× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পলিথিন নিষিদ্ধ : বিকল্প বাজারের ব্যাগ কতদূর

হাসনাত মোবারক

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:১০ পিএম

আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৪৩ পিএম

রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক কারখানায় ভুট্টার স্টার্চ থেকে তৈরি হচ্ছে পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ব্যাগ

রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক কারখানায় ভুট্টার স্টার্চ থেকে তৈরি হচ্ছে পলিথিনের বিকল্প পচনশীল ব্যাগ

একসময় চটের ব্যাগ ভরে বাজার করার চল ছিল। কলাপাতা বা শালপাতায় মুড়ে গুড়, লবণ বিক্রি হতো। সময় পাল্টেছে। চটকদার আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেই দিন, সেই শালপাতা বা চটের ব্যাগ। জায়গা দখল করেছে পলিথিন ব্যাগ। ভুক্তভোগী হয়ে জানলাম আধুনিকতার নামে যেটা গ্রহণ করছি, সেটা আসলে মারণফাঁদ।

পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ এখন ঝুঁকির মুখে। অপচনশীল পলিথিনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল। পলিথিন বা প্লাস্টিকজাত বর্জ্যের কারণে অনেক নদীর পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহারের অনুপযোগী। উদাহরণ হিসেবে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর কথাই যদি ধরা হয় আমরা জানতে পারি, বুড়িগঙ্গার তলদেশের ৮ থেকে ১০ ফুট পলিথিনে পূর্ণ। দুই পার দখল করে নিয়েছে অবৈধ প্লাস্টিক কারখানা আর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকজাত পলিথিন। এসব দূষিত বর্জ্যের ফলে মানবদেহে বাসা বেঁধেছে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, অ্যাজমা, ফুসফুস ড্যামেজসহ নানাবিধ প্রাণঘাতী রোগ। প্লাস্টিকজাত পলিথিন ব্যাগের কুফল যে শুধু বুড়িগঙ্গাপারের মানুষ ভোগ করছে তা নয়, বরং সারা দেশের মানুষই এখন এর ভুক্তভোগী। বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পলিথিন।

সরকার ১ নভেম্বর, ২০২৪ থেকে দেশের বাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পলিথিনের ব্যাগ। জানা গেছে, চলতি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন কাঁচাবাজার মনিটরিং করে পলিথিন ব্যাগের বিষয়ে বিক্রেতাদের সতর্ক করবে। কোনোরকম জরিমানা বা শাস্তির আওতায় আনা হবে না। ১ ডিসেম্বর থেকে বাজারে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর অবস্থান নেবে সরকার। কঠোর ব্যবস্থা নেবে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের জন্য এর বিকল্প কিছু কি আছে?

ক্ষতিকর জেনেও ব্যবহারের সুবিধা, সুলভ, সহজলভ্য এবং আর্দ্রতারোধক হওয়ায় কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে শপিং মলÑ প্রতিটি স্থানেই পলিথিন ব্যাগ ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের কাছেই পছন্দের বিষয়। কাঁচাবাজারের প্রায় শতভাগ দখল করে আছে পলিথিন ব্যগ। তাহলে পলিথিন নিষিদ্ধ হলে আমাদের কী হবে?

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। সেটা বাজার চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারবে সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। রাজধানীর মতিঝিলের ফল ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া এক ক্রেতাকে পলিথিন ব্যাগে ভরে ফল তুলে দিলেন। নিষিদ্ধ জেনেও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে ফল বিক্রেতা নির্বিকার হাসি দিয়ে বলেন, ‘যারা বাতিল করছে, তারাই কিনে নিয়া যায়। বিকল্প যেইডা আছে হেইডা দিলে আমরা হেইডাতই ফল দিয়া দিমু।’

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। তাহলে সারা দেশে কী পরিমাণ পলিথিন ব্যাগের প্রয়োজন পড়ে! ভাবলেই শঙ্কা জাগে। পরিবেশবান্ধব এবং পচনশীল ব্যাগ নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

মাঝেমধ্যে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিকল্প কিছু গবেষণা বা উদ্যোগ দেখা গেলেও সেটা সর্বজনে ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। ২০১৬ সালে ক্ষতিকর পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল ব্যাগ উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান। তিনি পাটের সেলুলোজ থেকে আর্দ্রতারোধক ব্যাগটি উদ্ভাবন করেন। তাই এর নাম দেওয়া হয় ‘সোনালী ব্যাগ’। ২০১৭ সালে এ ব্যাগটি শপিংয়ের ব্যবহারের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে বাজারে নিয়ে আসা হয়। ব্যাগটি দেখতে পলিথিনের মতো হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু সেটাও পরে খুব বেশি দূর এগোয়নি।

সরকার সোনালী ব্যাগ প্রকল্পে ১০০ কোটি বরাদ্দ দিয়েছে। একনেকে তা পাস হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টাকা পাওয়া যাবে। এরপর বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হবে। - ড. মোবারক আহমদ খান, উদ্ভাবক, সোনালী ব্যাগ

সোনালী ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রসঙ্গে কথা হয় ড. মোবারক আহমদ খানের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘এখন স্বল্পপরিসরে ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। দৈনিক ১ টন ব্যাগ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে কারখানার। কিন্তু কারখানাটি দিনে ৮ ঘণ্টা চলে। সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। তাই সক্ষমতার খুব কমই উৎপাদন হয়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণের জন্য বেশ কিছু সময় লাগবে। সরকার সোনালী ব্যাগ প্রকল্পে ১০০ কোটি বরাদ্দ দিয়েছে। একনেকে তা পাস হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে টাকা পাওয়া যাবে। এরপর বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হবে।’

বরাদ্দ অর্থ হাতে পেলে আপনারা ঠিক কতদিনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যেতে পারবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. মোবারক আহমদ খান বলেন, ‘ছয়-সাত মাসের মধ্যে সম্ভব। তখন দৈনিক ৫ টন ব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।’

তার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেল, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আবিষ্কৃত সোনালী ব্যাগ তৈরির জন্য যথেষ্ট কাঁচামাল দেশেই আছে। সরকারি এ প্রকল্পের ১ কেজি সোনালী ব্যাগের বর্তমান দাম ১ হাজার টাকা। ১ কেজি সোনালী ব্যাগে শপিং আকারের প্রায় ৪ থেকে ৫ কেজি ওজন বহনকারী ৭০-৮০ পিস ব্যাগ তৈরি করা যায়। তবে ব্যাগ আরও পাতলা করলে সংখ্যা বাড়বে। উদ্ভাবক ড. মোবারক আহমদ খানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, দেশের মানুষের চাহিদা এবং পরিবেশের কথা ভেবে সোনালী ব্যাগ প্রাইভেট মালিকানধীনে দেওয়া সম্ভব কি না? জবাবে বলেন, নীতিনির্ধারকরা চাইলে সবই সম্ভব।

আমাদের কারখানায় প্রতিদিন ২ লাখ পিস কম্পোস্টেবল ব্যাগ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে চাহিদা না থাকায় বেশি উৎপাদন করা হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও ঘাটতি রয়েছে।--- - -ইফতেখারুল হক, উদ্ভাবক, কম্পোস্টেবল ব্যাগ

শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরির চেষ্টা করছেন। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিস্টাল বায়োটেক’। এটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আলিমগঞ্জে অবস্থিত। তারা ২০২২ সাল থেকে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ভুট্টার স্টার্চ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ বাজারজাত করে আসছে। কিন্তু তখন বাজারে পলিথিন থাকায় তাদের তৈরি পলিব্যাগ বাজারে তেমনভাবে সাড়া ফেলতে পারেনি। এ প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে স্থানীয়ভাবে ব্যাগ বিক্রির প্রচার চালালেও খুব লাভ হয়নি। বাজারে তাদের তৈরি পলিমার ব্যাগ ক্রেতা না পাওয়ায় মাঝখানে বন্ধ রাখতে হয়েছিল কারখানাটি। এরপর গ্রাহক তৈরি করে আবার ব্যাগ উৎপাদন শুরু করে। খুচরা বাজারে তাদের তৈরি প্রতি পিস ব্যাগ ২ টাকা থেকে শুরু করে ১০, ১২ ও ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হয়। অল্পসংখ্যক সচেতন নাগরিক এ পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহার করছেন বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ইফতেখারুল হক। তিনি বলেন, রাজশাহীর ১০-১২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আমরা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ সরবরাহ করছি। বর্তমানে সব ধরনের বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ায় পলিমার ব্যাগের চাহিদা বাড়ছে।

পলিমার এ ব্যাগের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভুট্টার স্টার্চ। পলিথিন ব্যাগের চেয়ে বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ও টেকসই। আর ব্যাগগুলোর কাঁচামাল জৈবপদার্থ হওয়ায় দ্রুত মাটিতে মিশে যায়। ফলে পরিবেশদূষণের কোনো আশঙ্কা নেই। ইফতেখারুল হক বলেন, আমাদের কারখানায় প্রতিদিন ২ লাখ পিস কম্পোস্টেবল ব্যাগ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে চাহিদা না থাকায় বেশি উৎপাদন করা হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও ঘাটতি রয়েছে। তিনি মনে করেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে পলিমার এ ব্যাগ উৎপাদনে অনেকে আগ্রহী হবেন।

ভুট্টার স্টার্চ থেকে উদ্ভাবিত কম্পোস্টেবল ব্যাগ এবং পাটের সেলুলোজ থেকে তৈরি সোনালী ব্যাগ হতে পারে পলি ব্যাগের বিকল্প

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশে ৩ হাজার টন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ওয়েস্ট কনসার্নের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৩৬ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়। আর ৩৯ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায় এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়। রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় ৭০০ টন বা তারও বেশি একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন বা প্লাস্টিক ড্রেন, জলাভূমি, খাল, নদী ও পরিত্যক্ত স্থানে জমা হয়।

অর্থাৎ সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন যে উদ্যোগ রয়েছে তা আমাদের চাহিদার তুলনায় খুবই কম। জীবনধারার পরিবর্তনের কারণে আমরা যেহেতু চটের ব্যাগ বা কলাপাতার যুগে ফিরতে পারছি না; সে ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাগ বা ক্রিস্টাল বায়োটেকের মতো পরিবেশবান্ধব এবং ব্যবহারকারীর চাহিদা পূরণে সক্ষম ব্যাগের দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি। তা না হলে পলিথিন নিষিদ্ধের মতো একটি ভালো উদ্যোগও ভোক্তার জন্য বিড়ম্বনা ডেকে আনবে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা