× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হারিয়ে যাওয়া এক রাজধানীর খোঁজে

এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:১২ পিএম

মহম্মদপুরে অবস্থিত রাজা সীতারাম রায়ের কাচারিবাড়ির প্রবেশদ্বার

মহম্মদপুরে অবস্থিত রাজা সীতারাম রায়ের কাচারিবাড়ির প্রবেশদ্বার

বাংলার সতেরো শতকের ইতিহাসে রাজা সীতারাম রায় আলোচিত এক নাম। যিনি ক্ষুদ্র একজন জায়গিরদার থেকে মুঘল ফরমানবলে ‘রাজা’ হয়ে ওঠেন। মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেন স্বল্পস্থায়ী সার্বভৌম এক হিন্দু রাজ্য। রাজা হওয়ার পর তিনি মাগুরা জেলার মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। আজ থেকে ৩০০ বছরেরও বেশি আগে সীতারাম পরলোকগমন করলেও তার কীর্তি এখনও অমলিন। বিস্তারিত লিখেছেন এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ

‘দিগ্বিবিজয় প্রকাশ’ নামক হিন্দু ভৌগোলিক গ্রন্থ এবং ‘(ভারতীয় ঐতিহাসিক) জীবনী কোষ’-এ উল্লেখ আছেÑ ধেনুকর্ণ নামে এক ক্ষত্রিয় নৃপতি তীর্থ ভ্রমণে যশোরে এসে রাজ্য স্থাপন করেন। এ ধেনুকর্ণের পুত্র কণ্ঠহারের উপাধি ছিল ‘বঙ্গভূষণ’। বঙ্গভূষণ যশোরের উত্তরাংশ অধিকার করে রাজত্ব করতেন। তার নামানুসারে এ রাজ্যের নাম হয় ‘ভূষণ’; যা পরে ‘ভূষণা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ভূষণার অবস্থান বর্তমান মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা এবং ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায়। ভূষণার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। মুঘল আমল থেকে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ শহরটির নাম বারবার উচ্চারিত হয়। মুঘল শাসনামলে এ শহর সাতৈর পরগনার অধীন ছিল। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে শহরটি দখলে নেন বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা মুকুন্দরাম রায়। মুকুন্দরাম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যথাক্রমে চাঁদ রায় এবং কেদার রায়ের দখলে আসে ভূষণা। তবে প্রতিপত্তিশালী মুঘল কর্তৃপক্ষ বেশি দিন ভূষণার ক্ষমতা বারো ভুঁইয়াদের হাতে থাকতে দেয়নি। মানসিংহ বাংলার সুবাদার হয়ে এসেই ১৫৯৫-৯৬ সালে ভূষণা অভিযানে সেনা পাঠান। কেদার রায় ওই যুদ্ধে আহত হয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে ঈশা খাঁর আশ্রয় নেন। ১৫৯৮ সালের দিকে ভূষণা চলে যায় মুকুন্দরামের ছেলে রাজা সত্রাজিৎ রায়ের হাতে। সত্রাজিৎ কোচ রাজা পরীক্ষিত নারায়ণের ভাই বলিনারায়ণের সঙ্গে মুঘলদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ষড়যন্ত্রের অপরাধে সত্রাজিৎকে প্রাণদণ্ড দেয় মুঘল কর্তৃপক্ষ। এরপর ভূষণা বেশ কিছুকাল মুঘল সেনাপতি সংগ্রাম শাহের ‘নওয়ারা’ মহলভুক্ত থাকে। সংগ্রামের মৃত্যুর পর তার একমাত্র ছেলে রাধাকান্ত কিছুকাল জায়গির ভোগ করে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে ভূষণা অঞ্চল খাস হয়।

সীতারামের জন্ম, শৈশব এবং উত্থান

ভূষণা অঞ্চল খাস হওয়ার পর মুঘল ফৌজদারের আসন ফাতেহাবাদ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ভূষণায় আসে। এ সময়ে ভূষণার ফৌজদারের অধীনে তহশিলদার হিসেবে ভূষণায় আসেন মুঘল কর্মচারী উদয়নারায়ণ। উদয় ছিলেন রাজমহলে নবাব সরকারের কর্মচারী। কর্মসূত্রে তিনি রাজমহল থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে ভূষণায় স্থানান্তরিত হন। উদয়নারায়ণের স্ত্রীর নাম দয়াময়ী। আনুমানিক ১৬৫৮ সালের দিকে উদয়নারায়ণ এবং দয়াময়ী দম্পতির সন্তান সীতারামের জন্ম। কে জানত, মুঘল ফরমানবলে এ সীতারামেরই নামের সঙ্গে যুক্ত হবে ‘রাজা’ উপাধি! কেউ কি ভেবেছিল, সামান্য এক মুঘল তহশিলদারের ছেলে বাংলায় সার্বভৌম হিন্দু রাজ্য স্থাপন করে বসবেন? কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় এমনটাই ঘটেছিল।

