প্রচ্ছদ
সুবর্ণা মেহ্জাবীন স্বর্ণা
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৭ পিএম
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:০২ পিএম
মডেল : আশরাফুল, জলি, পূর্বা; পোশাক ও ছবি : বিশ্বরঙ
খাদি- আমাদের উপমহাদেশের এক অনন্য ঐতিহ্যের নাম। সময়ের আবর্তনে ঐতিহ্যের এ ছোঁয়া এখন ফ্যাশন জগতের ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। খাদি মানেই শুধু একটি পোশাক নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, শেকড় ও শিল্পের প্রতিচ্ছবি। খাদির বুননে মিশে আছে সময়ের পরীক্ষিত গুণ এবং আধুনিক ট্রেন্ডের ছোঁয়া
শীতের হালকা বাতাসে আরামদায়ক ও স্টাইলিশ পোশাকের খোঁজে আমরা সবাই থাকি। আর সেই চাহিদা পূরণে খাদি হতে পারে আপনার সেরা সঙ্গী। ঐতিহ্য, আরাম এবং ফ্যাশনের মেলবন্ধন খাদিকে শীতের জন্য একটি উপযুক্ত পোশাক হিসেবে তুলে ধরেছে। এ খাদির উৎপত্তি মহাত্মা গান্ধীর হাত ধরে। স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে খাদি একটি আত্মনির্ভরশীলতা এবং প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে খাদি নতুন করে ঐতিহ্যের মর্যাদা পায়। এটি দেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। খাদি কেবল পোশাকই নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব তাঁতে খাদি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করত। এটি ছিল মূলত হাতে কাটা ও বোনা সুতা থেকে তৈরি।
ফ্যাশনে খাদির
নবজাগরণ
বর্তমান সময়ে খাদি কেবল ঐতিহ্যের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। এটি ফ্যাশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। খাদির পোশাক এখন আর শুধুই গ্রামীণ কিংবা সাধারণ ব্যবহারিক পোশাক নয়। খাদি আজ বিশ্ব ফ্যাশনের মঞ্চেও জায়গা করে নিয়েছে। র্যাম্প শো থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের স্টাইল স্টেটমেন্ট, খাদি সব জায়গায় নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে।
খাদির ফ্যাশন
: ছেলেদের পোশাক
ছেলেদের জন্য খাদির পোশাক মানে শুধু পাঞ্জাবি বা ফতুয়া নয়। বর্তমানে খাদি দিয়ে তৈরি হচ্ছে জ্যাকেট, শার্ট, কোট এমনকি টাইও। ফিউশন ফ্যাশনের যুগে খাদি এখন ফরমাল-ক্যাজুয়াল উভয় ধরনের পোশাকে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্র্যাডিশনাল পাঞ্জাবি ছাড়াও খাদির ওপর ব্লক প্রিন্ট বা এমব্রয়ডারি করা ডিজাইন এখন দারুণ জনপ্রিয়। খাদির তৈরি হাফ ও ফুল জ্যাকেট অফিসিয়াল-ক্যাজুয়াল উভয় পরিবেশে দারুণ মানায়। এ ছাড়া হালকা রঙের খাদি শার্ট হালকা শীতের জন্য আরামদায়ক এবং একই সঙ্গে স্টাইলিশ।
খাদির ফ্যাশন
: মেয়েদের পোশাক
মেয়েদের পোশাকে খাদি একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। খাদি দিয়ে তৈরি শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টপস এবং ওয়েস্টার্ন আউটফিট সবই ট্রেন্ডি। খাদির হাতে বোনা শাড়ি টেকসই এবং আরামদায়ক। বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে খাদির শাড়ি দারুণ ফ্যাশনেবল। খাদি কাপড়ে ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ড স্টিচ বা আধুনিক নকশা মেয়েদের পোশাকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমনকি বেশ কয়েক বছর ধরে খাদি কাপড়ের ওয়েস্টার্ন পোশাকও তৈরি করছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। স্কার্ট, ব্লেজার বা ওয়েস্টার্ন টপস তৈরি করে ট্র্যাডিশনাল এবং মডার্ন ফ্যাশনের এক অনন্য মিশ্রণ গড়ে তোলা হচ্ছে।
খাদির ট্রেন্ড
: তরুণ প্রজন্মের পছন্দ
তরুণ প্রজন্মের
কাছে খাদির জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এটি শুধু ট্রেন্ডি নয়, একই সঙ্গে
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। তরুণরা এখন ফাস্ট ফ্যাশনের পরিবর্তে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের দিকে
ঝুঁকছে। খাদির পোশাক এতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। হালকা শীতের জন্য ক্যাজুয়াল বা
ফরমাল লুকে খাদির পোশাক সহজেই মানানসই।
খাদির গুণগত
মান এবং আরাম
খাদি প্রধানত হাতে তৈরি হওয়ায় এবং প্রাকৃতিক তন্তুর কারণে এটি খুবই আরামদায়ক। গরমকালে এটি ঠাণ্ডা রাখে এবং শীতকালে উষ্ণ। খাদি হালকা, শ্বাসপ্রশ্বাসের উপযোগী এবং টেকসই কাপড়। এর ফলে এটি সব ধরনের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত। হালকা শীতের জন্য খাদির পোশাক অতিরিক্ত ভারী না হয়ে প্রয়োজনীয় উষ্ণতা দেয়।
খাদির পোশাকে
রঙের বৈচিত্র্য
একসময় খাদি কাপড়ের
রঙ সাধারণত সাদাটে বা অফ-হোয়াইট থাকত, যা মূলত খাদি কাপড়ের প্রাকৃতিক রঙ। তবে সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাশন শিল্পের অগ্রগতি এবং নতুন ডিজাইনের প্রয়োগে খাদি পোশাকের রঙে বৈচিত্র্য
দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে খাদি কাপড় ও পোশাকে উজ্জ্বল এবং নান্দনিক রঙের সমাহার পাওয়া
যায়।
বর্তমানে খাদি
কাপড়ে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হয়; যা ফুল, পাতা, গাছের ছাল বা মাটি
থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর ফলে কাপড়ে একটি স্নিগ্ধ ও নান্দনিক রঙের আভা তৈরি হয়। খাদির
পোশাকে এখন বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের দেখা মেলে, যেমন লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি ও বেগুনি।
এ রঙগুলো খাদি পোশাককে আরও আকর্ষণীয় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা উৎসবের জন্য উপযুক্ত করে
তোলে। খাদির পোশাকে মাটির রঙের মতো হালকা শেড যেমন বাদামি, ধূসর, হালকা সবুজ বা মলিন
নীল এখন বেশ জনপ্রিয়। এ শেডগুলো খাদি পোশাকের ঐতিহ্যবাহী ভাব বজায় রেখে একটি আধুনিক
লুক দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই খাদি কাপড়ে ব্লক প্রিন্ট বা হস্তনির্মিত নকশার মাধ্যমে
একাধিক রঙের মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এতে পোশাকে একটি শৈল্পিক ও আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যোগ
হয়। আধুনিক ফ্যাশনে খাদি কাপড়ে গ্রেডিয়েন্ট বা ওমব্রে রঙের ব্যবহার দেখা যায়, যেখানে
একই কাপড়ে রঙের ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে। এটি খাদি পোশাককে একটি আধুনিক ও ইউনিক লুক
দেয়।
বিশ্ব ফ্যাশনে
খাদির অবস্থান
খাদির ফ্যাশন
এখন আর শুধু বাংলাদেশ বা ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক ডিজাইনাররা খাদি ব্যবহার
করে বিভিন্ন কালেকশন তৈরি করছেন। নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইক বা প্যারিসের র্যাম্পেও খাদির
উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। খাদি তার সাসটেইনেবল এবং পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্যের জন্য আন্তর্জাতিক
বাজারেও জায়গা করে নিচ্ছে।
টেকসই ফ্যাশন
খাদি প্রাকৃতিক
তন্তু দিয়ে তৈরি তাই এটি দীর্ঘস্থায়ী এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য। খাদি কেবল শীতের সঙ্গীই
