শামীম মিয়া
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৩৪ পিএম
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫৭ পিএম
মাধবদীর বালাপুর এলাকার মাঠে রোদে শুকাতে দেওয়া লালসালু। পাখির চোখে দেখা ছবি : আরিফুল আমিন প্লাবন
নরসিংদীর মাধবদী বাসস্ট্যান্ডে নামার পরই স্পষ্ট হয় হাটের মাহাত্ম্য। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কাপড় বহনকারী শত শত ট্রাকে বিশাল বিশাল কাপড়ের গাঁইট উঠছে, নামছে। কুলিদের ব্যস্ততা। লোড শেষে গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। আবার কোনো কোনো পাইকার কাপড়ের গাঁইট বুকিং দিতে ধরনা দিচ্ছেন বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে। নিত্যদিনকার এ দৃশ্য-দেশের অন্যতম বৃহৎ কাপড় বিকিকিনির পাইকারি হাট মাধবদীর বাবুরহাট-শেখেরচরের।
রাজধানী শহর থেকে এ হাটের অবস্থান ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং নরসিংদী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে। সপ্তাহের তিন দিনব্যাপী বসা হাটের চিত্র আরও বিশাল ও জনাকীর্ণ।
বৃহস্পতি থেকে শনিবার প্রায় সারা দেশ থেকে আসা পাইকারদের উপস্থিতিতে মুখর থাকে বাবুরহাট-শেখেরচর। এই হাটের কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে যেন ছড়িয়ে থাকে রঙের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের টানে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে। যখন রাতের চরাচরজুড়ে দখল করে নেয় নিস্তব্তা, ঠিক তখনও এ হাটে চলে হাঁকডাক। ক্রেতা-বিক্রেতার দরদামে মুখর থাকে সারাক্ষণ।
নলীতে সুতা ভরা হচ্ছে
এই হাটের বেচাকেনা দেখে বিস্ময় লাগে। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। তাদের কাছে রাত-দিনের কোনো তফাত নেই। দোকানের সামনে ভ্যানের লম্বা লাইন। সরু রাস্তায় যেন কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। যত মানুষ তত বিকিকিনি। এ কথা বাস্তবে রূপ নেয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পাড়ে গড়ে ওঠা এই মোকামের বিক্রি-বাট্টা দেখে। তিন দিনব্যাপী এক হাটের হিসাব মেলাতে মেলাতে ঘুরে আসে নতুন হাটের ক্ষণ। দম ফেলবার ফুরসতই-বা কোথায়। কাপড় তৈরির কারিগর, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, খাবারের রেস্তোরাঁ, আবাসন হোটেল মালিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের পেশা-শ্রেণির মানুষ নির্ভর করে মূলত এই হাটের ওপর। এই হাটের মন্দাভাব হলে এদের জীবিকায় টান পড়ে।
দেখা হলো তাঁতপল্লী
যাদের তৈরি কাপড়ের কদরে প্রসিদ্ধস্থান হয়ে উঠেছে বাবুরহাট। এই হাটের আশপাশেই রয়েছে তাঁতপল্লী। সেই বুননশিল্পীদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে যাই বালাপুর ও মেঘনা বাজার এলাকায়। এমনকি এ জেলার প্রায় জায়গাতে রয়েছে সুতা থেকে কাপড় তৈরির কারখানা পাওয়ার লুম। অর্থাৎ যন্ত্রচালিত তাঁত। আগে হাতে তাঁত চালিয়ে সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হতো। সময়ের পরিক্রমায় মেশিনচালিত তাঁতে চলে কাপড়ের বুনন। দিনরাত খটাস খটাস শব্দে সুতা থেকে তৈরি হয় নিখুঁত কাপড়।
কাপড়ের রঙ করছেন এক শ্রমিক
ডাইং কারখানায় নিয়ে সেগুলো পছন্দমতো রঙ করা হয়। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে কাপড় যায় হাটে। শুধু নরসিংদীতেই নয়, পাশের গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ জেলাতেও গড়ে উঠেছে হাজার হাজার তাঁতকল।
তাঁতশ্রমিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীত মৌসুমে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, থ্রিপিসসহ অন্যান্য কাপড় বিক্রি কম হয়। বলা চলে শীত ‘অফ সিজন’ তাদের জন্য। তাতে কি! প্রকৃতিতে শীত নামার আগে থেকে এ অঞ্চলের তাঁতিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন লালসালু তৈরিতে। শীত নিবারণে লেপের ওয়ারসহ নানারকম কাজে ব্যবহার হয় বিশেষ এই কাপড়। যেটি লালসালু নামে সমধিক পরিচিত। প্রথমে তারা গ্রে কাপড় তৈরি করে। ডাইংয়ের মাধ্যমে রঙ করে রোদে শুকানো। ক্যালেন্ডার করে কাটিং করা। তারপর ২০ থেকে ৪০ গজের ভাঁজ করে প্রতিষ্ঠানের সিলমোহর লাগানো হয়। এরপর সেই কাপড় বিক্রির জন্য পৌঁছে যায় হাটে। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। মাঠে মাঠে শুকাতে দেওয়া হয়েছে কাপড়। সবুজ মাঠ যেন লালজমিন। কথা হয়, গ্রে কাপড় তৈরির কারিগর শাওন খন্দকারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, শ্রমিকরা গজ প্রতি দুই টাকা করে মজুরি পান। বিদ্যুৎ ঠিকঠাক থাকলে একজন কারিগর সপ্তাহে ছয়-সাত হাজার টাকা আয় করেন।
সিলমোহরের জন্য কাপড় ভাঁজ করা হচ্ছে
শ্রমিকদের জন্য সময়টি অনুকূলের হলেও লালসালুর ব্যবসায়ীদের এ বছরে যেন একটু টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বংশপরম্পরায় ব্যবসা তুহিন মিয়ার। তিনি জানালেন, ব্যবসা ধরে রাখতে হয়, তাই আছি। সুতার দাম বেশি। শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য খরচ বেড়ে চলছে দিনকার দিন। শীতের ২-৩ মাস লালসালুর চাহিদা থাকলেও পরে ওই রকম সারা পাওয়া যায় না। তাই সালু কাপড়টা আমরা সিজনাল হিসেবেই করে থাকি।
হাটের গোড়াপত্তন
প্রাচীন যুগ থেকেই এ অঞ্চল বস্ত্রশিল্পের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল। আদি মসলিনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা-সোনারগাঁও মহেশ্বরদী পরগনার গোটা অঞ্চল। বর্তমান নরসিংদী জেলা মহেশ্বরদী পরগনার অন্তর্ভুক্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। শেখেরচর-বাবুরহাটে পাইকাররা শুরুতে নদীপথে যাতায়াত করতেন। পরে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মমিন মোটর কোম্পানি নরসিংদী-তারাব সড়কেও তাদের পরিবহন ব্যবসা শুরু করে। পাশাপাশি নরসিংদী-মাধবদী-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে পাইকাররা সড়ক ও রেলপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন করতে শুরু করে। নদী-সড়ক-রেলপথ একসঙ্গে চালু থাকার কারণে বাবুরহাটের ব্যবসায়ের পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকে। রেলপথটি বন্ধ হয়ে গেলেও ব্যবসায়ীদের যাতায়াত কমেনি শেখেরচর-বাবুরহাটে।
বাবুরহাটের কাপড়ের দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতা
বর্তমানে দেশের পাইকারি কাপড় বলতে নরসিংদীর বাবুরহাটের মোকাম। বড় বড় কাপড় বিক্রির কোম্পানিগুলো এখান থেকে কাপড় না কিনলে যেন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন। এ হাটের কাপড় তাদের দোকানে থাকতেই হবে। এই হাট ঠিক কবে থেকে শুরু হয়! এ বিষয়ে কথা হয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক গোলাম মোস্তফা মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানালেন, বর্তমান শেখেরচর থেকে দক্ষিণে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাধবদী গ্রাম। এই গ্রামেই ছিল তাঁতবস্ত্র বেচাকেনার প্রথম হাট। ১৯৩৬ সালে এই হাট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাধবদীর তৎকালীন জমিদার গোপাল গুপ্ত রায়, বিষাদ গুপ্ত, শৈলেন্দ্র গুপ্ত রায়। এখানে তাদের পাঁচ-ছয় পুরুষ ধরে জমিদারি ছিল। তারা কলকাতায় থাকলেও তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি দিয়ে খাজনা আদায়ের মাধ্যমে চলত হাটের কার্যক্রম। হাট জমজমাট হয়ে উঠলে তাদের প্রতিনিধিরা আচমকাই খাজনা বাড়িয়ে দিলেন। তখন শেখেরচরের জমিদার হলধর সাহা, স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সুন্দর আলী গান্ধী ও বালাপুরের জমিদার কালীচরণ সাহা মিলে শেখেরচরে আরেকটি নতুন হাট প্রতিষ্ঠা করেন। শেখেরচরের প্রথম নাম ছিল ‘ ইমামগঞ্জের হাট’।
