বাংলাদেশ থেকে অ্যান্টার্কটিকার পথে-৯
মহসিনুল হক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:০৫ পিএম
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:৩২ পিএম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে
পৃথিবীর দক্ষিণতম প্রান্তের মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। বিশাল এ নির্জনতম মহাদেশ ভ্রমণে রয়েছেন ২৭ বাংলাদেশি। সফরে থাকা মহসিনুল হক অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর পাঠকের জন্য নিয়মিত তুলে ধরবেন। আজ থাকছে নবম পর্ব
জাহাজের দ্বাদশ দিন ১৭ ডিসেম্বর। জাহাজ থেকে এদিনও নামার সূচি নেই। জাহাজে অবস্থানকারী ১০০ যাত্রীর বৃহত্তর অংশই (৩০ জন) বাংলা ভাষাভাষী। যার ফলে জাহাজের সকল যাত্রীই বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। জাহাজের একজন যাত্রী ক্যালিফোর্নিয়া ও মেক্সিকোর অধিবাসী স্প্যানিশ ভাষায় যিনি বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন এবং অনুবাদ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি হলেন কথাশিল্পী আনিসুজ জামান।
তিনি এরই মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পদ্মা নদীর মাঝি' স্প্যানিশ ভাষায় 'পেসকাদর দেল রিও পদ্মা' (Pescador Del Padma) অনুবাদ করেছেন এবং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস্ অব সলিটিউড' মূল স্প্যানিশ থেকে বাংলা ভাষায় 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' অনুবাদ করে বাংলা ভাষার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষার এক অনন্য সেতুবন্ধন স্থাপন করেছেন। তিনি 'ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন'-এর একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তার সঙ্গে জাহাজে বসে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে দিনের পর দিন। তিনি বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য থেকে মণি-মুক্তাকে খনি থেকে তুলে এনে অনুবাদ করে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন।
মার্কেসের উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি মার্কেসের এই অনুবাদ প্রথমে খানিকটা পড়েছিলাম জি এইচ হাবীবের বাংলা অনুবাদে। সন্দেহ নেই যে অনুবাদটি পড়ে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। অনুবাদককে আমি সে কথা জানিয়েওছিলাম। কিন্তু যেহেতু স্প্যানিশভাষী একটি দেশে বহু বছর থাকার কারণে ওই ভাষায় আমার কিঞ্চিত ধারণা জন্মেছে। তাই কৌতূহলবশত বইটি পড়তে শুরু করি। পড়তে গিয়ে মনে হলো মার্কেসের কোনো কোনো বাক্যের অভিব্যক্তি এবং বাক্যরীতি ও শৈলী বাংলায় ঠিক সেভাবে আসেনি যেমনটা মূলে পাওয়া যায়। আমি জানি হাবীব অনুবাদটি মূল থেকে করেননি। করেছেন গ্রেগরি রাবাসার ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে। হাবীবের অনুবাদটি ইংরেজির খুবই বিশ্বস্ত অনুবাদ। আমি এও জানি, রাবাসার অনুবাদটিও খুবই প্রশংসিত।
এমনকি স্বয়ং মার্কেসও এর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তবু রাবাসার অনুবাদটিতে আমি তৃপ্ত হতে পারিনি সেখানকার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার কারণে। হাবীবের সুন্দর একটি অনুবাদ থাকা সত্ত্বেও এটি মূল থেকে অনুবাদ করার ইচ্ছার পেছনে এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাই হলো মূল কারণ। উৎসাহী পাঠক যদি আমার অনুবাদটি কখনও মিলিয়ে দেখার আগ্রহ বোধ করেন তাহলে দুজনের অনুবাদের পার্থক্য সহজেই তাদের চোখে পড়বে। আমি চেষ্টা করছি মূলের স্বাদ ও বাচনিক শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখে যতটা মূলানুগ থাকা যায়। মার্কেস যাঁরা মূলে পড়েছেন এমনকি ইংরেজিতেও যাঁরা পড়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন গদ্য হলেও তা কখনও কখনও কবিতার ইঙ্গিতময়তা চেতন ও অবচেতন স্তরের মিশ্র অভিব্যক্তির প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার কারণে প্রায়শই ভাষিক অবগুণ্ঠনে অপরূপ। কিন্তু অনুবাদকের জন্য তা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। পড়তে তা উপভোগ্য মনে হলেও অনুবাকদের জন্য তা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক ভোগান্তি হলেও তা মর্ষকামীর মতোই উপভোগ্য ছিল বলেই তা শেষ করা গেল।