সীতারামের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার মহীপতিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। সেখানের চতুষ্পাঠিতেই সংস্কৃত এবং বাংলায় শিক্ষা লাভ করেন। ১০-১২ বছর বয়সে বাবার চাকরির সুবাদে স্থায়ী হন ভূষণায়। ভূষণায় এসে রাজভাষা হিসেবে শেখেন ফারসি। রপ্ত করেন উর্দু, আরবিও। তবে এসবের পাশাপাশি তিনি ঘোড়া চালানো এবং সমরবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সেকালে রাজভাষা ও সমরবিদ্যায় পারদর্শীরা সেনাবাহিনীতে চাকরির আশায় রাজদরবারে আনাগোনা করতেন। নিজেকে প্রস্তুত করার পর সীতারামও বাবার সঙ্গে ঢাকায় নবাব শায়েস্তা খাঁর দরবারে যাতায়াত করতেন।

সে সময় করিম খাঁ নামে এক পাঠান বিদ্রোহী সাতৈর পরগনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিলেন। এ বিদ্রোহ দমনে ফৌজদার ব্যর্থ হলে নবাব সেনা পাঠাতে মনস্থির করেন। সীতারাম তখন নবাবকে ওই অভিযানে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে নবাব তার সঙ্গে কয়েক হাজার পদাতিক ও অশ্বারোহী সেনা পাঠালেন। এটাই ছিল সীতারামের জীবনের প্রথম পরীক্ষা। করিম খাঁ পরাজিত ও নিহত হয় সীতারাম বাহিনীর কাছে। এ বিজয়ে খুশি হয়ে নবাব ভূষণার অন্তর্গত নলদী পরগনা জায়গির দিয়ে সীতারামকে পুরস্কৃত করেন। এখান থেকেই উত্থান সীতারামের।

জায়গিরদার থেকে রাজা

জায়গির লাভ করে সীতারাম ফিরে আসেন নলদীতে। বর্তমান মহম্মদপুরের কাছে সূর্যকুণ্ডু গ্রামে আগেই তৈরি করা নলদী পরগনার কাচারিবাড়িটি সংস্কার করে নিজের বসবাসোপযোগী করেন। প্রথমেই মনোযোগ দেন পরগনার শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার ওপর। কেননা নলদী পরগনাসহ দক্ষিণবঙ্গে তখন মগ জলদস্যু ও দেশি ডাকাতরা প্রায়ই অত্যাচার চালাত। সীতারাম সূর্যকুণ্ডু ও হরিহরনগর গ্রামে সেনা সংগ্রহ শুরু করেন এবং গড়বেষ্টিত সৈন্যাবাস স্থাপন করেন। দস্যুবৃত্তি দমন করে পরগনায় শান্তি আনেন। অল্প সময়ের মধ্যে সীতারাম হয়ে ওঠেন একজন প্রজাবৎসল জমিদার। এ সময়ই গ্রাম্য কবিরা গান রচনা করেছিলেনÑ ধন্য রাজা সীতারাম বাঙ্গালা বাহাদুর/যার ভয়েতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেল দূর/বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে/রামী শ্যামী পোঁটলা বেঁধে গঙ্গাস্নানে যাবে।’

