প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:১০ পিএম
১৯৭৫
১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মের একদিন। আলোকচিত্ৰী নিকোলাস নিক্সন কানেকটিকাটের নিউ ক্যাননে তার শ্বশুরবাড়ি গেছেন। এ ফটোগ্রাফার তার স্ত্রী বিবিকে ডেকে বললেন, তুমি এবং তোমার তিন বোনের এক ফ্রেমে একটা ছবি তুলতে চাই। তোমরা পোজ দিতে রাজি আছো নাকি? যেই বলা সেই কাজ। ঝটপট চার বোন দাঁড়িয়ে গেলেন নিকোলাসের ক্যামেরার সামনে। সাদা-কালো ফ্রেমে চার বোনের ছবিটি তুললেন নিকোলাস। একদম বাঁয়ে দাঁড়ানো তেইশ বছর বয়সি হেদার, তার পাশে দাঁড়িয়ে সদ্য কিশোরী পনেরো বছরের মিমি, তারপর নিক্সনের স্ত্রী পঁচিশ বছর বয়সি বিবি, আর একদম ডানে দাঁড়িয়ে একুশ বছরের লরি। ৮ বাই ১২ ইঞ্চির ক্যামেরায় তোলা সাদা-কালো ছবিটি ছিল চার বোনের তারুণ্যে ঝলমলে সময় এবং একটি পারিবারিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি।
পরের ছবিটি তোলা হয় ১৯৭৬ সালে, হার্টফোর্ডে, লরির গ্র্যাজুয়েশনের সময়। চার বোন সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন নিক্সনের ক্যামেরার সামনে। সাদা-কালো এ ছবিটি হাতে পেয়েই নিক্সনের মনে হলো ছবি তোলার জন্য বেশ দারুণ একটা বিষয় পেয়ে গেছেন তিনি। ঠিক করলেন প্রতি বছর চার বোনের এ একই স্টাইলে দাঁড়ানো সাদা-কালো ছবি তুলবেন তার সেই ৮ বাই ১২ ইঞ্চির ক্যামেরায়।
১৯৭৫ থেকে ২০১৪Ñ এ চার দশকে নিকোলাস নিক্সন চার বোনের চল্লিশটি ছবি তুলেছেন। প্রতি বছর হেদার, মিমি, বিবি আর লরি একসঙ্গে ছবি তুলবেন, বিষয়টি যেন একটি পারিবারিক নিয়ম হয়ে গিয়েছিল।
নিক্সন যেমন তার কাজের প্রতি ছিলেন একনিষ্ঠ, তার ছবির বিষয়বস্তু অর্থাৎ চার বোনও এ ব্যাপারে ছিলেন অনড় অবস্থানে। যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানেরই একটি ঘণ্টা বরাদ্দ ছিল সাদা-কালো ফ্রেমে ছবিটি তোলার জন্য। একবার নাকি চার বোনের একজন জাপানে ছিলেন। সেখান থেকেই উড়ে এসেছিলেন বার্ষিক এ ছবিটি তুলতে। তবে তাতে নিক্সনকেও গুনতে হয়েছিল বিমানের অর্ধেক ভাড়া। আচ্ছা নিকোলাস নিক্সন কি তখন জানতেন খেয়ালের বশে তার তোলা এ চার ব্রাউন বোনের ছবি যা নিতান্তই পারিবারিক রীতিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেই পোর্ট্রেট সিরিজ নিক্সন এবং চার বোনের জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ ছাড়াও পৃথিবীজুড়ে এত খ্যাতি অর্জন করবে?
চারজন সাধারণ মার্কিন তরুণী, ১৯৭৫ সালে প্রথম ছবিটি তোলার সময় যারা ছিলেন তারুণ্যের প্রতীক ২০১৪-তে এ সিরিজের শেষ ছবিটি তোলার সময় তারা ছিলেন বার্ধক্যে। চার দশক ধরে চলমান এ সিরিজের প্রতিটি ছবিতে ফুটে উঠেছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবর্তন। যেন নিজেদের জীবনের পরিবর্তনকে তারা বন্দি করে নিয়েছেন সাদা-কালো ফ্রেমে। পরিবর্তন হয়েছে তাদের চেহারার ভঙ্গিমা, পোশাক-আশাক, ছবির পটভূমি। শুধু বদলায়নি তাদের চার বোনের মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধন।
এ সিরিজে নিকোলাস নিক্সনের ফ্রেমিং চার বোনের মধ্যে ভালোবাসার কথা বলে। সাধারণ পটভূমি, ন্যাচারাল লাইটিং, সাদা-কালো ফিল্মের ব্যবহার পোর্ট্রেট সিরিজটিকে এনে দিয়েছে এক ভিন্ন নান্দনিকতা। কী সাধারণ অথচ কী প্রাচুর্যময় সিরিজের প্রতিটি ছবি!
চার বোনকে নিয়ে করা এ পোর্ট্রেট সিরিজের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সামনে আসে The Brown Sisters (2002) নামের পোর্ট্রেটটি। ২০১৪ সালে প্রকাশ হয় নিক্সনের সিরিজ ফটোগ্রাফের বই Forty Portraits in Forty Years, যা চার বোনের বয়ে চলা সময়ের সাক্ষী। এর আগে ২০১০ সালে বোস্টনে, মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস ‘নিকোলাস নিক্সন : ফ্যামিলি অ্যালবাম’ শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করে; যেখানে তার অন্যান্য পোর্ট্রেটের সঙ্গে ‘দ্য ব্রাউন সিস্টারস’ সিরিজও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
২০১৪ সালে একটানা ৪০টি ফটোগ্রাফের একটি চিত্তাকর্ষক সিরিজের পরে ব্রাউন বোনেরা তাদের প্রিয় পারিবারিক ফটোসিরিজ থেকে বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিরিজের শেষের দিকে এসে মানবজীবনের অনিবার্য পরিণতির কথা খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। চার দশক ধরে বিরতিহীনভাবে চলা দ্য ব্রাউন সিস্টার্স সিরিজের আলোকচিত্রকর নিকোলাস নিক্সনের ‘সবাই এখানে চিরকাল থাকবে না’ কথাটিই হয়তো মাথার ভেতর বারবার ঘুরপাক খায়।