রাঙ্গাবালীর চরনজির দ্বীপ
এম এ ইউসুফ আলী, রাঙ্গাবালী
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:১৩ পিএম
চরনজির দ্বীপে সময়ের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখনও কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। প্রবা ফটো
বুড়াগৌরাঙ্গ নদ ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় ভেসে ওঠা একটি দ্বীপের নাম চরনজির। গত শতকের চল্লিশের দশকে ভেসে ওঠা এ দ্বীপটি ষাটের দশকে সরকারি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এরপর পাশের এলাকার লোকজন এসে চাষাবাদ শুরু করেন। আর এ চাষাবাদ কেন্দ্র করেই আশির দশকে জনবসতি গড়ে ওঠে এখানে। সময়ের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এখনও কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত শতাধিক শিক্ষার্থী। এমনকি শিশুদের শিক্ষা আটকে আছে শুধু আদর্শলিপি বইয়ের মাঝে। বলছিলাম সাগর-নদী বেষ্টিত জনপদ পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের অংশ চরনজিরের কথা।
রাঙ্গাবালী সদর থেকে মোটরসাইকেল বা অটোরিকশায় প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গহিনখালী লঞ্চঘাট, সেখান থেকে মাছ ধরার ছোট নৌকায় প্রায় ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় চরনজির দ্বীপে। সদর ইউনিয়ন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় সব ধরনের নাগরিকসুবিধা বঞ্চিত বাসিন্দারা। এখানকার লোকদের যাতায়াতে দুর্ভোগের শেষ নেই। মাছ ধরার ছোট নৌকা কিংবা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ছয়শ লোকের বাস এ ছোট্ট দ্বীপে। প্রকৃতি আর ভূপতিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন তারা। একদিকে প্রভাবশালীদের জমিদখল, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় রান্নাঘরের হাঁড়িপাতিলসহ আসবাবপত্র, আবার ভাটির টানে শুকিয়ে যায় গোসলের পানিটুকুও। একসময় নদীর পানি পান করা হলেও সম্প্রতি কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো বাড়তি সুবিধা নেই এখানে। এখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় অল্প বয়সেই নদীতে মাছ ধরা ও ক্ষেতে চাষবাসের কাজ করার মতো পেশা বেছে নেয় শিশুরা।
দ্বীপের বাসিন্দা মজিবর হাওলাদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার চার মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারিনি। ছেলেটার বয়স পাঁচ বছর হয়েছে, পাশের এলাকা চরবিশ্বাসের একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় দিয়ে আসছিলাম। একদিন শীতের রাতে সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসছে। পরে আবার দিয়ে আসছি, আবার বাড়ি ফিরে নিজের পায়ে নিজে শেকল লাগিয়ে আমাকে বলেÑ “আব্বা এইবার আমারে কেমনে দিয়া আসবা? আমার একলা ওখানে ভালো লাগে না।” এখানে যদি একটা স্কুল হয় কোলের শিশুদের অন্তত অন্য এলাকায় রেখে আসতে হবে না।’
আরেক বাসিন্দা মনির ফকির বলেন, ‘স্যার, আমরা ১৯৯৪ সালের দিকে এ চরে এসে বসবাস শুরু করি। এখানে কোনো স্কুল না থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারি না। কেউ নানাবাড়ি থাইকা পড়ে আবার কেউ দাদাবাড়ি থাইকা। আমরা খুব কষ্টে আছি। চরে ১১০ জনের মতো শিশু আছে কেউ পড়াশোনা করে না। চারদিকে নদী, যাইবে কই?’ এ সময় শহিদুল নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানের বাচ্চারা পড়াশোনা করে না। একটু বড় হলেই বাবার সাথে জাল ফেলতে নদীতে যায় অথবা হালচাষ করতে জমিতে কাজ করে। চারদিকে নদী থাকায় সব দিক থেকেই আমরা বঞ্চিত। এমনকি এখানে কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। কয়েক দিন আগে একজন গর্ভবতী মাকে চিকিৎসার জন্য পাশের উপজেলা গলাচিপা নেওয়ার পথে ট্রলারেই মারা গেছেন। একটি শিশুও মারা গেছে পানিতে ডুবে । কোনো সুযোগসুবিধাই নেই এখানে। তবে একটা স্কুল এখানে খুবই দরকারি। তাহলে অন্তত অন্ধকার থেকে ছেলেমেয়েরা আলোর পথে আসবে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেবাশিস ঘোষ বলেন, ‘চরনজিরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুবই প্রয়োজন। ওখানকার লোকজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য আবেদন এবং কাগজপত্র সাবমিট করেছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে খুব শিগগিরই একজন সহকারী শিক্ষা অফিসারকে ওখানে গিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করার জন্য বলা আছে। তার প্রতিবেদন হাতে পেলে সমস্ত কাগজপত্র জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠাব। এখন বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করলে সরকার নিবন্ধনের ব্যবস্থা করবে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি প্রথম জানলাম। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে খোঁজ নেব। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব যেন ওখানে দ্রুত একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়।’