সুফল চাকমা, বান্দরবান
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩১ পিএম
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুমি সম্প্রদায়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী তংসই খুমী। প্রবা ফটো
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি জাতিসত্তার মধ্যে সবচেয়ে কম ভাষিক ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী, দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী এবং শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর হলো খুমী সম্প্রদায়ের লোকজন। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ৩ হাজার ৯৯৪। এদের বসবাস বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায়।
পাহাড়ের সেই খুমী সম্প্রদায়ের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে শত বাধা পেরিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তংসই খুমী। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩-২৪ সেশনে ভর্তি হয়েছেন তিনি। যদিও ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ২০১৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। তার পরও থেমে থাকেননি। জুম অ্যাকাডেমিতে বিনা খরচে কোচিং, মা আর বড় ভাইদের অনুপ্রেরণায় শাবিপ্রবিতে ভর্তি হতে পেরেছেন। তিনি সবার আশীর্বাদ চেয়েছেন।
তংসই খুমীর গ্রামের বাড়ি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের দুর্গম মংঞোপাড়ায়। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম বান্দরবান জেলা শহর থেকে সাঙ্গু নদে ইঞ্জিনচালিত বোট।
বাবা নয়লো খুমীও খুমী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তারাছার ঘেরাও মুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৪ সালে মারা যান।
তংসই খুমী চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। বাকি দুই ভাইও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্সে এবং অন্য ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট বোন ঢাকার সেন্ট যোসেফ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়েন।
তংসই বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এইচএসসি পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত জুম অ্যাকাডেমি কোচিং সেন্টারে বিনা খরচে কোচিং করেন।
শত বাধা পেরিয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩-২৪ সেশনে ভর্তি হয়েছেন তংসই খুমী। ২০১৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের আপ্রাণ চেষ্টাই তাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে
তংসই খুমীর বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সুইতং খুমী জানান, তার বাবা মারা যাওয়ার পর চার ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ চালান তার মা। ছোটকাল থেকে সবার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর খুমী সম্প্রদায়ের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে সবার মধ্যে। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে গেলে আগে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সেই অনুপ্রেরণা থেকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন চার ভাই-বোন।
চার ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে জোগানো হয়Ñ জানতে চাইলে সুইতং খুমী জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষ থেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম চাকরি করেন। এখনও বিকাল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চাকরি করে যা পান তা দিয়ে ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়া খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন আর মাকে সহযোগিতা করছেন। তার মা বান্দরবান শহরের উজানীপাড়ায় থাকেন। ঘরে কোমরতাঁত বুনে খুমীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি করেন। সেটা বিক্রি করা আয়ের টাকা ও বাবার পেনশনের টাকায় পরিবার চলছে।
তংসই খুমীর মা নিংসাই খুমী বলেন, ‘স্বামী নেই, তারপরও চার ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছি। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেজো ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর বড় মেয়ে এবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, ছোট মেয়েটি ঢাকার সেন্ট যোসেফ কলেজে পড়ে। স্বামীর পেনশনের ৬ হাজার টাকা আর কাপড় বুনে যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছি।’
বাংলাদেশ খুমী স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সভাপতি সই নাং খুমী তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘অনেক কষ্ট-পরিশ্রম, শত বাধা অতিক্রম করে তংসই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে তার মা ও ভাই-বোনের অনুপ্রেরণা এবং জুম ফ্রি কোচিংয়ের সহযোগিতায়। খুমী সম্প্রদায়ের প্রত্যেক পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছল; তংসইদের পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়।’
খুমী সম্প্রদায়ের প্রথম মাস্টার ডিগ্রি পাস করা মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মী লেলুং খুমী বলেন, ‘তংসই মেয়েদের মধ্যে খুমী সম্প্রদায় থেকে প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সেটা খুবই আনন্দের সংবাদ। কিন্তু তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তার বাবা ১০ বছর আগে মারা যাওয়ার সময় চার ভাইবোনকে রেখে যান। তার মধ্যে দুই ভাই ও এক বোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। শুনেছি তংসই খুমীর লেখাপড়ার দায়িত্ব কোনো এক দম্পতি নিয়েছেন। খুমীদের সামাজিক সংগঠন থেকে হয়তো মাসিক খরচ দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে এককালীন আর্থিক সহায়তা করা হবে।’ তিনি আশা করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য জেলা পরিষদ তংসইয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সহায়তা করবে। তার বিধবা মা চার ছেলেমেয়েকে খুব কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছেন। শুধু খুমী সম্প্রদায় নয়,পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ম্রো, খেয়াং, পাংখুয়া, বমসহ পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে অধিকতর সুযোগসুবিধা দিয়ে তুলে আনা উচিত। বিশেষ করে এ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া উচিত; যেমন থাকে অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্বে, তিনি যোগ করেন।
খুমীদের সামাজিক সংগঠন খুমী সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি সিঅং খুমী জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন খুমী ছাত্রী পড়লেও তংসই খুমী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। খুমীদের বেশিরভাগ মানুষ দুর্গম এলাকায় বসবাস করে। আর্থসামাজিক এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় কেউ চাইলেই সহজে উচ্চশিক্ষায় আসতে পারে না। তংসই খুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হওয়া অন্যান্য শিক্ষার্থীর ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন যত দুর্গম এলাকার বাসিন্দা হোক, উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।