আনিসুজ জামান স্প্যানিশ ভাষায় লেখালেখি এবং অনুবাদের কাজ করলেও তার হৃদয় জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা। তার একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়েছে এবং এটি 'প্রতিদিনের বাংলাদেশ'-এর পাঠকদের জন্য পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে।
জাহাজে আরও কথা হয় অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে সময়ই সাংগঠনিক প্রয়োজনে চষে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। এখন তার নেশা সারা বিশ্ব ভ্রমণ। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তার শেষ হবে সাতটি মহাদেশ পাড়ি দেওয়ার গল্প। মাহবুবের সঙ্গে কথোপকথন চলে নিয়মিত। তার বিনয় আমাদের মুগ্ধ করেছে। ভ্রমণ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভ্রমণ মানুষকে উদার করে, বিনয়ী করে এবং মানুষের সাথে মানুষের মমত্ববোধ সৃষ্টিতে এক বিশাল ভূমিকা রাখে।
জাহাজের বিদেশের যাত্রী আনা নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী। তিনি জানান, তার স্বপ্ন ছিল অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। এই স্বপ্নপূরণ হচ্ছে ভেবে তিনি খুবই পুলকিত। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, সত্য পথে জীবনযাপন করতে হবে, তবেই জীবন সুন্দর এবং সার্থক হবে।
জাহাজের স্টাফ দক্ষ গাইড 'কোন'-এর সাথে কথা হয়। তিনি ভারতে ভ্রমণ করেছেন এবং সুন্দরবন এলাকায় অনেক দিন কাটিয়েছেন। বাংলাদেশ বিষয়ে তার প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশে আসবেন বলে জানান। জাহাজে বাংলা খাবার পরিবেশন হচ্ছে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত এবং বাংলা খাবার তিনি উপভোগ করেন বলে জানান।
আমরা এগিয়ে চলেছি অ্যান্টার্কটিকার দিকে। এরই মধ্যে আমরা জেনেছি জাহাজের শেষ দুই দিন আমাদের অতিক্রম করতে হবে ড্রেক প্যাসেজ। এই ড্রেক প্যাসেজ সম্পর্কে ছোট্ট একটু বর্ণনা আপনাদের তুলে ধরতে চাই।
ড্রেক প্যাসেজ মূলত দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ টিয়েরা দেল ফুয়েগো দ্বীপপুঞ্জ এবং অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ জলপথ। এটি প্রশান্ত মহাসাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রশস্ত এবং গভীর জলপথ এটি। এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা, শক্তিশালী বাতাস এবং উচ্চ ঢেউ থাকে। বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু যেমন তিমি, সিল, পেঙ্গুইন এবং বিভিন্ন ধরনের মাছ এখানে পাওয়া যায়। ইউরোপীয়রা প্রথম এই জলপথটি আবিষ্কার করে এবং এটি দক্ষিণ আমেরিকা ও অ্যান্টার্কটিকার মধ্যে যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল। ড্রেক প্যাসেজে ভ্রমণ করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কঠিন আবহাওয়া এবং উচ্চ ঢেউয়ের কারণে এখানে ভ্রমণ করতে বিশেষ ধরনের জাহাজ ও অভিজ্ঞ নাবিকদের প্রয়োজন হয়। তবে যারা এই চ্যালেঞ্জ মেনে নিতে পারেন তাদের জন্য ড্রেক প্যাসেজ একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে। এ পর্যন্ত ৮০০ জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে বলে একে অনেকেই মৃত্যুপুরী হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সিস ড্রেকের অভিযান
ড্রেক প্যাসেজ নামটি এসেছে ইংরেজ জলদস্যু এবং নাবিক ফ্রান্সিস ড্রেকের নাম থেকে। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে জলপথটি আবিষ্কার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি ১৬শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের জন্য কাজ করতেন এবং স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। তিনিই প্রথম ইংরেজ যিনি সমগ্র পৃথিবী একবার ঘুরে এসেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল স্পেনীয়দের জাহাজ লুট করা এবং এশিয়ায় পৌঁছানো। এই অভিযানের সময় তিনি দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর ভ্রমণ করেন।
ড্রেক যখন দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছান তখন তিনি একটি সংকীর্ণ জলপথ আবিষ্কার করেন। এই জলপথটিই পরবর্তীতে ড্রেক প্যাসেজ নামে পরিচিত হয়।
আগামী পর্বে
এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার পেনিনসুলা সম্পর্কে এবং জাহাজের কিছু মজাদার ঘটনা
লেখক : জেলা ও দায়রা জজ, চাঁদপুর