সাইদুল ইসলাম মন্টু, (বেতাগী) বরগুনা
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:২০ পিএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:২৮ পিএম
প্রায় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এখনও কোনো রকমে টিকে আছে হাতে চালিত তাঁত। প্রবা ফটো
বিষখালী নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে গাছগাছালিতে ঘেরা অপরূপ শোভার বিবিচিনি ইউনিয়নের কারিকরপাড়া গ্রাম। একসময় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতের খটাস-খটাস শব্দে জেগে থাকত পাড়াটি। সেসব এখন অতীত। নামে মাত্রই রয়েছে বিবিচিনি তাঁতিপল্লী। অথচ এ জনপদে তাঁতশিল্পেরে ঐতিহ্য অন্তত ২০০ বছরে
খাঁখাঁ রাস্তাঘাট। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। দুয়েকটি পাখির ডাকের সঙ্গে দূর থেকে সেদিনও ভেসে আসছিল বিবিচিনির কারিকরপাড়ায় গামছা বোনার খুটখাট শব্দ। পঞ্চাশোর্ধ্ব আদম আলী দক্ষ হাতে জাত পেশার কাজটি এক মনে তখনও করে যাচ্ছিলেন।
একসময় পাড়ার প্রতিটি ঘরে তাঁত দেখা যেত। হাতে চালানো তাঁতের খটাস-খটাস শব্দে মানুষ থমকে দাঁড়াত। এখানকার তাঁতে তৈরি কাপড় নারী-পুরুষ সবারই পছন্দের ছিল। শিল্পীমনা তাঁতিরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা নকশা আঁকতেন। এ গ্রামের একেকজন তাঁতি মানেই একেকজন শিল্পী। তাইতো তাদের তৈরি কাপড়ের এত সুখ্যাতি। কিন্তু এখন সে জৌলুস নেই। সিডর ও আইলা তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তারপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি কারিকরপাড়ার তাঁতিরা।
এখানকার তাঁতিপল্লীতে একসময় শতাধিক পরিবার তাঁত বুনত। তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের বেশির ভাগই পেশা বদল করে দিনমজুরি, কৃষিকাজ বা ছোটখাটো কোনো ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁতি পরিবারের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। অবশ্য এখন হাতেবোনা গামছাই বা ব্যবহার করে কজন? এমনিতেই কদর কমেছে তাঁতেবোনা কাপড়ের। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে প্রাচীন এ হস্তশিল্পটি এখন বিলুপ্তির পথে।
সরেজমিন কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে কাঁচামালের বেশি দাম ও বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লাভ পান না তাঁতিরা। অর্থনৈতিক সংকট, প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, রঙ ও সুতার ঊর্ধ্বমূল্য, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির জটিলতা এবং বাজারজাত সমস্যার কারণে শিল্পটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁতনির্ভর পরিবারাগুলোয়। জীবনজীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হয়েছেন জাতপেশা ছাড়তে। সময় যত এগিয়েছে এক এক করে হারিয়ে গেছে এ তাঁতিপল্লীর তাঁতের কাহিনী। হারিয়ে গেছেন সুদক্ষ কারিগররাও। এখন শুধু তাঁতিপল্লী নামটাই পড়ে রয়েছে হারানো গৌরবের স্মৃতি হয়ে। তাঁতি যে কয়েকজন বেঁচে আছেন সবাই বয়সের ভারে নুব্জ।
বিলুপ্তির পথে হাঁটলেও বংশপরম্পরায় এখানকার তাঁতিরা জড়িয়ে পড়েন জাত পেশায়। বেছে নেন জীবিকা অর্জনের প্রধান অবলম্বন হিসেবে। জানা যায়, তাঁতে কাপড় বুনতে পারে না এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া এখানে দুষ্কর। নারীদের ক্ষেত্রে এটা আরও বড় সত্য। তাঁতি পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া, সংসারে সহায়তা ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ‘তাঁতে কাপড় বোনা’ জাতিগত গুণ হিসেবে দেখা হয়। বিয়ের ক্ষেত্রেও তাঁতিসমাজে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ছোট থেকেই নানাভাবে শিক্ষা দিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের তাঁতে কাপড় বুনতে পারদর্শী করে তোলা হয়। উপযোগী করা হয় একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে।
একসময় এখানকার পণ্য এলাকার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্য এলাকায়ও সরবরাহ হতো। কিন্তু তাঁতিরা দিনদিন এ পেশা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। নেওয়া হয়নি সরকারি কোনো উদ্যোগ, দেওয়া হয়নি পৃষ্ঠপোষকতার বা তাঁতের উন্নয়নে কোনো প্রশিক্ষণ। তখন কারিকরপাড়ায় লুঙ্গি, চাদর, শাড়ি, বিছানার চাদর ও হরেক রকমের গামছা বোনা হতো। সিডরের আগেও এখানে শুধু গামছা তৈরি করা হতো। তৈরি মালামাল নিয়ামতি ও বেতাগী বন্দরের পাশাপাশি বরগুনাসহ পাশের জেলা ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হতো। স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে বিদেশি পণ্য বাজার দখল করে ফেলেছে। এ কারণে পণ্যের কদর কমে যাওয়ায় বাজারেও চাহিদা অনেক কমে গেছে। সোহরাব কারিকর (৫৫) জানালেন, আগের মতো আর বাজার নেই। তাই পুরোনো পেশায় ফিরতে চান না তাঁতিরা।
তাঁতিরা বলছেন, বাঁচার তাগিদে তাঁতশিল্প অনেকে পেশা হিসেবে নিলেও বর্তমানে বাজারে রঙ ও সুতার দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে তাঁতশিল্পের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়েনি। ফলে ব্যবসায় মার খেয়ে এ পাড়ার তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। সাবেক ইউপি সদস্য তাঁতি মো. শাহজাহান বলেন, ‘পুঁজির অভাবে অনেকেই এ শিল্পের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রাখতে পারছেন না। বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেকে এ পেশায় টিকে থাকলেও সফল হচ্ছেন না। অনেকেই বসেছেন পথে।’ তাঁতিরা আরও বলছেন, আধুনিক ও নতুন নতুন উৎপাদিত পণ্যের কাছে হস্তচালিত পুরোনো ধরনের তাঁত দিয়ে তৈরি বস্ত্র বাজার দখল নিতে পারছে না। এ পেশায় না দাড়াঁনোর কারণ হিসেবে তাঁতি আছিয়া বেগম (৪০) জানান, শত দুঃখকষ্টের মাঝেও পুরোনো পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে না চাইলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন।
বর্তমানে অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জন্য কঠিন পরীক্ষা। স্থানীয়রা জানান, বিবিচিনির কারিকরপাড়ার উৎপাদিত বস্ত্রের এখনও প্রচুর কদর রয়েছে। কিন্তু পণ্য উৎপাদন দূরের কথা, তাঁতিরাই পেশায় টিকে নেই। অভাব-অনটনের জন্য বংশপরম্পরা ত্যাগ করে অনেক তাঁতি পরিবার এ শিল্প থেকে সরে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। তবু কষ্ট হলেও এখনও অনেকে রয়েছেন যারা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রাখতে চান।
এজন্য কেবল তাদের প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। আরও দরকার দেশি তাঁতবস্ত্রের মানোন্নয়ন, বিশেষ অনুদান প্রদান, পেশাগত শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ।
ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিক আগ্রাসনে তিলে তিলে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ প্রাচীন হস্তনির্ভর তাতঁশিল্প। অথচ বর্তমান সময়েও হাতে তৈরি জিনিসের আলাদা কদর ও দাম দুটিই আছে। একটু উদ্যোগ নিলে উপকূলীয় জনপদের তাঁতিদের একসময়ের জীবিকার প্রধান অবলম্বন লাভজনক এ পেশার পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয়রা। যা এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি, হাতে তৈরি তাঁতের ঐতিহ্যও ধরে রাখতে সক্ষম হবে। মন্দা ও অচলাবস্থা কাটিয়ে ফিরে পাবে তাঁতশিল্পের অতীত সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য।
তাঁত কারিগররা এখন অন্য পেশায়
তাঁতশিল্প নিয়ে কথা হয় বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নের তাঁতিপল্লীর কারিগর ফোরকান বেপারীর (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২০ থেকে ২২ বছর হলো এ পেশা ছেড়েছি। দুই দশক আগেও যে টাকায় ১ বেল্ট সুতা পাওয়া যেত এখন তা কয়েক গুণ বেশি টাকায় কিনতে হয়। তা ছাড়া বেড়েছে রঙ ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম। সে অনুপাতে লুঙ্গি ও গামছার দাম আমরা পাই না। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরও যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। তাই বাপদাদার পেশায় আর আঁকড়ে থাকতে পারিনি। অন্য পেশায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি।’
কারিগর আবুল হোসেন (৬১) বলেন, ‘আগে যে কাজ করেছি তা দিয়ে সংসারটা ভালোমতো চলত। কিন্তু এখন সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয় না, বাড়ির কর্তা হিসেবে এখন আর এ কাজে সংসার চালাতে পারি না। তাই নানা সংকটে তা বাদ দিয়ে বাজারে বাজারে ফেরি করে দড়ি ও জালের সুতা বিক্রি করে জীবন ধারণ করছি।’
এ সময়ের তাঁতি বিল্লাল কারিগর বলেন, ‘বাপদাদার পেশা তাই ক্রমাগত লোকসানের পরও ছাড়তে পারছি না। আগে এ তাঁতেই খেয়েপরে ভালোই চলত কারিগরদের সংসার। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর অর্থাৎ ২০০৭ সালের পর থেকে ক্রমাগত লোকসান, প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব, দফায় দফায় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে একে একে বন্ধ হয় তাঁতকল। ফলে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।’
তাদের মতো তাঁত কারিগর মৌজে আলী বেপারি (৬২), আবদুর রশীদ বেপারি (৬০), আবদুল মোতালেব (৫৫), মুজিবর রহমান (৫৫), নিলুফা বেগম (৫৫), হাজেরা বেগম (৫২)সহ অনেকেই কৃষিকাজ, চায়ের দোকান, বিদেশে পাড়ি, শ্রমিকের কাজ, রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছেন।