× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যতের পানে চেয়ে

তৌহিদুল হক

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫১ এএম

বাংলাদেশে শিক্ষার কার্যকর বা উজ্জ্বল সময় সংক্রান্ত আলোচনায় অতীতের কয়েকটি দশকের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। ছবি : আরিফুল আমিন

বাংলাদেশে শিক্ষার কার্যকর বা উজ্জ্বল সময় সংক্রান্ত আলোচনায় অতীতের কয়েকটি দশকের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। ছবি : আরিফুল আমিন

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। এছাড়াও রয়েছে পাঠ্যসূচি বদলেরও নানান চেষ্টা। সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতিতে কোনো  সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায় আমরা স্থির হতে পারিনি। এ সংকট কেন তৈরি হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস থেকে লেখা

মানুষকে জগতে বাঁচার প্রেরণা থেকে সতর্ক হওয়া ও ইচ্ছা নামক প্রেরণাশক্তি জাগ্রত করার অভিপ্রায় থেকে সর্বজনের নিমিত্ত বৈশ্বিক অপরিহার্যতা হলো শিক্ষা গ্রহণ। শিক্ষা একটি ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সবার সম্পৃক্ততার সুযোগ দেশভেদে ভিন্নরূপে বাস্তবায়নের কাঠামোয় দৃশ্যমান। একটি প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি সর্বমহলে, সর্বস্থানে বা দেশে কিংবা পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উদীয়মান হবে; তা হলো শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন। সময় ও কর্মচাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার ধরনে পরিবর্তন আনতে হয়। আবার পাঠক্রমের কাঠামো ও আয়োজনে এমন পরিবর্তন না করা যাতে শিক্ষার নৈতিক বা আদর্শিক বিষয়বস্তু মোটা দাগে পাল্টে যায়। ভাবনার এ প্রলেপ থেকে শিক্ষা, সমাজ কিংবা দেশি মেজাজে পরিচালিত করার কাঠামোগত বিন্যাসে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দৃশ্যমান করল। এ দৃশ্যের সঙ্গে মানুষ যুক্ত হলো ‘নিজেকে জানার’ অভিপ্রায় থেকে। কার্যত নিজের সামাজিক স্তর পরিবর্তনের উপায় হিসেবে শিক্ষার শক্তি ও অর্জিত জ্ঞানের ব্যবস্থা সামনে রেখে।

শিক্ষার সঙ্গে দেশি সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনধারা, মূল্যবোধ, জীবনলক্ষ্যসহ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সন্নিবেশিত হলো আধেয় নির্ধারণের মাধ্যমে। কারণ পাঠ্যসূচির আলোচনা ও আয়ত্তের মাধ্যমে একটি শিশুর মধ্যে পরিপক্বতার বীজ উন্মোচিত হয়। চারপাশের বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতা ধারণ, অনুধাবন ও চর্চায় মনোযোগী হওয়ার দীক্ষা জাগ্রত হয়। এ জাগ্রতকরণ মানুষকে বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষে পরিণত করে। শিক্ষার সামগ্রিক লক্ষ্য একই রূপ, কিন্তু চর্চা ও পাঠ্যসূচি ভিন্ন। দেশীয় বোধে উদ্বুদ্ধকরণ ও নিজ কাঠামোর আলোকে বৈশ্বিক মেজাজ নাগরিক তৈরি করার একটি কার্যকর উপায় হিসেবে মানুষ শিক্ষা নামক প্রক্রিয়াগত ব্যবস্থার কাছে নত হলো। কেউ অস্বীকার করতে পারল না। এ না পারাটাই শিক্ষার তেজ, শক্তি বা মহিমা।

শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে গিয়ে প্রস্তুতির ঘাটতি ও প্রাথমিক পর্যায়ে বহুবিধ ধরন অনুশীলন হওয়ার কারণে শিক্ষা কখনও ‘বাণিজ্য’, কখনও ‘রাজনৈতিক পণ্য’ হিসেবে দরকষাকষির কাতারে শ্রেণিবিন্যাস হয়ে মূল অবস্থান থেকে দূরে সরে গেল

শিক্ষার বৈশ্বিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচালনা পদ্ধতি, পরিবেশ বা সমাজ উপযোগী সাদৃশ্য রেখে দেশি আদলে শিক্ষার পর্যায়ক্রমিক অগ্রসরতা চলমান থাকে। এভাবে শিক্ষা বিশ্বে প্রাজ্ঞজনের আলোচনায় ঠাঁই পায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার অধিকার কোন পথে অগ্রসর হবে, কী হবে শিক্ষানীতি বা শিক্ষার আদর্শধারা তা নিয়ে আলোচনার নিরিখে এ সিদ্ধান্ত বা লক্ষ্য নির্ধারণ হলো যে, স্বাধীন দেশে নিজেদের মতো একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও সম্পৃক্তকরণ। তর্কবিতর্কের আখ্যানে তৎকালীন প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সমাজ বা রাষ্ট্রের লক্ষ্য ধারণ ও পূরণে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে একমত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা পাঠ্যসূচির সঙ্গে পরিচয়, পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও জীবনদর্শনের উপকরণগত সংশ্লিষ্টতা নির্মিতকরণের প্রচেষ্টা গৃহীত হয়। পর্যায়ক্রমে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে গিয়ে প্রস্তুতির ঘাটতি ও প্রাথমিক পর্যায়ে বহুবিধ ধরন অনুশীলন হওয়ার কারণে শিক্ষা কখনও ‘বাণিজ্য’, কখনও ‘রাজনৈতিক পণ্য’ হিসেবে দরকষাকষির কাতারে শ্রেণিবিন্যাস হয়ে মূল অবস্থান থেকে দূরে সরে গেল। শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে নিজ দেশের উন্নয়ন বা পরিবর্তনে ভূমিকা পালনকারী যোগ্য নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত অভিন্নতা প্রয়োজন। এ প্রশ্নে বাংলাদেশ হোঁচট খেল। আবার ভিন্নতা অনুযায়ী সদ্ভাব বজায় রেখে গৃহীত হলেও শিক্ষার মাধ্যমে দেশি স্বার্থ সমুন্নত রাখার ইচ্ছা ব্যক্তির মননে ক্রিয়াশীল থাকল না। এ প্রত্যাশায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে গেল।

বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাকাঠামো নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ধরা পড়ল যখন শিক্ষা অর্জিত ব্যক্তি যোগ্যতার প্রমাণে ব্যর্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যর্থ হলো শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক আচরণধারা বজায় রাখতে। পিছিয়ে পড়া বা ব্যর্থতা উভয়রূপ পশ্চাৎপদ আদলে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সময়ক্রমিক পরিবর্তনের ইচ্ছা। শুরু থেকে অমুক দেশের শিক্ষা ভালো, এরূপ ধারণা থেকে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান শিক্ষায় অনুশীলনের উপায় যাচাইবাছাই সাপেক্ষে ব্যবহার করার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেশি বাস্তবতার আলোকে নিজেদের কাঠামো নির্ধারণ ও অনুশীলনে সর্বজনসম্মত মানসিকতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন ছিল। মনে রাখা প্রয়োজন, শুরুতে সর্বজনসম্মত মানসিকতা বা গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। কিন্তু উপযোগিতা বা অর্জিত ব্যক্তির উন্নতি বা উন্নতির স্তরে পদার্পণের উদাহরণ যখন সমাজে আলোড়ন তৈরি করে তখন সবাই আস্থা রাখতে চায়।

বাংলাদেশে শিক্ষার কার্যকর বা উজ্জ্বল সময়সংক্রান্ত আলোচনায় অতীতের কয়েকটি দশকের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। কারণ শিক্ষা প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি তথা শিক্ষকের একাগ্রতা, দক্ষতা, আদর্শিক অবস্থান নিয়ে মোটা দাগে বিতর্ক ছিল না। সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজের সর্বস্তরে রাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ন্ত্রণ ও দলের মতাদর্শে অনুসারী ব্যক্তির সংযুক্তকরণ মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে শিক্ষা আদর্শিক স্থান থেকে সরে যায়। সরে কার্যত ‘পণ্য’ হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ বাস্তবতা মানুষের মধ্যে শিক্ষার সঙ্গে কর্ম, উন্নতি বা প্রচুর পয়সাপাতি উপার্জনের মতো সূচক যুক্ত করে বিবেচনা করা শুরু করে। শিক্ষার সঙ্গে নীতিসিদ্ধতার যোগসূত্র জন্মগত। শিক্ষার যাত্রাকাল পর্যালোচনা করলে দৃশ্যমান হয় যে, মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ও আলোচনার নিমিত্ত বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকারণিক মানসিকতা সৃষ্টির অভিপ্রায় আজকের কাঠামোগত গড়নে বাস্তবায়িত পাঠ্যসূচি। স্পষ্টত বিশ্বাস করা হতো সততা বা দৃঢ়তার ঘাটতি থাকলে শিক্ষা পরিচালনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার গ্রহণযোগ্যতা থাকত না। এ গ্রহণযোগ্যতা সময় ও দেশি চাহিদার কারণে পরিবর্ধন ঘটেছে। কিন্তু যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের একটি অবস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নীতিগত প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে শিক্ষায় তাদের বৈশ্বিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রয়েছে। কারণ নিজস্বতা শিক্ষার অপরিহার্য অলংকার। শিক্ষায় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কী করতে চায় তা এখনও পরিষ্কার নয়। শিরোনামে কখনও সৃজনশীল, কখনও জীবনমুখী। দেশি চাহিদা, ব্যক্তির ইচ্ছা, পরিকল্পনা ও বাজেট, কাঠামোগত সুযোগ সর্বোপরি নিজস্বতা বারবার অবহেলিত হয়েছে। এরূপ ব্যবস্থা নামে মাত্র বাঁচায়। পরিবর্তনের যোগ্য চালকরূপে মানুষের পরিবর্ধন ঘটায় না।

পরিবর্তিত পরিস্থিতি কিংবা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সৃষ্ট দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনার প্রকাশ মানুষের মনে শিক্ষাপ্রক্রিয়া নিয়ে বহুবিধ প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। তবে চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। আশার জায়গা হলো সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ কতটা সমাধানের চেষ্টা হয়েছে! এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই, যতটা মানুষ প্রত্যাশা করে।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পাস করা শিক্ষার্থীর প্রতি সমাজের আগ্রহ ছিল, যোগ্যতা নিয়ে যৎসামান্য বিতর্ক ছিল। কারণ হলো পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন, পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষক, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক ছিল না। দেশি অবয়বে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যসূচি অধ্যয়নে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা আলাদা সত্তা তৈরি হতো। সে সত্তায় নৈতিকতা, বিবেকবোধ, নিজের অবস্থান সম্পর্কে সতর্কতা ও সমাজ গ্রহণযোগ্য আচরণ উপহারে অভ্যস্ততাসহ ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি সমাজ তথা মানুষকে আশ্বস্ত করত। এখন হচ্ছে এর বিপরীত। কারণ শিক্ষাপ্রক্রিয়া পরিচালন ও পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষাবোধবহির্ভূত বিষয়ের গোপন কিংবা প্রকাশ্য সরবতা প্রশ্নের পরিসর বৃদ্ধি করেছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের যোগ্যতার প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ঠিকমতো কাজ না করলে সব আয়োজন ব্যর্থ।

  • কবি, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা