রাজু আহমেদ, রাজশাহী
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫৫ পিএম
আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫৮ পিএম
ট্রেনের বগির আদলে আঁকা রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
যেন চলন্ত এক ট্রেন। যাত্রীসংখ্যা ৩০৯। স্টেশনের নাম ‘কলকাকলি’। যাত্রীদের কলতানে মুখরিত এ ট্রেনটি দেখে মুহূর্তে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল শামসুর রাহমানের লেখা ‘ট্রেন’ কবিতার এ পঙ্ক্তিগুলোÑ ‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে, রাত দুপুরে অই/ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে, ট্রেনের বাড়ি কই?’ কৌতূহলী মনের প্রশ্ন। এ ট্রেনের ঠিকানাই বা কোথায়? বলছি ট্রেনের বগির আদলে চিত্রায়ণ করা রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা।
স্কুলটির তিনটি কক্ষ সাজানো হয়েছে হুবহু ট্রেনের আঙ্গিকে। নামও দেওয়া হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’ গন্তব্য ‘ধাদাশ টু মহাকাশ’। এ শব্দ দুটি যেন চিন্তার জগৎকে খানিকটা ধাক্কা দিল। প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলের ছয়টি জরাজীর্ণ ঘর পরিপাটি করে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে তারা ছুঁটে যেতে চান দূর কল্পরাজ্যে। আর এর মূল কারিগর প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খানম। যিনি ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’ ট্রেনটির মূল চালক। ১০ বছর ধরে এ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘টিনশেড ভবনের অবস্থা খুব নাজুক ছিল। এখানে যাদের ক্লাস হয়, ওই শিক্ষার্থীরা খুব খারাপ করত। সেই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে একজন শিল্পীকে এনে স্টেশন ও ট্রেনের থিম বলি। “কলকাকলি স্টেশন” যা আমাদের ধাদাশ স্কুল। আর ট্রেনের গন্তব্যস্থল “ধাদাশ টু মহাকাশ” অর্থ তারা এ ধাদাশ গ্রামের এ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আগামীতে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গন্তব্য মহাকাশ অর্থ উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনকে বোঝানো হয়েছে।’ প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার শিক্ষার্থীদের পুথিগত বিদ্যার পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষা দিতে চালু রেখেছেন নানা ধরনের কার্যক্রম। যার মধ্যে ‘খুদে আলোকবর্তিকা’অন্যতম। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের একটি ডায়েরি দেওয়া হয়। যেখানে প্রতিদিন তারা অন্তত একটি ভালো কাজ লিখে রাখে। মাস শেষে তাদের মূল্যায়ন হয়। প্রতিটি ক্লাস থেকে তিনজন করে মোট ১৫ খুদে আলোকবর্তিকা বাছাই করা হয়।
খুদে শিক্ষার্থীদের হাতের কারুকার্যে স্কুলকক্ষগুলোও বর্ণিলভাবে সেজেছে; যা দেশের গতানুগতিক আর দশটা স্কুলের চেয়ে একদম ভিন্ন। টয়লেটের বাইরের দেয়ালও রঙতুলিতে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। টিনের বারান্দায় ছোট ছোট টবে নানা ধরনের গাছ লাগানো রয়েছে। লাল, সবুজ, হলুদ ও নীলের বর্ণিল আভায় পুরো স্কুলটি যেন রূপ নিয়েছে এক চিলতে ফুলের বাগানে। সেই বাগানে প্রজাপতির মতো ছুটে বেড়াচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রত্যন্ত গ্রামের এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই দারুণ চটপটে। ১৯৬৭ সালে স্থাপিত স্কুলটিকে নিজের গোছানো সংসারের মতো পরিপাটি করে রেখেছেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলটির ক্লাসরুম ছয়টি, একটি লাইব্রেরি রুম ও শিক্ষকদের জন্য একটি রুম। প্রধান শিক্ষক ওই রুমটি অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করে নিয়েছেন। ছয়টি ক্লাসরুমের মধ্যে তিনটি রুমের ভবনটি বহু পুরোনো। পাশে রয়েছে একটি পুকুর। সেই পুকুরের পাড় ভেঙে যাওয়ায় এ টিনশেড ভবনটিও ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২২ সালে স্কুলটি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার শূন্য শতাংশে নিয়ে আসায় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। কথা হয় অভিভাবক ফুলজুড়ি খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্কুলের পরিবেশ খুব চমৎকার। স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ যেন একটি পরিবার। বাচ্চারা এ স্কুলে এসে অনেক মজা পায়।’
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা হয়। এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ স্কুলের শিক্ষাকার্যক্রম সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। ভবিষ্যতে ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো কিছু করবে।’