আমীরুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:৫৬ পিএম
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:১০ পিএম
ছোটবেলায় পড়া প্রিয় একটি বই। ঢাকায় একসময় ফ্রাংকলিন বুক প্রোগ্রাম নামে একটা প্রজেক্ট চালু ছিল। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমেরিকান প্রতিনিধিত্বশীল বই অনূদিত হয়ে প্রকাশ পেত। ১৯৫৭ সালে তারই আওতায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সূয্যিমামার রথে’। বইটি অনুবাদ করেছিলেন অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ। বইটির নামকরণের নিচে ক্যাপশন ছিল : জাতিসংঘের অন্তর্গত পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের গল্প ও লোককাহিনীর চয়নিকা। বইটি সম্পাদনা করেছিলেন ইংরেজি ভাষায় হ্যারল্ড কুরল্যানডার। জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির পক্ষে বইটি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি উৎসর্গ করা হয় দুনিয়ার দরিদ্র শিশুদের প্রতি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককাহিনীর সন্নিবেশ। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন এ বই আসে আমার হাতে। এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহ, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দেশসমূহের লোককাহিনীর সংকলন। সেই প্রথম দেশবিদেশের গল্পের সঙ্গে আমার পরিচয়। এ পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে কত বিচিত্র দেশ, কত বিচিত্র জাতি, কত বিচিত্র ভূগোল। গল্পগুলো পড়তাম আর বিস্মিত হতাম। একেক ভূখণ্ড সম্পর্কে ধারণা হতো। স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতাম। মনে আছে, যে গল্প বুঝতে একটু অসুবিধা হতো সেসব গল্প আমার বাবা পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিতেন। সৌদি আরবের গল্পটা আজও মনে আছে। নিউজিল্যান্ডের গল্পটা ‘আগুন আনা মাউই’। দেশের নামগুলো সেই প্রথম জানতে পারি। ইথিওপিয়া, বলিভিয়া, ইউক্রেন, ইসরায়েল, পানামা, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা কত কত দেশ। গল্পের মাধ্যমে দেশটা যেন ছবির মতো চোখে ভেসে উঠত।
সে যুগে ঝকঝকে লাইনো টাইপে ছাপা অসম্ভবসুন্দর এসব বই। ভেতরে কোনো ছবি নেই। ইনার পৃষ্ঠায় কয়েকটি বিদেশি ইলাস্ট্রেশান আছে। গল্পগুলো পড়তে যেন আরাম বোধ হয় সেই চেষ্টা করা হয়েছে। পেপারব্যাক বাইন্ডিং। হাতে নিলেই মন আনন্দে ভরে যেত।
আমার শৈশবজুড়ে আচ্ছন্ন ছিল সূয্যিমামার রথে। খুব যত্ন করে বইটি রেখে দিতাম। বিছানায় বালিশের তলায় ছিল বইটির স্থান। জীবনে সেই আদুরে বইও হারিয়ে যায়। একসময় বইটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার স্মৃতিতে রয়ে যায়। বহুজনকে বহু আসরে বহু আড্ডায় এ বইয়ের কথা বলেছি। সবাই শুনে মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু বইটার সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। বাংলা একাডেমির লাইব্রেরি থেকে শেষ পর্যন্ত বইটির ফটোকপি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। অলৌকিক অপার্থিব আনন্দ লাভ করি। যেন ছেলেবেলা ফেরত এলো। আমি শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলাম। বারবার নেড়েচেড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠি। বারবার ফটোকপি খাতা উল্টে পাল্টে দেখি। গল্পগুলো পড়তে মন চায় না। যদি ছেলেবেলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়। গল্পের শিরোনাম মনোযোগ দিয়ে দেখি। অনেক গল্পের কাহিনী মনে পড়ে গেল। মনটা আনন্দে ভরে গেল। বইটার বাংলাদেশে প্রকাশক স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স। বইটি প্রকাশিত হয় ওয়াশিংটন থেকে ১৯৫৫ সালে। ভূতপূর্ব পাকিস্তানে বাংলা অনুবাদ হয় ১৯৫৭ সালে।
ইবরাহীম খাঁ রূপকথা, লোকগল্প, কিসসা কাহিনী প্রচুর পরিমাণে লিখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি অনুবাদ করেন সূয্যিমামার রথে। স্বাভাবিকভাবে তার ভাষাভঙ্গি ছিল অসম্ভবসুন্দর। শব্দ ব্যবহারেও ছিল মুনশিয়ানা। ছোট ছোট বাক্যে তিনি গল্প গেঁথে তুলেছেন। গল্পের বর্ণনাভঙ্গি খুব নিখুঁত। অনুবাদের স্বাদগুণে গল্পের রস ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বইটির সূচনায় একটি কবিতা আছে। তারই অংশবিশেষÑ সূয্যিমামার সাথে উঠি ভোরে
ছুটবে শোঁ শোঁ মামার অগ্নিরথে
অনেক আলো আঁধার পাড়ি দিয়ে
অনেক ভোরে উঠবে উজল পথে।
এরকম নতুন স্বপ্নের পথ বেয়ে গ্রন্থিত হয়েছে বইটি।
বইটির পুনর্মুদ্রণ হওয়া খুব জরুরি। কোনো প্রকাশক কি বইটি আবার ছেপে বের করতে পারেন না?