এ গানে সীতারামকে রাজা বলা হলেও মূলত তখনও তিনি রাজা উপাধি পাননি। স্থানীয় জনগণ তাদের জমিদারকে রাজা বলেই সম্বোধন করত। এ গানের রাজা শব্দ তারই বহিঃপ্রকাশ। মগ জলদস্যু ও পাঠান বিদ্রোহীদের দমন এবং নিষ্ঠা আর বীরত্বের জন্য ১৬৮৭ সালের দিকে সীতারামকে ‘রাজা’ উপাধি এবং সুন্দরবন পর্যন্ত আবাদি সনদ দেয় মুঘল কর্তৃপক্ষ। রাজা উপাধির ফরমান নিয়ে নিজ পরগনায় ফেরত আসেন সীতারাম। পুরো পরগনা মেতে ওঠে আনন্দে। রানী কমলার সঙ্গে উপবিষ্ট হন রাজতক্তে এবং হিন্দুধর্ম অনুযায়ী সম্পন্ন করেন যজ্ঞানুষ্ঠান।

রাজধানী স্থাপন এবং নামকরণ

রাজা উপাধি প্রাপ্তির পর বহু অনুসন্ধান শেষে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিবেচনায় বাগজানি মৌজায় তিনি রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। কেননা নির্বাচিত স্থানটির উত্তর-পূর্বে কালীগঙ্গা, পশ্চিমে ছত্রপতি এবং পূর্বে মধুমতী নদীর অবস্থান। তিন পাশ প্রাকৃতিক জলাধারের মাধ্যমে সুরক্ষিত স্থানটির পূর্ব থেকে পশ্চিমে ১ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ২০০ ফুট প্রস্থের একটি পরিখা খনন করে সীতারাম নতুন রাজধানীর চারপাশে জলপ্রাচীর নিশ্চিত করেন।

নতুন রাজধানীর নাম রাখেন ‘মহম্মদপুর’! হিন্দু রাজা, হিন্দু রাজ্য অথচ রাজধানীর নাম মহম্মদপুর কেন রাখলেন, তা নিয়ে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত ব্যাপার আলাদা। প্রথমত. তিনি প্রবল প্রভাবশালী মুসলিম সাম্রাজ্যের একজন ক্ষুদ্র জায়গিরদার। সাম্রাজ্যের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের বিনিময়ে পুরস্কৃত হয়েছেন রাজা খেতাবে। ইতোমধ্যে সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠার অভিসন্ধি নিয়ে বহু পাঠান সেনা যুক্ত করেছেন নিজস্ব সেনাবাহিনীতে। এমনকি নিজের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা খাঁ, দোস্ত মাবুদ সরদার, সোনাগাজী সরদার এবং গোলামী সরদার নামীয় চার মুসলিম পাঠান সেনাকে। তার দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতিও ছিলেন মুসলিম। তা ছাড়া মুসলমান প্রজারা তো ছিলই। সীতারাম ভালো করেই জানতেন, মুসলিম সেনা এবং প্রজার পূর্ণ সমর্থন না থাকলে তিনি কখনই মুঘলদের বিরুদ্ধাচরণ করে নিজ আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে পারবেন না। ঠিক এ কারণেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়টি মাথায় রেখে সম্রাট, নবাব, নিজ রাজ্যের মুসলিম প্রজা এবং সেনা সবাইকে খুশি রাখতে সীতারাম শেষ নবীর নামানুসারে রাজধানীর নামকরণ করেন মহম্মদপুর।

মহম্মদপুর নগরীর স্থাপনা

১৬৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত মহম্মদপুরকে তিনি তিন দিকে প্রাচীর বেষ্টিত একটি দুর্গনগরী হিসেবে গড়ে তোলেন। দুর্গের ভেতরে স্থাপন করেন সেনাছাউনি। নিজ বসবাসের জন্য একাধিক অট্টালিকা, প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিংহদরজার পাশেই কাচারিবাড়ি, জেলখানা, তৈজসপত্র সংরক্ষণের জন্য তোশাখানা, বিনোদনের জন্য নহবতখানা নির্মাণ করেন। নগরে সুপেয় পানি সরবরাহ এবং বন্যার পানি প্রতিরোধে খনন করেন রামসাগর, কৃষ্ণসাগর, দুধসাগর, শ্বেতসাগর, সুখসাগর, পদ্মপুকুর, ধনাগার পুকুরসহ অসংখ্য জলাধার। হিন্দু রাজ্য স্থাপনের বাসনা নিয়ে রাজধানীজুড়ে নির্মাণ করেন অসংখ্য মন্দির। যার মধ্যে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন দশভুজা মন্দির, ১৭০৫ সালে নির্মিত লক্ষ্মীনারায়ণের অষ্টকোণ মন্দির, ১৭০৩ সালে স্থাপিত কানাইনগরের পঞ্চরত্ন মন্দির, গোপালপুরের বুড়া শিবের মন্দির, রাজপ্রাসাদের সামনে অবস্থিত জোড়বাংলা মন্দির ও দোলমন্দির, নলিয়া জোড়বাংলা মন্দির উল্লেখযোগ্য।

বক্স আলীর সেনারাও মহম্মদপুর অভিমুখে অগ্রসর হয়। বক্স আলী ও দয়ারামের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হন সীতারাম। নিজ রাজ্য রক্ষায় শেষ পর্যন্ত প্রাণপণে সেনাদের নিয়ে লড়ে যান এবং আহত অবস্থায় ১৭১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিপক্ষ সেনাদের হাতে ধরা পড়েন

মহম্মদপুরের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাণিজ্য

রাজধানীতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পন্ন হলে সীতারাম রাষ্ট্রীয় পরিষেবা পরিচালনা করেন। তিনি কারিগর ও বণিকদের মহম্মদপুরে ব্যবসা স্থাপনে উৎসাহিত করেন। সীতারামের আহ্বানে মহম্মদপুরে এসে কেউ কাপড় বুনন, কেউ চারুশিল্প, কেউ বা যুদ্ধোপযোগী বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ শুরু করেন। ইংল্যান্ডে তখনও কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়নি; অথচ সীতারামের রাজ্যের তল্লাবেড়, বিনোদপুর, রামপুর, বরিশাট প্রভৃতি গ্রামে পাট, কাপড় ইত্যাদি পচিয়ে বিশেষ এক ধরনের কাগজ প্রস্তুত হতো। ওই কাগজ পরিচিত ছিল ‘ভূষণাই কাগজ’ নামে। ভূষণায় বেশ কয়েক প্রকারের কাপড় তৈরি হতো। ‘বনাত মখমল পট্ট ভূষণাই খাসা, বুটাদার ঢাকাইয়া দেখিতে তামাশা!’ এভাবেই রামপ্রসাদ সেনের ভাষায় ভূষণার কাপড়ের প্রশংসা ফুটে উঠেছে বিদ্যাসুন্দর কাব্যে।

শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সীতারাম অসামান্য অবদান রাখেন। শুধু রাজধানী শহরেই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, সাহিত্য ইত্যাদি শিক্ষার জন্য ২২টি পাঠশালা গড়ে ওঠে। যার মধ্যে তিনটি ছিল মক্তব। এ তিন মক্তবে মৌলভি শামসুদ্দিন, তোফেল বেগ ও আহমদ গাজী শিক্ষকতা করতেন। আয়ুর্বেদশাস্ত্র শিক্ষার জন্যও ছিল পাঁচটি কবিরাজি চতুষ্পাঠী। মোট কথা অবকাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাণিজ্যে মহম্মদপুর এতটাই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে, সীতারাম-পরবর্তী বহুদিন পর্যন্ত শহরটির ঐশ্বর্য অটুট ছিল। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে এখানেই যশোর জেলা সদর মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল!

