নাকিব নিজাম
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪৪ পিএম
মেঘের ভেলা, কুয়াশা, হিমশীতল বাতাস, পাহাড় আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য সাজেকে মিলেমিশে একাকার ছবি : মেঘপুঞ্জির সৌজন্যে
কেউ তাকে বলে মেঘের দেশ। কেউ বলে মেঘবালিকা। মেঘের রাজ্যও বলে কেউ কেউ। মেঘের ভেলায় ভাসা আলাদা এক স্বর্গীয় রাজ্যই সাজেক ভ্যালি। যে নামেই ডাকি না কেন তাতে সাজেকের রূপ যৌবনে ভাটা পড়ে না। সেই মায়াবী সাজেক এখন সেজেছে নতুন রূপে
পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসা আর এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে যে কয়টা নাম মাথায় আসে, এর মধ্যে নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম বেছে নেওয়া যায় সাজেক ভ্যালিকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৮০০ ফুট ওপরে অবস্থিত সাজেক ভ্যালি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য আদর্শ স্থান এবং এখানে বিদ্যমান সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যটকদের মূল আকর্ষণের কারণ।
চাঁদ থেকে চাঁদের গাড়ি, মেঘ থেকে মেঘের চাদর- এ দুটোরই দেখা মিলবে মেঘের রাজ্যখ্যাত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন সাজেক ভ্যালিতে। আঁকাবাঁকা পথ আর এলোমেলো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সুবিন্যস্ত পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে সাজেক ভ্যালিতে পৌঁছে যাবেন, টেরও পাওয়া যাবে না। লিখছি চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পর্যটনকেন্দ্র সাজেক ভ্যালির কথা। ভোরের সতেজ বাতাস, সকালের কোমল রোদ, খুব কাছ থেকে মেঘদের আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া, সীমানার বাইরে যতদূর চোখ যায় শুধুই আকাশচুম্বী সবুজ পাহাড়, আদিবাসীদের আন্তরিকতা এবং আঁধার নেমে এলে নীল আকাশে, ছায়াপথের আনাগোনা এসব কেবল একটা জায়গা থেকেই উপভোগ করা গেলে বিষয়টা নেহাত মন্দ নয়। আর তাই মেঘের সাগরে ভেসে থাকতে পর্যটকরা বারবার ছুটে যান মেঘের দেশখ্যাত সাজেক ভ্যালিতে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা রাঙামাটির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মিয়ানমার-মিজোরাম বর্ডারের পাশ ঘিরে অবস্থিত সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন। ২০১০ সালের আগে এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা মোটেও উন্নত ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বর্তমানে এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা এতটাই উন্নত, এক দিনে সাজেক ঘুরে চলে আসা যায়। তবে পাহাড়চূড়া থেকে রাতের আকাশ না দেখলে যেন জীবনের ষোলোআনাই বৃথা। সাজেক ভ্যালি যাওয়ার পথ দুটি।
একটি চলে গেছে রাঙামাটি দিয়ে, অন্যটি খাগড়াছড়ি হয়ে। দ্বিতীয় পথটি সহজ এবং নিরাপত্তার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ বলে পর্যটকদের আনাগোনাও এখান দিয়েই বেশি। চাঁদের গাড়িতে সাজেক যাত্রায় ভোরের সতেজ বাতাস আপনাকে আলিঙ্গন করে নেবে, পথ চলতে চলতে পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের হাত নেড়ে জানানো উষ্ণ অভ্যর্থনা করে তুলবে বিমোহিত। রুইলুইপাড়ায় থাকার বাহারি ব্যবস্থা, মনোরম পরিবেশনায় পাহাড়ি খাবার, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভাঙা গলায় দারুণ গান, কংলাকপাড়া অর্থাৎ সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে দেখা সূর্যাস্ত কিংবা ভোরের সূর্যোদয়, রাতের নিস্তব্ধতা, রাতের আকাশে অগণিত নক্ষত্রের মিলনমেলা উপভোগ করার পাশাপাশি যে বিষয়টা বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়, সেটা হলো দুপুরে দেখে আসা সবুজ পাহাড়গুলোর খুব সকালে শুভ্র মেঘের চাদরে ঢেকে যাওয়া।
মাটিতে দাঁড়িয়ে মেঘ ছুঁতে পারার চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে?
