ফারহান শাহরিয়ার
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:০৮ এএম
পারো শহরের মূল আকর্ষণ টাইগার নেস্ট
হিমালয়ের কোলে ছোট এক দেশ ‘ভুটান’। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে ভুটানকে সাজিয়েছে পাহাড়ে-নদীতে-ফুলে-ফলে। ভুটানের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার নিয়মানুবর্তিতা আপনাকে অবাক করবেই। লিখেছেন ফারহান শাহরিয়ার
আকর্ষণীয় ও নান্দনিক সৌন্দর্যের দেশ ভুটান। সুন্দর পাহাড় আর পরিপাটি শহর দেখে আপনার মন ভরে যেতে পারে। তাই কোনো এক ঝলমলে রোদে আপনি সড়কপথে বেরিয়ে পড়তে পারেন ভুটানের উদ্দেশে। ভুটান বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। এ কারণে পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে ভুটানে। এ দেশে নেই কোনো দূষণ। কার্বন নেগেটিভ দেশগুলোর মধ্যে ভুটান অন্যতম।
আকাশপথে
প্লেনে গেলে আগে থেকে ভিসার কোনো ঝামেলা নেই। কারণ ভুটানে অন অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়। তবে কোথায় কোন হোটেলে থাকবেন, হোটেল বুকিংয়ের কাগজ বা অনলাইন কপি রাখা ভালো। অনেক সময় দেখতে চায়। ভুটানের একটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যেটা পারোতে অবস্থিত। তাই আপনি ফ্লাইটে গেলে আগে পারোতে পৌঁছাবেন। চাইলে আগে পারো ঘুরে তারপর থিম্পু, পুনাখা যেতে পারেন। অথবা যদি ফ্লাইটে ফেরেন তাহলে ফেরার পথে পারো ঘুরে যেতে পারেন।
স্থলপথে ভ্রমণ
পাহাড়ের দেশ ভুটান ভ্রমণ করতে যদি বাই রোডে যেতে চান তাহলে হানিফ, শ্যামলী কিংবা এসএ পরিবহনের বাস আছে ঢাকার আরামবাগ এবং কল্যাণপুর থেকে ছাড়ে। রাতে রওনা দিলে সকালে পৌঁছবেন বুড়িমারী বর্ডারে। বর্ডার অফিসের কাজ শুরু হয় সকাল ৯টায়। ইমিগ্রেশন অফিসের কাছে প্রচুর দালাল থাকে কাগজপত্রের কাজ করে দেওয়ার জন্য। ভুলেও কোনো দালাল দিয়ে কাজ করাবেন না। আপনি যে বাসে যাচ্ছেন সেই বাসের লোকদের কিছু টাকা (১০০ টাকার মতন) দিতে পারেন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে দেওয়ার জন্য। তারপর হেঁটেই প্রবেশ করবেন ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডারে। ওখানে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে গিয়ে রুপি করে নিতে পারেন। ওরা সাধারণত ভালো রেট দেয়। আর এক্সচেঞ্জের রসিদ অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। পরে অনেক সময় দরকার হতে পারে। এবার চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁও যেতে হবেÑ বাস কিংবা ট্যাক্সি দুভাবেই যেতে পারেন। বাসভাড়া ১০০ রুপির মতো আর ট্যাক্সির সাইজ অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার থেকে ২ হাজার রুপি নেবে। তবে ট্যাক্সি ভাড়া দরদাম করে ঠিক করতে হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে শিলিগুড়ির টিকিট কাটা থাকলে আপনি ওই বাসে করেই যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে নামতে হবে ময়নাগুড়ি বাইপাস। এখানে বাসে নেমে এই প্রথম আপনাকে চড়তে হবে ভারতীয় বাসে হাসিমারা নামক স্থানে যাওয়ার জন্য। ময়নাগুড়ি থেকে হাসিমারা বাসভাড়া হবে প্রায় ৫০ রুপি। বাস থেকে নেমে যাবেন জয়গাঁও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে। এখান থেকে শুধু থিম্পু ও পারো শহর ভিজিট করার অনুমতি দেওয়া হয়। পুনাখা, গেলেফু, হাঁ ভ্যালিÑ এসব জায়গা দেখার জন্য থিম্পু থেকে আলাদা করে অনুমতি নিতে হয়।
দর্শনীয় স্থান
ভুটানে মোট ২০টি শহর আছে। আপনি যদি ১০-১৫ দিনের একটি ট্যুর প্ল্যান করেন, তবে অনেক কিছু দেখা যাবে। কিন্তু আরও কম সময়ের জন্য গেলে বিশেষ দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। পুরো ভুটানের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সৌন্দর্য এবং কালচার প্রায় একই রকমের। পাহাড়ের দেশ ভুটান ভ্রমণে আপনি যদি নিম্নোক্ত স্থানগুলো ঘুরে দেখেন তবে মানুষের জীবনযাত্রা, স্বভাব তথা পুরো ভুটান সম্পর্কেই একটা ধারণা পাবেন। স্থানগুলো হলোÑ ফুন্টশোলিং, থিম্পু, পারো, পুনাখা, গেলেফু, সমদ্রুপ ঝংকার ইত্যাদি।
ফুন্টশোলিং শহর
ইমিগ্রেশন অফিসের সব কাজ শেষ করে প্রবেশ করবেন ভুটানের ফুন্টশোলিং শহরে। শহরে প্রবেশ করেই মনটা ভালো হয়ে যাবে। কেননা ফুন্টশোলিং খুবই পরিষ্কার, ঝকঝকে একটি শহর এবং এই সুন্দর পরিচ্ছন্নতা আপনি পুরো ভুটান জুড়েই দেখতে পাবেন। আপনি বেশি সময় নিয়ে গেলে ফুন্টশোলিং শহরে একটা দিন থেকে যেতে পারেন। আর আপনার যদি পৌঁছাতে বিকাল হয়ে যায় এবং আগে থেকে হোটেল বুকিং দেওয়া না থাকে, তাহলে এখানে থেকে যাওয়াই ভালো। কেননা ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু বাসে যেতে সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। আর আগের আর্টিকেলেই বলেছিলাম ভুটানে রাত ৮টার পরে হোটেল, রেস্টুরেন্ট কিংবা দোকান আর কিছুই খোলা পাবেন না। তাই সেটা মাথায় রেখে ওভাবে প্ল্যান করবেন।
যোগাযোগের জন্য সিম
নতুন একটি দেশে যোগাযোগের জন্য, ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন তথ্য খুঁজে পেতে এবং গুগল ম্যাপ ব্যবহার করার জন্য যত দ্রুত পারেন একটি সিম কিনে ফেলুন। ভুটানের নিজস্ব একটা টেলিকম সার্ভিস আছে, যেটির নাম বি মোবাইল। এটাতে খরচ অনেক কম, কিন্তু নেটওয়ার্ক ভালো না। তাই অন্য মোবাইল সার্ভিসও নিতে পারেন।
চে লে লা
চে লে লা পাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৯৮৮ মিটার উঁচু, প্রায় ১৩০০০ ফিট এবং এটি হচ্ছে ডান্তাক রোডের সবচেয়ে উঁচু স্থান। এখানে যাওয়ার জন্য আড়াই ঘণ্টা ধরে পাহাড়ের পাশঘেঁষে একেবেঁকে আপনাকে উঠে যেতে হবে। হঠাৎ করে ঢাকার মতো সমতল জায়গা থেকে ২ ঘণ্টার ব্যবধানে এত ওপরে উঠে যাওয়ায় আমার মাথাব্যথা আর বমি বমি লাগতে লাগল। কিন্তু আশপাশের সৌন্দর্যের কাছে তা ছিল অতি তুচ্ছ। আরেকটা জিনিস যেটা চোখে পড়ার মতো তা হলো এদের রাস্তের পাশে সিমেন্টের ফলকে লিখে রাখা ড্রাইভারদের জন্য সতর্কবাণী। পাসের একদম কাছে এসে চোখে পড়ল ‘জমলহারি’র বরফাবৃত পিক। এর উচ্চতা ৭৩২৬ মিটার অথবা ২৪০৩৫ ফিট, ভুটানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পিক।
পুনাখা
পুনাখা ভুটানের পুনাখা জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র। পুনাখা ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভুটানের রাজধানী এবং সরকারের আসন ছিল, যখন রাজধানী থিম্পুতে সরানো হয়েছিল। এটা থিম্পু থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং রাজধানী থিম্পু থেকে পুনাখাতে গাড়িতে আসতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এখানের আবহাওয়া শীতকালে বেশ উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে গরম হয়। এটা সমুদ্রতল থেকে ১৩১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
মেঘে ঢাকা ধ্যানমগ্ন হিমালয় আর নীল আকাশের নিচে সবুজে ঘেরা এক রূপকথার রাজার দেশের নাম ভুটান। সামান্য একটু খরচে আপনি অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন আগুনমুখো বজ্র ড্রাগনের দেশ থেকে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, একসময় প্রকৃতি রুষ্ট হলে কালো আকাশ থেকে বজ্র বিদ্যুৎ ড্রাগনের মতোই নেমে আসত ভুটানের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে আর মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখায় হারিয়ে যেত সহস্র প্রাণ। সেই থেকে অদেখা ড্রাগনের হাত থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা জন্য ড্রাগনের পূজা করে আসছে ভুটানবাসীরা আর তার থেকেই ভুটানের নাম হয়েছে ‘ড্রুক ইউল’ অর্থাৎ ‘ল্যান্ড অব থান্ডার ড্রাগন’। গোটা দেশের জনসংখ্যা ৭ লাখ ৯৮ হাজারের কাছাকাছি। সারা পৃথিবীতে মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি দেশে রাজতন্ত্র আছে তার মধ্যে ভুটান অন্যতম। ভুটানের বর্তমান রাজা জিগমি কেসর নামগেইল ২০০৬ সালে রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ভুটানের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার নিয়মানুবর্তিতা আপনাকে অবাক করবেই।
জেনে নিন
বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ ফি কমিয়েছে ভুটান সরকার। ১০০ ডলার থেকে কমিয়ে এই ফি ১৫ ডলার করা হয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশি পর্যটকদের এখন থেকে টেকসই উন্নয়ন ফি (এসডিএফ) হিসেবে ১৫ ডলার দিতে হবে। যা ভারতীয় পর্যটকদের ওপর আরোপিত ফির সমান। বাংলাদেশের পর্যটকরা আগমনী ভিসা (ভিসা অন-অ্যারাইভাল) নেওয়ার মাধ্যমে ভুটান ভ্রমণে যেতে পারবেন। ভুটানে প্রবেশের মুহূর্তে আবেদন করে তাৎক্ষণিকভাবে এই ভিসা পাওয়ার বিধান থাকলেও বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতেই ভিসার আবেদন করা উচিত। কেননা প্রবেশকালীন অন-অ্যারাইভাল ভিসা প্রক্রিয়াকরণের মুহূর্তে দীর্ঘ সময় যাবৎ অপেক্ষা করতে হয়। সবকিছুতে খরচ আরও কমাতে চাইলে অফ সিজনে ঘুরতে যাওয়া উত্তম। এর জন্য অক্টোবর, নভেম্বর, মার্চ ও এপ্রিল এই চার মাস বাদ দিয়ে ভ্রমণ করা যেতে পারে।