× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে সুন্দরবন

সাধন সরকার

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:২২ এএম

আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫১ পিএম

জোয়ারের সময় ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে জেলেদের বড় একটি অংশ সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করে। প্রবা ফটো

জোয়ারের সময় ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে জেলেদের বড় একটি অংশ সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করে। প্রবা ফটো

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে সামনের সুন্দরবন দেখা যায়। মাঝখানে মালঞ্চ নদ। বেলা প্রায় ১টা। কেবল মালঞ্চ নদে জোয়ার আসা শুরু হয়েছে। উপকূলের জীবনব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজে গিয়েছি। শুরুতেই সুন্দরবন দর্শনের পরিকল্পনা মাথায় ছিল না! কিন্তু সময় ও সুযোগ মিলে যাওয়ায় হাতছাড়া করিনি। 

জোয়ার এলেই জেগে ওঠে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের মানুষ। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, নারী, যুবক-বৃদ্ধ সবাই যেন প্রাণশক্তি ফিরে পায়। গ্রামের বাঁধের রাস্তার নিচ পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে। ছোট ছেলেমেয়েরা এ সময় বড়দের সঙ্গে আটল (কাঁকড়া ধরার যন্ত্র), নেট ও চায়না জাল নিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দলবেঁধে জোয়ারের পানিতে লাফালাফি করে। জোয়ারের সময় কেওড়া গাছ থেকে কেওড়া সংগ্রহ করতে দেখা গেল দুরন্তপনায় মেতে থাকা শিশুদের। 

জোয়ার এলে নেট ও চায়না জাল নিয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই

জোয়ারের সময় ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে জেলেদের বড় একটি অংশ সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করে। রীতিমতো মাছ ধরার উৎসব! জোয়ারের সময় সুন্দরবন তলিয়ে যায়। এ সময় সুন্দরবনের ভেতরে প্রবেশ করে কাঁকড়া, চিংড়ির পোনা ও সাদা মাছ ধরে জেলেরা। আবার সুন্দরবনের বাইরের অংশে অনেকে মাছ ধরে। পুরুষের সঙ্গে নারীরাও সমানতালে মাছ ধরে। 

এলাকায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার কম। অল্প লেখাপড়া করেই অধিকাংশ যুবক মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়! স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পেশা পূর্বপুরুষের থেকে পাওয়া! সুন্দরবন তাদের কাছে জীবনজীবিকার উৎস। কাঁকড়া আর চিংড়ির পোনা ধরে দিব্যি সংসার চলে যাচ্ছে। অনেক পরিবারে মা-বাবা ও সন্তান সবাই মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত জেলেরা মাছ ধরে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পান। তবে ভাগ্য ভালো থাকলে বেশিও জোটে। এখানকার ছোট ছোট শিশু ও নারীরা কাঁকড়া আর চিংড়ির পোনা ধরার সঙ্গে যুক্ত। 

মালঞ্চ নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মাছের আড়ত। স্থানীয়ভাবে সুন্দরবনের মাছের ওপর নির্ভর করে জমজমাট থাকে এ বাজার। প্রায় প্রতিটি পরিবারে একটি করে ছোট ডিঙি রয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকা চালাতে ও আটল দিয়ে মাছ ধরতে পারে। অনেক পরিবার রান্না করার জন্য সুন্দরবন থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে। তবে বিপত্তি ঘটে যখন মাছের প্রজনন ও ডিম ছাড়ার মৌসুমে সরকারি আদেশে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। অনেক জেলে সে সময় ধারদেনা করে সংসার চালান।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মাঝিকে ১৫০ বা ২০০ টাকা দিলেই সুন্দরবনের ওপার থেকে ঘণ্টাব্যাপী ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে একজনকে পেয়ে গেলাম। আবদুস সালাম। বয়স ৪৫। বৃষ্টি আসতে পারে দেখে তিনি বাড়ি থেকে ছাতা সঙ্গে এনেছেন। বুড়িগোয়ালিনী নদীর পার থেকে সুন্দরবনের কিনারে যেতে ঘড়ি ধরে মাত্র ৩ মিনিট লাগল। মাঝি সুন্দরবনের গল্পগাথা বলে চলেছেন। সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্প শুনে যাচ্ছি। গা ছমছম করছে! আগেই বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের বাঘবিধবাদের কাছ থেকে বাঘের আক্রমণের গল্প শুনেছি। মালঞ্চ নদ পার হয়ে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে বাঘের আক্রমণের কাহিনীও আছে। মাঝি সুন্দরবনের কিনার দিয়ে নৌকা চালাচ্ছেন। পাশেই শিশু ও বয়স্করা সুন্দরবনের ভেতরে কাঁকড়া ধরছে।

দুই খুদে কেওড়া সংগ্রহকারী

হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। ছাতা মানাচ্ছে না। কোনোমতে হাতের ক্যামেরা রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছি! ছলাৎ ছলাৎ শব্দে হালকা ঢেউ খেলা করছে। মুষলধারে বৃষ্টি পুরো বন ভিজিয়ে দিয়ে গেল। মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টির কারণে আলো-ছায়ার সংমিশ্রণে গোধূলির মতো পরিবেশ! মাঝি একটা গামছা মাথায় দিয়ে ভিজেই চলেছেন। ঠান্ডা লাগছে কি না জিজ্ঞেস করতেই দুই ঠোঁট চওড়া করে জানিয়ে দিলেন এটা তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। অজান্তেই কখন যে ভিজে গেছি টের পাইনি। এ ভেজায় অন্য রকম একটা আনন্দ। সুন্দরবনের বৃষ্টি বলে কথা! 

