নাদিম মজিদ
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:২৯ পিএম
মালয়েশিয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইয়ুথ হাবের সদস্যরা ছবি: সংগৃহীত
দুই বাংলাদেশির হাত ধরে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইয়ুথ হাব। এটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সবার জন্য গুণগত পড়াশোনা, টেক শিক্ষা, গার্লস ইন আইসিটি, সামাজিক উদ্ভাবন প্রভৃতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়াসহ ৬টি দেশে। একসময় মালয়েশিয়ানরা মনে করত, বাংলাদেশ নিম্ন-আয়ের দেশ, কিন্তু ইয়ুথ হাবের কারণে পরিচিতি পাচ্ছে প্রযুক্তিপ্রেমী দেশ হিসেবে। লিখেছেন নাদিম মজিদ
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে পাভেল সরওয়ারের জন্ম। নিজে কাজ করেন প্রযুক্তি নিয়ে। আছেন গুগলের কমিউনিটিতে যুক্ত। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতেন। ব্যবসার প্রয়োজনে ২০১৬ সালে তিনি মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সঙ্গে নিয়ে যান নিজের জীবনসঙ্গী সুমাইয়া জাফরিন চৌধুরীকে। সুমাইয়াও একজন স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়নকর্মী। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরে প্রথম কিছুদিন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে মনোযোগ দিলেন। কিছুদিন যাওয়ার পরে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করতে না পেরে হাঁপিয়ে ওঠলেন। মালয়েশিয়া ভিন্ন দেশ, ভাষা আলাদা, পরিচিত মানুষ বেশি নেই। চাইলেই কোনো প্রোগ্রাম করা যাবে না। তারপরও মনের সাহসে তারা ২০১৭ সালে শুরু করেন ইয়ুথ হাব।
একজন শিশু ভবিষ্যতে যেখানেই যাক, যে পেশায় থাকুক- তার জন্য আইটি স্কিল থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই, তারা শিশুদের মধ্যে আইটি স্কিলে আগ্রহী করে তোলার পরিকল্পনা নেন। তারা তাদের পরিকল্পনার কথা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তিকে উপস্থাপন করেন। তাদের পরিকল্পনায় প্রথম রাজি হন মুরাদ ফাউন্ডেশনের প্রধান দাতো মুরাদ আহমেদ। তিনি বলেন, আমি তোমাদের ৪০টি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সামনে কথা বলার সুযোগ করে দিব। যদি তারা তোমাদের প্রস্তাবে একমত হয়, তাহলে এ ধরনের প্রোগ্রাম করার জন্য আমি তোমাদের সহযোগিতা করব। প্রধান শিক্ষকদের প্রোগ্রামে তারা তাদের পরিকল্পনার কথা উপস্থাপন করেন। তাদের বলেন, ‘আমাদের শিশুরা ভবিষ্যতে যা-ই হোক না কেন, আইটি স্কিল থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভবিষ্যৎ হলো তথ্যপ্রযুক্তিতে।
আর, তাই, বয়স কম থাকতেই তাদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।’ ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে পরিচিত করা, তাদের কোডিং সম্পর্কে মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো, শিক্ষার্থীদের তাদের স্কুল জীবন থেকে কম্পিউটার শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করা, আইসিটি ও স্টেম এবং বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং সম্পর্কিত তাদের দক্ষতা উন্নত করা।
স্কুলগুলোতে প্রোগ্রাম শুরু করার সময় নানা প্রতিবন্ধকতা পেরুতে হয়েছে। তারা সে সময় ইংরেজিতে কথা বলত। কিন্তু ইংরেজি মালয়েশিয়ার ভাষা না হওয়ায় ঠিকমত বুঝাতে পারত না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষকেরা সহযোগিতা করত। প্রোগ্রাম জনপ্রিয় করার জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ডিভাইস নিয়ে যেত। কমখরচের ডিভাইসের জন্য গুগলের কার্ডবোর্ড ব্যবহার করত। শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিংয়ে আকৃষ্ট করতে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখানো হতো। স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং হলো এমন এক ধরনের প্রোগ্রামিং, যা ওয়েবসাইটে ড্রাগ অ্যান্ড ড্রপ করে গেইম বা সফটওয়্যার বানানো যায়। দেখতে দেখতে তাদের দিনব্যাপী প্রোগ্রাম মালয়েশিয়াতে জনপ্রিয় হতে লাগল। বিভিন্ন স্কুলে ভিজিট করতে গেলে পাভেল ও সুমাইয়াকে দেখে সেখানকার ছাত্র ও শিক্ষকেরা দেশের নাম জানতে চান। যখন শুনেন বাংলাদেশ- তারা অবাক হয়ে যান।
কারণ, তারা প্রতিনিয়ত তাদের চোখের সামনে দেখেন, বাংলাদেশিরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। অথচ, স্কুলে আইসিটির মতো জটিল বিষয় সহজ এবং মজার হিসেবে উপস্থাপন করছে এ বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণেরা। ধারাবাহিকভাবে কাজ করার কারণে ইয়ুথ হাব মালয়েশিয়ার সিএসও এসডিজি অ্যালায়েন্সের সদস্যপদ পেয়েছে ২০২২ সালে। এ অ্যালায়েন্সটি মালয়েশিয়ায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের একটি স্বাধীন কণ্ঠ হিসেবে কাজ করে।
ইয়ুথ হাবের কাজ
ইয়ুথ হাব জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসডিজি বুটক্যাম্প, কোয়ালিটি অ্যাডুকেশন, গার্লস ইন আইসিটি, স্কুল প্রেনারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশেও কাজ করছে
মালয়েশিয়াকে কেন্দ্র করে ইয়ুথ হাব শুরু হলেও বাংলাদেশে কাজ করে ইয়ুথ হাব। ইয়ুথ হাবের এক্সিকিউটিভ বডির বেশিরভাগ সদস্য প্রবাসী বাংলাদেশি হওয়ায় তাদের নিজেদের কাজের পাশাপাশি সামাজিক কাজও করে থাকে। ত্রাণ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, কুরআন বিতরণ, বৃক্ষরোপণ, বিনামূল্যে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সেনেটারি নেপকিন বিতরণ, শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ নানা কার্যক্রম এ দেশে পরিচালনা করে। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ছাড়াও ইয়ুথ হাবের কার্যক্রম চালু আছে নেপাল, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সিয়েরা লিওনে। বাংলাদেশ, স্থানীয় মালয়েশিয়ান ও অন্যান্য দেশের ১ হাজারের বেশি শিশু কিশোর ইয়ুথ হাব থেকে স্ক্রেচ, পাইথন, এমআইটি এপ ইনভেন্টর, এপ মেকার প্লাস শিখেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো শিক্ষক ও ল্যাব সুবিধা ঠিকমতো না থাকায় তাদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইয়ুথ হাবের।