শেখেরচর-বাবুরহাট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু ঘরমালিকদের সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেওয়ার মধ্যদিয়ে চলছে এই হাট। এই হাটের ব্যবসায়ীদের গুনতে হয়নি কোনো অতিরিক্ত খাজনা বা টোল। হাটের ছোট-বড় প্রায় পাঁচ/ছয় হাজারের মতো কাপড় বিক্রির দোকান রয়েছে। দেশের কাপড়ের চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয় এই হাটের কাপড় থেকে। বছরজুড়ে বাবুরহাটে প্রতি সপ্তাহে গড়ে অন্তত আটশ থেকে এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে জানা যায়। কিংবদন্তি হয়ে ওঠা হাটকে কেন্দ্র করে নরসিংদীসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় গড়ে উঠেছে লাখো তাঁতশিল্প। আর এসব তাঁতশিল্পে উৎপাদিত হয় বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এসব কাপড় বাবুরহাটে নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। একেক ধরনের কাপড়ের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা পট্টি; যেমন- লুঙ্গি, মশারি, লট, গামছা পট্টি ইত্যাদি।
হাটে গজ কাপড় নিয়ে যাচ্ছেন এক চালক
শেখেরচর-বাবুরহাট বণিক সমিতির তথ্যমতে, ইতিহাস ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নরসিংদীর শেখেরচর-বাবুরহাট বাজারটির আয়তন প্রায় ০.৩০ বর্গকিলোমিটার। তবে আয়তন প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা। নরসিংদী ও আশপাশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাওয়ার লুম কারখানা রয়েছে। তবে এখনও চোখে পড়ে অল্প কিছু হাতে বোনো তাঁত। হস্তচালিত তাঁতশিল্প এ অঞ্চলের শত বছরের ঐতিহ্য। যার উৎপাদিত কাপড়ের বিক্রি হয় শেখেরচর-বাবুরহাটে। শেখেরচর-বাবুরহাট বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. বোরহান উদ্দিন জানান, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়। বর্তমানে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে বাজারের পরিধি ও দোকানের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অত্যন্ত নিরাপত্তার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন জেলা থেকে আগত ক্রেতা-বিক্রেতারা মালামাল বেচা-কেনা করার সুযোগ পাচ্ছে।’
প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত শেখেরচর-বাবুরহাট তার দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারাবাহিকতায় প্রায় সারা দেশের মানুষের তাঁতবস্ত্রের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। লালসালু, সুতি, গামছা, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, শার্ট পিস, প্যান্ট পিস, পাঞ্জাবির কাপড়, থান কাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, বিছানার চাদর, জামদানি, কাতান, বেনারসি, নাইট কুইন, দেশি জর্জেট, লেজার জর্জেট, জাপানি সিল্ক, টাঙ্গাইল শাড়িসহ দেশীয় প্রায় সব ধরনের কাপড় পাওয়া যায় এই হাটে। শুধু পাইকারিই নয়, খুচরা গ্রাহকদের কাছেও বিক্রি হয় কাপড়। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এবং সব ধরনের দেশীয় কাপড় একসঙ্গে পাওয়ার সুবিধার কারণে সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা কাপড় ব্যবসায়ীরা আসে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে দাঁড়ানো ট্রাকে শ্রমিকরা কাপড় তুলছেন
হাটের দিন অলি-গলিজুড়ে পাইকারি ক্রেতাদের ভিড় বাবুরহাটের এই চিত্র সারা বছরের। দুই ঈদে এই ভিড় হয় এর পাঁচ গুণ। পাইকারেরা হাটের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দরদাম করে পছন্দমতো কাপড় কেনেন। তারপর একসঙ্গে গাঁইট বেঁধে আনেন আড়তে। সেখানে সব ধরনের কাপড় জমা হওয়ার পর একত্র করে এক বা একাধিক বড় গাঁইট বেঁধে নেন পাইকাররা। তারপর ভ্যানে করে এসব গাঁইট চলে যায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে রাখা ট্রাক, লরি বা পিকআপ ভ্যানে। হাটের দিনগুলোতে শত শত ট্রাক বোঝাই কাপড় চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ অঞ্চলে পলিয়েস্টার, টিসি, কটন, ডেনিমসহ যাবতীয় সুতার আইটেমের পাইকারি ও খুচরা বাজার মাধবদীর এই সুতার হাট। দেশের প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউসগুলো বাবুরহাটের কাপড় দিয়েই অধিকাংশ গ্রাহকের চাহিদা মেটায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য জেলার পাইকাররা মোকাম করতে আসেন এখানে। তাঁতশিল্পকে ঘিরে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ জেলার বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে শতাধিক সহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
লেখক : প্রতিবেদক, নরসিংদী