নয়, এটি একটি দারুণ টেকসই ফ্যাশন, সঙ্গে পছন্দও বটে।
পরিবেশবান্ধব
ফ্যাশন
খাদি সাসটেইনেবল
ফ্যাশন উপাদান। এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় এবং পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব
ফেলে না। ফাস্ট ফ্যাশনের যুগে খাদি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
উৎপাদন এবং
কর্মসংস্থান
খাদির জনপ্রিয়তা
শুধু ফ্যাশনের জন্য নয়, এটি হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক। বাংলাদেশের
গ্রামীণ অর্থনীতিতে খাদির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারী কর্মীরা খাদি তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা
পালন করছেন, যা তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে।
ঐতিহ্য থেকে
ভবিষ্যৎ
খাদি এখন আর শুধুই
ঐতিহ্যের প্রতীক নয়; এটি ভবিষ্যতের টেকসই ফ্যাশনের একটি অপরিহার্য উপাদান। ডিজাইনাররা
খাদিকে আধুনিক রূপ দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলছেন। এর ফলে খাদি
যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য এবং ফ্যাশনের মেলবন্ধন হিসেবে টিকে থাকবে।
খাদি কেবল একটি
কাপড় নয়; এটি আমাদের সংস্কৃতি, ফ্যাশন এবং সাসটেইনেবিলিটির মেলবন্ধন। ঐতিহ্যের শেকড়
থেকে খাদি আজকের ট্রেন্ডের কেন্দ্রে জায়গা করে নিয়েছে। হালকা শীতের সময় ফ্যাশন এবং
আরামের মেলবন্ধন খুঁজে পেতে খাদির বিকল্প নেই। এটি একদিকে ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের সংযোগ
স্থাপন করে, অন্যদিকে আধুনিক ফ্যাশনের অংশ হিসেবে আমাদের সঙ্গী হয়। তাই এ শীতে খাদির
পোশাক হতে পারে আপনার নিত্যদিনের ভরসা।
খাদি পোশাকের
যত্ন
খাদি পোশাকের
যত্ন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাতে বোনা হওয়ায় এবং এর সুতি বা মিশ্র তন্তুতে খুব সহজে
ক্ষতি হতে পারে। খাদি পোশাক দীর্ঘস্থায়ী ও আরামদায়ক হলেও সঠিক যত্ন নিলে এগুলোর সৌন্দর্য
বজায় থাকে দীর্ঘদিন।
ধোয়া : খাদি পোশাক ধোয়ার সময় সতর্ক
হতে হবে। মেশিনে ধোয়ার পরিবর্তে হাতে ধোয়া ভালো। ঠান্ডা বা হালকা গরম পানিতে ধোয়া উচিত।
শক্ত সাবান বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করবেন না। কারণ এটি খাদি ফেব্রিকের নরম ভাব
নষ্ট করতে পারে। খাদি কাপড়ে যেকোনো দাগ থাকলে হালকা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে হাতে পরিষ্কার
করুন।
শুকানো : ধোয়ার পর খাদি পোশাক সোজা ঝুলিয়ে
শুকানো উচিত, তবে রোদে সরাসরি রাখবেন না। খাদি কাপড় প্রাকৃতিকভাবে শুকানোর জন্য ছায়াযুক্ত
স্থানে রাখুন। না হলে রঙ ফিকে হয়ে যেতে পারে। এমনকি কাপড় শক্ত হয়েও যেতে পারে।
ইস্তিরি করা
: খাদি পোশাক
মাঝারি তাপমাত্রায় ইস্তিরি করুন, কারণ খুব গরম তাপমাত্রায় কাপড়ের তন্তু নষ্ট হয়ে যেতে
পারে। কাপড় ভিজে থাকলে ইস্তিরি করা ভালো, এতে ভাঁজ ও দাগ কম হয়।
সংরক্ষণ :
খাদি পোশাক
স্টোর করার সময় সেগুলো শুষ্ক ও ঠান্ডা জায়গায় রাখুন। কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখুন, যাতে
সেগুলোর আকৃতি নষ্ট না হয়। বিশেষ করে সিল্ক বা লিনেন মিশ্রিত খাদি কাপড়গুলোর জন্য আলাদা
যত্ন প্রয়োজন।
চাদরের যত্ন
: শীতের পরে
খাদি পোশাক বা চাদর ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে ময়েশ্চারপ্রুফ ব্যাগে রেখে সংরক্ষণ করুন।
এতে কাপড়ে ফাঙ্গাস বা পোকা ধরার আশঙ্কা কমে।
ডিজাইন কন্সেপ্ট ও ফ্যাশন ডিরেকশন : বিপ্লব সাহা
মডেল : আশরাফুল, জলি, পূর্বা, জারা
পোশাক : বিশ্বরঙ
মেকআপ : খাইরুল
ছবি : অনিক চন্দ্র