গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৬ এএম
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ১১:৫৪ এএম
সাতলা বিল যেন শাপলার স্বর্গরাজ্য। ছবি : ফখরুল ইসলাম
নদী, বিল, পুকুর ও হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শাপলার পাগল করা হাসি প্রেয়সীর হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হয়। জলের ওপর ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। লিখেছেন গোলাম কিবরিয়া
কালের ধারায় প্রকৃতি যেন এ ধরায় প্রাণের সজীবতা, রঙ, রূপ ও স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছে। নদী, বিল, পুকুর ও হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলার পাগল করা হাসি প্রেয়সীর হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হয়। শিশিরভেজা শাপলা ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। আকাশে-বাতাসে, দূর্বাঘাসে প্রকৃতির মায়াজাল তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। শাপলা ফুলের সৌরভে প্রকৃতি তার বীণার তারে সুর বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। ‘কাজল বিলে শাপলা হাসে/হাসে সবুজ ঘাস।/খলসে মাছের হাসি দেখে/হাসে পাতিহাঁস।’ কবির এই কাজল বিলটা ঠিক কোথায়, তা জানা যায়নি। তবে দেশের প্রায় সব জায়গাতেই শাপলা ফোটে। কিন্তু কিছু জায়গায় এর সৌন্দর্য হয় অতুলনীয়। আজ আমরা চারটি শাপলা বিলের কথা বলব, যেগুলোয় আপনি ঘুরে আসতে পারেন।
সাতলা বিল
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামে অবস্থিত শাপলা বিল। বিলটি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট গ্রামটি বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেছে লাল, সাদা ও গোলাপি শাপলা ফুলের জন্য। স্থানীয়ভাবে এটি ‘সাতলার শাপলা বিল’ নামে পরিচিত। সাতলা বিলের শাপলা ফুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, জীবন্ত চিত্রকর্মের মতো। বর্ষা ও শরতে বিলে শাপলা ফুলের সমারোহ চোখে পড়ে। বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে অগণিত শাপলা ফুলের খেলা; যেখানে লাল, সাদা ও গোলাপি রঙের ফুলগুলো প্রকৃতির রূপ ফুটিয়ে তোলে। বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলায় সাতলা গ্রামে গেলে দেখা মিলবে নয়নাভিরাম এক দৃশ্যের। প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমি জুড়ে এ রকম লাল শাপলার আধিক্য। এখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় শাপলা চাষ ও এর বিপণনের মাধ্যমে। সাতলা বর্তমানে একটি পর্যটকমুখী এলাকা হলেও এটি একটি বিলের নাম। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা ফোটে। ছোট নদী, হাওর ও বিলবেষ্টিত ছোট গ্রাম সাতলা।
সবচেয়ে বেশি শাপলার উপস্থিতি দেখা যায় সাতলার নয়াকান্দি ও মুড়িবাড়ীতে। এখানে মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু করে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত শাপলার দেখা মেলে। বিলের চারপাশ সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা। হারতা ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মতে, আষাঢ় থেকে কার্তিক- এই পাঁচ মাস সাতলা বিলে ফোটে লাল শাপলা। বিলের সৌন্দর্য উপভোগের উপযুক্ত সময় শরতের শেষভাগ থেকে হেমন্তের মাঝামাঝি। ভোর থেকে সকাল ৮টা এবং পড়ন্ত বিকালে শাপলার রূপ-সৌন্দর্য বেশি। সূর্যের তেজ বাড়তে থাকলে শাপলা ফুলের পাপড়ি ছোট হয়ে যায়।
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে বরিশাল। লঞ্চ থেকে নেমে একটা মাহেন্দ্র (সিএনজি সদৃশ যান) রিজার্ভ করে সোজা সাতলা চলে যেতে হবে। এক মাহেন্দ্রতে সর্বোচ্চ সাতজন বসতে পারে। রিজার্ভ করার সময় বলে নেবেন, সাতলার বাগদা অথবা নয়াকান্দি নামক স্থানে যাবেন; যা কি না সাতলা বাজারের পর অবস্থিত। বরিশালের নথুল্লাবাদ থেকে শিকারপুর হয়ে সাতলা পর্যন্ত বাস আছে। কিন্তু বাসে গেলে বেশি সময় লাগবে। সাতলা গিয়ে ডিঙি নৌকা ভাড়া নিয়ে বিল ঘুরবেন। নৌকা ও লোকজনের পরিমাণভেদে ভ্রমণের খরচ বিভিন্ন রকম হতে পারে।
ডিবির হাওর
হেমন্তের শুরুতে ঋতুচক্রের এই পালাবাদলের সময় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা ডিবি বিল, কেন্দ্রী বিল, হরফকাটা ও ইয়াম বিলে দিব্যি শাপলার হাসি চোখে পড়বে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের এই বিলগুলো এখন রূপ নিয়েছে শাপলার রাজ্যে। বিলের জলে ফুটে থাকা অজস্র লাল শাপলা হার মানাচ্ছে সূর্যের আলোকেও। ভোরের আলোয় শাপলার হাসিতে আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে বিলগুলো।
কয়েক বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ৪ বিলের সমন্বয়ে গড়া ‘ডিবির হাওর’ নামের এই জায়গাটি। শাপলা ফোটার মৌসুমে প্রতিদিন জায়গাটিতে ভিড় করেন অজস্র দেশি-বিদেশি পর্যটক। বিলের জলে শাপলা-ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার পালায় তাদের প্রতি হাসিমুখে ফুল কেনার আহ্বান জানায় এই ফুলেল শিশুরা। সিলেট শহর থেকে ৪২ কিলোমিটারের যাত্রাপথ। শাপলা বিলের পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ভ্রমণপিপাসুদের পৌঁছাতে হবে ভোরে। সূর্যের আলো ফোটার আগেই যেন শাপলার রূপ ফোটে বেরোয়। সিলেট শহর থেকে বাসে করে বা সিএনজি অটোরিকশায় চেপে পৌঁছা যায় শাপলা বিলে। বাসে করে গেলে আপনাকে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় নামতে হবে। সেখান থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন ডিবির হাওরে। এ ছাড়া চাইলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চেপে বসতে পারেন।
ডিবির হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হলো হাওরের পাড়ঘেঁষা পাহাড়ের সারি। হরফকাটা ও ডিবি বিলের মধ্যে রয়েছে রাজা রাম সিংহের সমাধিস্থল। দূর পাহাড়ে দেখা মিলবে খাসিয়াদের পান-সুপারির বাগান। প্রকৃতির বুকে শিল্পীর তুলিতে আঁকা এ যেন এক নকশিকাঁথা।
রূপগঞ্জ শাপলা বিল
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শিমুলিয়া গ্রামের শাপলা বিলের অবস্থান ঢাকার খুব কাছেই। সবাই স্থানটিকে ‘শাপলার বিল’ নামে চিনলেও এর মূল নাম শিমুলিয়া কুলাদি বিল। শিমুলিয়া গ্রামটি রাজধানী ঢাকার খুব কাছেই। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজের পাশেই এর অবস্থান। ফুল ফোটার পর থেকেই পাথরে বন্দিজীবন কাটানো মানুষ প্রশান্তির আশায় ছুটে আসে এ বিলে।
আপনি যদি এই বিল ঘুরতে যান, তাহলে বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখতে পাবেন, যেখানে তিনটি ভিন্ন ধরনের শাপলার পাশাপাশি ফোটে থাকে পদ্মও। তা ছাড়া কাছাকাছি দূরত্বে থাকা জিন্দাপার্কও এই স্থানটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। কারণ ইচ্ছা হলেই পুরো পরিবার নিয়ে জিন্দাপার্ক ঘোরার পাশাপাশি শাপলা বিল ঘুরে আসা যায়। এই বিলে যেতে কুড়িল বাস্টস্টেশন থেকে বাসে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত যেতে হবে। সেখান থেকে রিকশায় কিছুদূর গেলেই শিমুলিয়া গ্রাম।
নরাইট বিল
শাপলা ফুলের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। তবে রাজধানীবাসী শাপলার সৌন্দর্য সহজেই উপভোগ করতে পারেন না। এ বিষয় নিয়ে যারা আফসোস করছেন, তারা চাইলে গাজীপুরে গিয়ে দেখে আসতে পারেন শাপলার বিল। কাপাসিয়ার বারিষাব ইউনিয়নের নরাইট বিলে প্রতি বছরই ফোটে শাপলা ফুল। সকাল, দুপুর, বিকাল সব সময় লাল শাপলার সমারোহ যেন এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। সবুজের মাঝে লাল শাপলার বিচরণ দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবাই এখন একে শাপলা বিল নামেই চেনেন। সূর্যের স্বর্ণোজ্জ্বল রশ্মি পানিতে পড়তেই কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় বিলের সৌন্দর্য। বছরের এই সময়ে যারা ঢাকার আশপাশে থাকেন, ছুটে আসেন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ছোট্ট এই গ্রাম এখন ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু। কম খরচে সহজে যাওয়ার জন্য উত্তম জায়গা এটি। এই বিলে নৌকায় চড়ে কাটাতে পারবেন সুন্দর মুহূর্ত। এই বিলের সৌন্দর্য আপনার ক্লান্তি কেড়ে নিয়ে উৎফুল্ল দিয়ে পূর্ণ করে দেবে ক্লান্তির আবরণ।
যারা ঢাকা থেকে এই শাপলার রাজ্যে যেতে চান, তারা মহাখালী থেকে সম্রাট বাসে চালা বাজার গিয়ে নামবেন। চালা বাজার থেকে অটোরিকশা অথবা সিএনজি রিজার্ভ করে সরাসরি শাপলা বিলে চলে আসতে পারেন।
অথবা বর্জ্জাপুর বাজারে নেমে গাড়ি নিতে পারেন কিংবা পশ্চিম দিকের পথ ধরে হেঁটে চলে আসতে পারেন চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পাশেই দেখা মিলবে পদ্মফুলের সঙ্গে এরপরই আপনার কাঙ্ক্ষিত স্থান শাপলা রাজ্য। অন্য বাসে আসতে চাইলে দ্বিতীয় পথটি হলো অনন্যা, উজানভাটি, জালসিড়ি টিকিট কাউন্টার থেকে আমরাইদ বাজারের টিকিট কাটতে হবে। বাস আপনাকে এয়ারপোর্ট-টঙ্গী-গাজীপুর চৌরাস্তা- রাজেন্দ্রপুর-কাপাসিয়া-তরগাঁও হয়ে আমরাইদ বাজার নিয়ে আসবে।
আমরাইদ বাজারে যাওয়ার পর আপনাকে বাস থেকে নামতে হবে। এবার পূর্বদিকের রাস্তা ধরে গেলে গিয়াসপুর বাজার ভায়া জলিল মার্কেট পৌঁছে যাবেন। জলিল মার্কেটে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।
এবার চাইলে অটোরিকশা নিতে পারেন কিংবা উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা আপনার নিজস্ব যানবাহনে করে পৌঁছে যেতে পারেন শাপলা বিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা বিলের জলে ফুটন্ত লাল শাপলা দেখতে ভিড় করছেন সেখানে।