রাজ্য বিস্তার

স্বাধীন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়েই স্বাধীন রাজার মতো সীতারাম বিস্তার ঘটান নিজ রাজ্যের। সর্বপ্রথম তিনি রাজা সত্রাজিৎ রায়ের প্রপৌত্র কৃষ্ণপ্রসাদের মৃত্যুর পর তার ছেলেদের নাবালকত্বের সুযোগে পোকতানি, রোকনপুর, রুপাপাত এবং রসুলপুর পরগনা অধিকারে নিয়ে নেন। পরমানন্দের কাছ থেকে মকিমপুর এবং দৌলত খাঁ পাঠানের উত্তরাধিকারীদের থেকে নসিবশাহী, বেলগাছি, নসরতশাহী ও মহিমশাহী পরগনা দখল করেন। একে একে জনার্দ্দন সমাদ্দারের তারাউজিয়াল, কৃষ্ণকান্ত ও রামকিশোর শিরোমণির খড়োরিয়া তার হস্তগত হয়। বাগেরহাটের রামপাল পরগনা এবং দেবকীনন্দন বসুকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরুলিয়া দখল করেন। এমনকি নলডাঙ্গার রাজা রামদেবের মামুদশাহী পরগনা আক্রমণ করে বড় একটা অংশ দখল করে নেন। তবে সীতারাম যখন একের পর এক ছোট ছোট জমিদারি দখল করছিলেন, তখন কেউ তাকে বাধা দেয়নি বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। ১৭০৩-৪ সালের দিকে একবার রাজধানীতে সীতারামের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে চাঁচড়ার রাজা মনোহর মহম্মদপুর আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। ওই সময় সীতারাম অবস্থান করছিলেন নসিবশাহী পরগনায়। রাজধানীর ভার ন্যস্ত ছিল রাজ্যের দেওয়ান যদুনাথ মজুমদারের ওপর। চাঁচড়ারাজ সেনাসামন্তসহ রাজধানীর দিকে অগ্রসর হয়ে বুনাগাতির দক্ষিণ দিকে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছাউনি ফেলে বসেন। সংবাদ পাওয়ামাত্রই যদুনাথ বেশ কিছু সেনা এবং ছোটবড় কয়েকটি কামান নিয়ে মহম্মদপুর থেকে রওনা হয়ে কুল্লে-কুচিয়ামোড়ার কাছে উপস্থিত হন। সারি সারি কামানের ভয়ে চাঁচড়ার সেনারা শরশুনা গ্রাম থেকে উত্তরে অগ্রসর হওয়ার সাহস ত্যাগ করে। মূলত সীতারামের বাহিনীর যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম দেখে মনোহর যুদ্ধের খায়েশ ত্যাগ করে রাতারাতি সদলবলে নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।

রাজ্যের সীমানা ও বার্ষিক রাজস্ব

এভাবেই আশপাশের দুর্বল জমিদারদের জমিদারির ৩০টির বেশি পরগনা দখল করে সীতারামের রাজ্যের উত্তর সীমানা পদ্মা নদী পেরিয়ে পাবনার দক্ষিনাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সীতারামের রাজ্যের দক্ষিণ সীমায় ছিল বঙ্গোপসাগর, পূর্ব সীমায় আড়িয়াল খাঁ নদ ও বরিশালের কিয়দংশ এবং পশ্চিম সীমান্ত যশোর জেলা সদর ও নদীয়া জেলার পূর্বাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সব মিলিয়ে তার রাজ্যের আয়তন দাঁড়ায় ৭ হাজার বর্গমাইল তথা ১৮ হাজার ১২৩ বর্গকিলোমিটার প্রায়; যা বর্তমান মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার সমান। তার রাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব ছিল ৭৮ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে।

মুঘল-অধীনতা অস্বীকার ও ভূষণা দুর্গ দখল

সীতারামের এভাবে রাজ্য বিস্তার এবং বর্ধিত রাজ্য রক্ষণাবেক্ষণে দুর্গ নির্মাণ মুঘল কর্তৃপক্ষের মোটেও পছন্দ হয়নি। কিন্তু তৎকালীন বাংলার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নিজস্ব বাহুবল ও সুদক্ষ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব, অসংখ্য কামান ও আধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম এবং বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের রাজত্ব সীতারামকে একক অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। এ সময় তিনি নবাব তথা মুঘল কর্মকর্তাদের সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য এবং তার জমিদারি সীমার মধ্যে প্রবেশে বাধা দেওয়া শুরু করেন। নবাব সরকারের রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে স্বাধীন রাজার মতোই প্রবর্তন করেন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। তার সেনাদের সঙ্গে মুঘল ফৌজদার সেনার ঝামেলা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ মুঘল ফৌজদার মীর আবু তোরাব বেশ কয়েকবার সীতারামের বিরুদ্ধে সেনা পাঠিয়েও তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন। হঠাৎ একদিন বারাসিয়া নদীর তীরে আবু তোরাব এবং সীতারামের বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে নিহত হন আবু তোরাব। অবশ্য রিয়াজ-উস-সালাতিন এবং তারিখ-ই-বাঙ্গালা গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, আবু তোরাব বারাসিয়া তীরে সীতারামের সঙ্গে যুদ্ধে নয় বরং মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানেই সুযোগ বুঝে সীতারাম তাকে হত্যা করেন। যা হোক, আবু তোরাবকে হত্যা করে সীতারাম ভূষণা দুর্গ দখল করেন।