সাদা মেঘের চাদরে ঢেকে থাকা দৃশ্যের দিকে চোখ বুলালে মনে হবে এ যেন অন্য এক পৃথিবী, যা শহরের যান্ত্রিক কোলাহল এবং দূষণ থেকে কয়েক শতগুণ মুক্ত। উৎসুক মনকে কি প্রশ্ন করা যায় মেঘেদের ওপর পা দুলিয়ে ঝুলতে কেমন অনুভূত হবে? হ্যাঁ, এরও সমাধান রয়েছে সাজেকে। সুযোগ রয়েছে মেঘের ওপর দোলনায় বসে পা দোলানোর সুযোগ। মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিদের দেখে নিজেকে মনে হবে মুক্তবিহঙ্গ। সাজেকের পথ ধরে হাঁটলে মনে হবে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছি, যে পথ পিচঢালা।
এই পথ ধরে ৪৫ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে সিপ্পু পাহাড়ে অবস্থিত কংলাকপাড়া। সিপ্পু পাহাড়, যেটি শুধু সাজেকেরই নয়, পুরো রাঙামাটি জেলার সর্বোচ্চ পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু। ছোট এই পাহাড়টিতে বসবাস করেন ‘পাংখো’ আদিবাসীরা। তারা টুকটাক বাংলা বলতে পারলেও ইংরেজিতে বেশ দক্ষ। কংলাকপাড়ায় রয়েছে সুস্বাদু লাল পেয়ারা, কলা, জাম্বুরা। পাহাড়ি মরিচের কথা না বললেই নয়। এত ঝাল, বলার বাইরে। সাজেকের দুঃখ হলো ‘লুসাই পাহাড়’। সাজেকের দুই পাশে রাস্তায় তাকালে যেদিক দিয়ে সূর্যোদয় হয় সেপাশে দেখা যাবে ছোট ছোট অনেক পাহাড়ের পরে দূরে বিশাল এক পাহাড়, এটাই লুসাই পাহাড়।
সাজেক ভ্রমণের সেরা সময়
বর্ষার পর শীতের আগে শরৎ-হেমন্ত (আগস্ট-নভেম্বর) ভ্রমণের জন্য সেরা সময়। তখন প্রচুর মেঘ পাওয়া যায়। এ ছাড়া সারা বছরই ভ্রমণ করা যায়।
সেনাবাহিনীর এসকর্ট কখন শুরু হয়?
দীঘিনালা থেকে বেলা ১১টা এবং ৩টায় এসকর্ট শুরু হয়। সাজেক থেকেও একইভাবে সকাল ১০টা এবং বেলা ৩টায় এসকর্ট শুরু হয়। এসকর্ট ছাড়া একা যাওয়া যায় না। মনে রাখবেন, বিকালের এসকর্ট মিস হলে সেদিন আর যেতে পারবেন না।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যাওয়া-
না। খাগড়াছড়ি থেকে জিপ/সিএনজি/বাইক রিজার্ভ করে যেতে হবে। ২-৬ জনের গ্রুপ হলে অন্য কোনো গ্রুপের সঙ্গে মিলে জিপ রিজার্ভ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
নিজস্ব গাড়ি বা বাইক নিয়ে যাওয়া যায়?
যাওয়া যায়। তবে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকলে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে না যাওয়াই উত্তম। বাইকে যাওয়া যায় যদি নিজের চালানোর ওপর ভরসা থাকে। মনে রাখবেন, খাগড়াছড়ির পর আর কোনো ফিলিং স্টেশন নেই।
সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ-প্ল্যান
প্ল্যান-১ : ঢাকা থেকে রাতের বাসে খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়িতে থেকে জিপ ভাড়া করে সকালের এসকোর্টে সাজেক। যতদিন ইচ্ছা থেকে সকালের এসকোর্টে খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়িতে সব পর্যটন স্পট ঘুরে রাতের বাসে ঢাকা।
প্ল্যান-২ : ঢাকা থেকে রাতের বাসে খাগড়াছড়ি। জিপ ভাড়া করে খাগড়াছড়ির সব পর্যটন স্পট দেখে বিকালের এসকোর্টে সাজেক। যতদিন ইচ্ছা থেকে সকাল বা বিকালের এসকোর্টে খাগড়াছড়ি এসে বাসে ঢাকা।
প্ল্যান-৩ : ঢাকা থেকে রাতের বাসে খাগড়াছড়ি বা দীঘিনালা।
দীঘিনালা থেকে জিপ ভাড়া করে সাজেক। যতদিন ইচ্ছা থেকে খাগড়াছড়ি আসা। খাগড়াছড়িতে সব পর্যটন স্পট ঘুরে রাতের বাসে ঢাকা।
সাজেকে বর্তমানে গড়ে উঠেছে শত শত রিসোর্ট, যার কোনোটি বাংলাদেশ ভিউয়ের আর কোনোটি মিজোরাম ভিউয়ের। উল্লেখযোগ্য রিসোর্টগুলোর মাঝে রয়েছে রিসোর্ট রুংরাং, সাজেক রিসোর্ট, রুন্ময় রিসোর্ট, মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট, মেঘ মাচাং রিসোর্ট, লুসাই কটেজ, জুমঘর ইকো রিসোর্ট, সাম্পারি রিসোর্ট, আদ্রিকা ইকো রিসোর্ট, ট্রিনিটি রিসোর্ট, মেঘাদ্রি ইকো রিসোর্ট, রুলুই রিসোর্ট, ছায়ানীড় ইকো রিসোর্ট, ম্যাডভেঞ্চার রিসোর্ট, চাঁদের বাড়ি রিসোর্ট।
সাজেকে থাকার রিসোর্ট
সাজেকে ছোট-বড় মিলিয়ে বিভিন্ন কোয়ালিটির ১০০টির মতো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টে সর্বনিম্ন জনপ্রতি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ভাড়া পড়বে। শুক্রবার বা সরকারি ছুটিতে যেতে চাইলে কমপক্ষে ১৫-২০ দিন আগে রুম বুকিং করে রাখা ভালো। নইলে ভালো রিসোর্টে রুম পাওয়া যায় না। রিসোর্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রিসোর্টের কোয়ালিটি ও অবস্থানকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভিউ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সব রিসোর্ট থেকেই কমবেশি ভিউ পাওয়া যায়। রিসোর্ট থেকে বের হলে ভিউ তো আছেই।
রিসোর্টের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিছু রিসোর্ট আছে সাজেকের বাইরে। আবার কিছু রিসোর্ট এমন একটা অবস্থানে যেখান থেকে মূল পয়েন্টে আসতে অনেক বেশি সময় নষ্ট হবে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় রিসোর্টের ভিউ তুলনামূলক ভালো, কিন্তু ইন্টেরিয়র ও ওয়াশরুম বেশ জরাজীর্ণ। তাই রিসোর্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ইন্টেরিয়র কোয়ালিটি ও স্থানকে প্রাধান্য দিন।
এছাড়াও রিসোর্ট বুকিং করতে যোগাযোগ করতে দেখুন- www.resortsbd.com/
বাজেট ট্রিপে সাজেক ঘুরে আসতে বিস্তারিত দেখুন এই লিংকে- সাজেক ভ্রমণে টিজিবি- www.facebook.com/events/619938860562804/