মাঝি জানালেন, সুন্দরবন পানিতে তলিয়ে গেলে বাঘেরা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়। এ সুযোগে জেলেরা বনের গভীরে গিয়ে মাছ ধরে। আর ভাটার সময় সুন্দরবনসংলগ্ন নদী ও খাল থেকে চিংড়ির পোনা ধরে। হঠাৎ চোখে পড়ল অনেকটা কাঁচা মরিচের মতো দেখতে খলিশা ফুল। মাঝি জানালেন, এ ফুল থেকে মধু হয়। স্বাদই অন্য রকম। এ ফুলকে সুন্দরবনের ‘হানি প্ল্যান্ট’ বলা হয়। এটি একমাত্র সুন্দরবনেই দেখা মেলে। মধু সংগ্রহের মৌসুমে মৌয়ালদের উপস্থিতি হয় ব্যাপক। চারপাশে নানা ধরনের গাছ, লতাপাতা। কোনটা রেখে কোনটা দেখি! গোলপাতাগুলো মাথা তুলে তার অবস্থান জানান দিচ্ছে।

বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেল। একটু স্বস্তি পেলাম। মাঝি বনের কিনার দিয়ে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছেন আর সুন্দরবনের গল্প শোনাচ্ছেন। জানালেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখনকার প্রজন্মের অনেকে মাছ ধরা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছে। 

তার ভাষায়, সুন্দরবনের মায়ায় পড়ে গেলে কেউ নাকি আর অন্য পেশায় যেতে পারে না! বনে ছোট ছোট খাল বা চ্যানেল আছে। ছোট নৌকা নিয়ে অনায়াসেই প্রবেশ করা যায় বনে। মাঝি নৌকা বনের ভেতরে প্রবেশ করালেন। ভয়ে যেন কুঁকড়ে যাচ্ছি! বনের খানিক ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি একটু দূরে দূরে আটল পেতে কাঁকড়া ধরছে ছেলেরা। মাঝি ‘হুঁ’ করে একটা শব্দ করতেই বাকিরা হুঁ করে ফিডব্যাক দিল। বুঝলাম এটা ওদের অবস্থান জানানোর সংকেত। বনের মধ্যে জেলেদের অবস্থান দেখে একটু স্বস্তি পেলাম তবে ভয় কমল না। এত ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে বনের মধ্যে মাছ ধরেনÑ জিজ্ঞেস করতেই মধ্যবয়সি এক জেলে জানালেন, পেটের টান বাঘের ভয় মানে না। কুমির, সাপ আর ডাকাতের ভয় রয়েছে এ বনে। 

অল্প লেখাপড়া করেই সুন্দরবনের আশপাশের অধিকাংশ তরুণ মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়

অবাক করা ব্যাপার হলো ৮-১০ বছরের ছেলেরা আটল দিয়ে কাঁকড়া ধরছে। মহিলারাও মাছ ধরছেন। কোনো কোনো সময় তারা সুন্দরবনের ভেতরে আটল ও নেট রেখে আসেন। একজনের জায়গায় অন্যজন সাধারণত মাছ ধরে না। জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকে। চারপাশের বৃক্ষগুলো জলে ভাসছে! কাঠবাদাম ফলের মতো দেখতে বাইন গাছের ফলগুলো বেশ আকর্ষণীয়। যতই বাঘের কথা মনে পড়ছে ততই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। একবার যদি সত্যি সত্যি বাঘ আসে আর রক্ষা নেই! ভয়ে যেন দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়! দ্রুতই মাঝিকে বললাম বন থেকে নৌকা বের করতে। বনের বাঘের থেকে মনের বাঘে আমাকে যেন শেষ করে দিচ্ছিল!

বনের ভেতরে ১৫ মিনিটের মতো। বেরিয়ে বুড়িগোয়ালিনীর তীরের দিকে খুব ধীরগতিতে নৌকা এগিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ যদি সুন্দরবনের কাছে থাকতে পারতাম! মাঝি জানালেন, সুন্দরবন তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তার দান। স্থানীয় মানুষের জীবনজীবিকার রক্ষাকবচ। 

মজার ব্যাপার হলো ছোট ছোট গাছ কাটলে প্রাকৃতিকভাবে গাছ জন্ম নেয় বনে। ভাটার সময় বুড়িগোয়ালিনীর তীর থেকে ওপারের সুন্দরবনের চরে বানর ও হরিণ দেখা যায়। শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের হাজার হাজার জেলে সুন্দরবন ও আশপাশের নদ-নদী থেকে কাঁকড়া, চিংড়ির রেণু, মাছ, কাঠ, মধু আহরণ করে থাকে। এক কথায়, সুন্দরবন ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা