আকাশ ভূঁইয়া
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:২৮ এএম
পাহাড়ি সৌন্দর্যে ঘেরা নেত্রকোণার পাঁচগাও, কলমাকান্দা। ছবি : লেখকের সৌজন্যে
অনেক দিন ধরে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও সেটা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হচ্ছিল না দেশের পরিস্থিতির কারণে। ১১ সেপ্টেম্বর সকালে এক বন্ধুকে বললাম, ‘ঘুরতে যাব, কিছু টাকা লাগবে। যদি দেস তাহলে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব।’ আশ্বাস দিল। আর কে আটকায়। আমার সঙ্গে জয়েন হলো ঢাকার ফাহিম, উত্তরার তৌহিদ ভাই আর জাহিদ। ঢাকা থেকে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই কলমাকান্দা উপজেলা। এ উপজেলায় (রাসেল গেস্ট হাউস) মাত্র ৭০০ টাকায় দুই রুমের একটি হোটেল নিলাম কথা-কাটাকাটি করে!! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ৭টার দিকে হোটেল চেকআউট করে নাশতা করে বেরিয়ে পড়ি পাঁচগাঁওয়ের উদ্দেশে। ছায়াঘেরা সবুজ পাহাড়ি গাঁও। এত দিন শুধু যার গল্প শুনে আসছি। এবার সুযোগ এসেছে নিজ চোখে দেখার।
কলমাকান্দা থেকে রাস্তা ভালো হওয়ায় সাঁই সাঁই করে মোটরযান ছুটে চলল কলমাকান্দার সীমান্ত গ্রাম পাঁচগাঁওয়ের দিকে। রাস্তার দুই ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। আমরা সীমান্তের কিছুদূর যাওয়ার পর সেখানে এসে চোখ একটু কপালে উঠল। এত দিন চোরাই চিনির যে গল্প শুনে আসছিলাম, সেটা এখন নিজের চোখে দেখছি। প্লাটিনা মোটরসাইকেলে করে বস্তায় বস্তায় চিনি আসছে বাংলাদেশে ভারত থেকে। প্রতি গাড়িতে তিনটি করে বস্তা বাঁধা দড়ি দিয়ে।
ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। গাড়ির চাকা ঘুরে পথের দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হতে থাকল চোখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে চলে এলাম, সীমান্ত পাহাড়ের সেই পাঁচগাঁও। সেখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখে আমার কাছে মনে হলো, পাঁচগাঁও কবিতার গাঁও, চুপচাপ বসে পাহাড় দেখার গাঁও।
পাঁচগাঁওয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পাতলাবন, কলমাকান্দা থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশে পাতলাবন ভারত থেকে সুন্দর একটা খাল বয়ে আসছে, এটিই পাহাড়ঘেঁষা গ্রাম পাতলাবন। নামেই বৈচিত্র্য নামেই ভিন্নতা। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোলঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পাতলাবন নামের এই গ্রামটি। দেখে মনে হয় যেন দেশের সেরা ও সবচেয়ে সুন্দর গ্ৰাম এটি।
পাহাড়, নদী, বালুচর মিলে এক প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপের পাতলাবন। মেঘালয় পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদী ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এখানে এলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে করে না চলে যেতে।
পাতলাবন থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে লেংগুরা বাজার, সীমান্তে সোজা রাস্তা দুই পাশে ধানক্ষেত আবার সুউচ্চ পাহাড় মন জুড়িয়ে যায়। আমরা লেংগুরা থেকে বিরিশিরির পথে রওনা দিই। হঠাৎ দেখি পাহাড়ের গা-ঘেঁষে বয়ে চলা সোমেশ্বরীর নদী। এই নদীর বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছ পানি। পানিতে অনায়াসে নিচের বালু দেখা যায়। নৌকা নিয়ে মাঝিরা নদীতে ঘুরে বেড়ান। কেউ মাছ শিকার করেন, কেউবা ঘুরে ঘুরে পর্যটকদের নদীর সৌন্দর্য দেখান। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কম। পাহাড়ের ঢাল থেকে বয়ে আসা ঝরনার পানিই এই নদীর মূল উৎস। ঝরনার পানি হওয়ায় ইহা অতি স্বচ্ছ ও ঠান্ডা।
সোমেশ্বরী নদীতে ঘুরে বেড়ালেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষে সবুজঘেরা ও লাল চীনামাটির অসংখ্য পাহাড়। এর সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যাবে না। এ ছাড়া নদীর তলদেশে বালুর ওপর নুড়িপাথর পড়ে থাকতে দেখবেন। নদী পারাপারের জন্য বড় নৌকার মাধ্যমে মানুষের পাশাপাশি মোটসাইকেল ও অন্যান্য ছোট যানবাহন চলাচল করে।
নদী পার হয়ে আমরা ওপারে যাই গন্তব্য বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় ও লেক। সুসং দুর্গাপুর, এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়ায় বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড় অবস্থিত। নেত্রকোণা জেলার উল্লেখযোগ্য প্রকৃতিক সম্পদ হলো বিজয়পুরের সাদা মাটি, পাহাড়, নদী আর সবুজ নীলের মিশেলে হ্রদটি আপনার সব ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেবে।
রহস্য হলো নীল পানির হ্রদ আর তার বুক চিরে জেগে ওঠা সাদা রঙের কয়েকটি পাহাড়, মানে চীনামাটির পাহাড়; যা বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। বিশাল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ নীলচে পানির ছোট হ্রদ ও তার পাশে জেগে ওঠা সাদা মাটির পাহাড় এবং পাশে থাকা গ্রামীণ অপরূপ দৃশ্য মন জুড়িয়ে যায়। আমাদের রোডম্যাপ ছিল নেত্রকোণা-কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও-পাতলাবন-লেংগুরা বাজার-মমিনের টিলা-লেংগুরা বাজার-সুসং-দুর্গাপুর-দুর্গাপুর ঘাট-বিজয়পুর চীনামাটির লেক/পাহাড়-বিজিবি ক্যাম্প-কমলা বাগান -দুর্গাপুর ঘাট-দুর্গাপুর বাজার টু ময়মনসিংহ।
কীভাবে যাবেন বিজয়পুর
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেতে হবে নেত্রকোণা। সেখান থেকে সুসং দুর্গাপুর। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি দুর্গাপুর যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে।
দুর্গাপুরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। সেগুলোর ভাড়াও খুব কম। আর নেত্রকোণা গেলে অবশ্যই সেখানকার বিখ্যাত খাবার বালিশমিষ্টি খেতে ভুলবেন না।