস, গ্রন্থাগার দিবস, বৃক্ষরোপণ, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারিসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদ্যাপন করেন। হারুন মিয়ার মহতী উদ্যোগের খবরে গ্রন্থকুঠির প্রকাশনার পক্ষে থেকে ৫ শতাধিক বই পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। বইবন্ধু নামে পরিচিত এমদাদুল হক খোকন হারুন পাঠাগারের মুগ্ধতায় দিয়েছেন শতাধিক বই। পাঠাগারের কার্যক্রম পরিচালনার শুরুর দিকে হারুন মিয়াকে পড়তে হয় সমালোচনায়। শিক্ষার্থীসহ অন্য বয়সিরা পাঠাগার থেকে নিয়ে যায় বই। বাড়ছে পাঠকের সংখ্যা।
ব্যতিক্রমী হারুন মিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ক্রেতাদের চায়ের সেবার ব্যাপারটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দোকানের সামনে লেখে রাখেন, ‘মাদক ছাড়ুন, চা ধরুন’। রয়েছে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। পাঠাগারে নতুন নতুন বই আসামাত্র ফেসবুকে পোস্ট করে জানিয়ে দেন। বইয়ের গায়ে দেন পাঠাগারের সিল ও নম্বর। বইয়ের পাঠক আর চায়ের ক্রেতাদের নিয়ে খুলেছেন মেসেঞ্জার গ্রুপ। এসএমএসের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া করেন চায়ের অর্ডার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে হারুন মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে চায়ের দাম রাখেন অর্ধেক। বছর শেষে সেরা চা গ্রাহকদের দেওয়া হয় সম্মাননা। ছাব্বিশ বসন্ত পার করা বেশ পরিচিত মুখ হারুন মিয়া গৌরীপুর পৌর শহরের সতিষা গ্রামের মৃত আবদুল জাব্বারের পুত্র। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ভিটেমাটি ছাড়া নেই কোনো সম্পদ। ২০২৩ সালে ক্যানসার আক্রান্ত পিতা আবদুল জাব্বারকে হারিয়ে মা আর ভাইবোনদের নিয়ে হারুন মিয়ার পরিবার।
জীবনসংগ্রামী এই যুবক চায়ের দোকান আর পাঠাগার নিয়ে ভালোই চলছিলেন। কিন্তু এ জানুয়ারিতে বন্ধ হয়ে গেছে ভাতের হোটেল। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে হারুন মিয়ার চায়ের দোকান। গৌরীপুর পৌর শহরের কালীখলা রোডে একটা দোকানে বইগুলো নিয়ে সাময়িক উঠেছেন। প্রতিদিনের মতো এখনও সকালে ওঠেন তিনি। তবে স্থানের অভাবে চালাতে পারছেন না চায়ের দোকান। ধরে রেখেছেন পাঠাগারের কার্যক্রম। মাঝে মাঝে ছুটে যাচ্ছেন স্কুলে স্কুলে বই নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন জীবনের উত্থানপতনের মধ্যে পাঠাগারের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাবেন আমৃত্যু। সমৃদ্ধ এক পাঠাগার হবে তার। বর্তমান বইবিমুখ সমাজকে করতে চান বইপ্রেমী। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বাজাতে চান বইপ্রেমের বশীকরণের বাঁশি। এসব প্রশংসনীয় কার্যক্রমের জন্য হারুন মিয়া ২০২৪ সালে পেয়েছেন প্রিয় বাংলা পাঠাগার পুরস্কার। সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিটিতে পেয়েছন সদস্যপদ। এমন হারুন মিয়ার জন্ম হোক সমাজে। ঘুণেধরা সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তির আলো হোক পাঠাগার আন্দোলন।