মহম্মদপুরের পতন ও সীতারামের পরিণতি

ভূষণা দখল করে সীতারাম রাজধানীর দায়িত্বে প্রধান সেনাপতি মেনাহাতিকে নিযুক্ত করে নিজে দুর্গে থেকে যান। মুর্শিদাবাদে তোরাবের মৃত্যু ও ভূষণা দখলের খবর পৌঁছালে মুর্শিদকুলি খাঁ দ্রুততার সঙ্গে নিজ আত্মীয় বক্স আলী খাঁকে ফৌজদার নিযুক্ত করে সেনাসহ সীতারামের বিরুদ্ধে পাঠান। মহম্মদপুরের পাশের সব জমিদারের প্রতি কঠোর ফরমান জারি করেন সবাই যেন সীতারামের বিরুদ্ধে বক্স আলীকে সহযোগিতা করেন। এমন নির্দেশে নলডাঙ্গার রাজা রামদেব প্রস্তুত হন। বক্স আলীর সঙ্গে সহকারী হয়ে আসেন নাটোরের দীঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায় এবং মুর্শিদাবাদের সুবাদারি সেনাদের অধিনায়ক সংগ্রাম সিংহ।

বক্স আলী খাঁ সংগ্রাম সিংহকে সঙ্গে নিয়ে ফৌজদারি সেনার সহায়তায় ভূষণা দুর্গ অবরোধ করে বসেন। অন্যদিকে দয়ারাম রাজধানী মহম্মদপুর আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। তিনি নদীপথে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গড়াই নদী হয়ে লাঙ্গলবাঁধ দিয়ে কুমার নদের তীরে বরিশাট গ্রামে পৌঁছান। বরিশাট থেকে গড়াই-নবগঙ্গা-মধুমতী হয়ে মহম্মদপুরের পূর্ব পাশে ছাউনি ফেলেন। মধুমতীর পূর্বকূলসংলগ্ন ‘দয়ারামপুর’ গ্রাম তার ছাউনির স্থান হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেখানে থেকে দয়ারাম সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে কৌশলে সেনাপতি মেনাহাতিকে হত্যা করেন। ভূষণায় অবরুদ্ধ সীতারাম নিজ সেনাপতির মৃত্যুর খবরে বিপন্ন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। উবে যায় তার রাজ্য রক্ষার আশা। ভূষণা দুর্গ ও মহম্মদপুর একই সঙ্গে রক্ষা করার কল্পনা ত্যাগ করে দুর্গ ছেড়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে রাজধানী রক্ষায় তিনি পালিয়ে মহম্মদপুরে চলে আসেন। এরপর বক্স আলীর সেনারাও মহম্মদপুর অভিমুখে অগ্রসর হয়। বক্স আলী ও দয়ারামের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হন সীতারাম। নিজ রাজ্য রক্ষায় শেষ পর্যন্ত প্রাণপণে সেনাদের নিয়ে লড়ে যান এবং আহত অবস্থায় ১৭১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিপক্ষ সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সীতারাম ধরা পড়ার আগেই রানী এবং সন্তানরা পালিয়ে যান দুর্গ থেকে। দয়ারাম রায়ের তত্ত্বাবধানে সীতারামকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। সেখানে কয়েক মাস কারাভোগের পর নবাবের আদেশে একই বছরের অক্টোবরের দিকে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যুদ্ধে সীতারামের পরাজয়ের পর তার রাজ্যের নলদী ও ভূষণা নাটোর রাজবংশকে দিয়ে দেওয়া হয়। অন্যান্য অংশ পাশের জমিদারদের মাঝে বণ্টন করে দেন নবাব। এভাবেই পতন ঘটে সীতারামের রাজ্য এবং রাজধানী মহম্মদপুরের। এখানেই শেষ হয় বাংলার স্বল্পমেয়াদি সার্বভৌম হিন্দু রাজ্যের উপাখ্যান।

মহম্মদপুরে এখন আর রাজা সীতারাম নেই। নেই কোনো রাজকীয় পেয়াদা। শুধু টিকে আছে রূপলাবণ্যহীন অবস্থায় সীতারামের কাচারিবাড়ি, দোলমন্দির, খাসমহলের ধ্বংসাবশেষ, রামসাগর, কৃষ্ণসাগর, ধনাগার পুকুর প্রভৃতি জলাধার আর ‘ভূষণা’ নামে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার একটি গ্রাম। এসব স্থাপত্যকীর্তি এখনও বয়ে চলেছে রাজা সীতারামের স্মৃতি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা