× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আড়িয়ল বিলের পানির রাজ্যে

ইকরামুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:২৮ এএম

ছবি : লেখক

ছবি : লেখক

আড়িয়ল বিলে গেলেই চোখে পড়বে এক পানির রাজ্য। জল ও জঙ্গলের দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। দেখবেন পানির মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শাপলা ফুলের কলি। আর আকাশে মেঘের ভেলায় উড়ে বেড়াচ্ছে পাখির দল। শ্রীনগর বাজারের চারপাশটা পানিতে ভরপুর আর নদীর দুধারে প্রচুর কাশফুল ফুটে থাকে শরতের এ সময়। লিখেছেন ইকরামুজ্জামান ভূঁইয়া

চারদিকে বিশাল জলরাশি। এতে ফুটে আছে বাহারি শাপলা। ছোট ছোট নৌকায় শিশুসহ বয়স্কদের কেউ কেউ মাছ ধরছেন আবার কেউ শাপলা তুলছেন। জলরাশির মধ্যেই কয়েকটি বিশালাকার গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখে মুহূর্তেই আপনি হারিয়ে যাবেন কল্পনার জগতে।

ঠিক যেন কল্পনার জগৎ এটি! তবে কল্পনায় নয়, বাস্তবেই এমন এক স্থান আছে। বলছি আড়িয়াল বিলের কথা। পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত এই বিলটি। মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি অবভূমি। জানলে অবাক হবেন, এটিই দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল হিসেবে পরিচিত। পরিকল্পনা করলাম বন্ধুরা মিলে যাব এই বিল ঘুরতে। ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়া ঘাটের গাড়িতে উঠে শহর-নগর-নদী পেরিয়ে দুপাশের সবুজ মাঠে চোখ বোলাতে বোলাতেই চলে এলাম শ্রীনগর বাজার। পানিতে থই থই করছে শ্রীনগর বাজারের চারপাশ। কালভার্টের নিচ দিয়ে বিলের দিকে ছুটছে খালের পানি। সেদিকে তাকিয়েই মনটা আনন্দে নেচে উঠল; অনেক পানি পাওয়া যাবে তাহলে। ভেজবাজার নামের এক জায়গা থেকে ট্রলার নিলাম। দিনচুক্তি ভাড়া। আমাদের বিকালে আবার এখানে নামিয়ে দেবে।

বিস্তীর্ণ বিলে জন্মানো শাপলার সমাহার

ঢাকা থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত আড়িয়াল বিল। এর আয়তন ১৩৬ বর্গকিলোমিটার। ধারণা করা হয়, অতীতে এ স্থানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল ছিল। পরে উভয় নদীর প্রবাহে পরিবর্তন ঘটায় স্থানটি শুষ্ক হয়ে বিলে পরিণত হয়। এ বিলের সৌন্দর্যের টানে পর্যটকরা ভিড় জমান সেখানে। এখনই আড়িয়াল বিল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর বাজার থেকে একটি সড়ক এঁকেবেঁকে চলে গেছে আড়িয়াল বিলের দিকে। এ পথে শ্যামসিদ্ধি গ্রাম পেরিয়ে আরও সামনে গেলে গাদিঘাট। ওই পর্যন্ত পিচঢালা পথ। সেখান থেকে কালভার্ট পেরিয়ে আরও কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলে সড়কের শেষ মাথা। আড়িয়াল বিলের শুরু মূলত গাদিঘাট থেকেই।

ট্রলারঘাট থেকে ছোট্ট একটা খাল পেরিয়ে যেতে হয় মূল বিলে। শুরুর দিকের পানিটুকু অনেক ঘোলা। কিছুদূর পেরোতেই বদলে যেতে থাকে দুপাশের দৃশ্যপট। সবুজের মিছিলে একটু একটু করে জানান দিতে থাকে নীলচে পানির ছটা। সেই পানির ওপর কমা-দাঁড়ি-সেমিকোলনের মতো সাদাটে মেঘের আনাগোনা! শ্রীনগর এলাকার মূল সৌন্দর্য এখানকার দোচালা-চৌচালা সব টিনের ঘরবাড়ি। পাটাতন দেওয়া সেসব বাড়ির চাল সৌন্দর্যে অসাধারণ। চাইলে এসব বাড়ি সরিয়ে নেওয়া যায়। এখানকার আরেক সৌন্দর্য। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়ির সীমানায় কোষা ও ডিঙ্গি নৌকার বহর দাঁড়িয়ে থাকা। এসব ছোট্ট কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা বাড়ির লোকজনের পারাপারের জন্য ব্যবহার হয়। এভাবেই দুপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে একসময় আড়িয়াল বিলে পৌঁছাই। বিলের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিই। সবুজ আর স্বচ্ছ নীলজলের খেলা। এখানকার জলাশয়ের স্বচ্ছজল কোথাও গভীর, কোথাও অগভীর। নিচে মাটি বা বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামনে-পেছনে কচুরিপানার ঝোপ। জলজ উদ্ভিদের মধ্যে কলমিই বেশি চোখে পড়ল। বিলের যত গভীরে যাচ্ছি সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। এমন বিশালতা দেখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছেÑ এইটা বিল না হাওর। এত্ত বিশালতা যার, সে হাওর না হয়ে পারে না। 

আড়িয়ল বিলে গেলেই চোখে পড়বে ঢেউহীন এক পানির রাজ্য। জল ও জঙ্গলের দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। আরও দেখবেন, পানির মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শাপলা ফুলের কলি। আর আকাশের মেঘের ভেলায় উড়ে বেড়াচ্ছে পাখির দল। শ্রীনগর বাজারের চারপাশটা পানিতে ভরপুর আর নদীর দুধারে প্রচুর কাশফুল ফুটে থাকে শরতের এ সময়। কালভার্টের নিচ দিয়ে বিলের দিকে ছুটছে খালের পানি। ট্রলারঘাট থেকে ছোট্ট একটা খাল পেরিয়ে মূল বিলে যেতে হয়। এর পর কিছুদূর যেতেই বিলের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। বিলের পানিতে শুধু শাপলা ফুলই নয় আরও দেখবেন কলমিশাক ও কচুরিপানার সৌন্দর্য। এই বিলের মধ্যে খাল ছাড়াও জলাশয় আছে। এসব জলাশয়ে পানি কমে যাওয়ায় মাছ ধরেন স্থানীয়রা। সেখানে গেলে কৃষকদের মাছ ধরার দৃশ্যই চোখে পড়বে। এভাবেই আমাদের ট্রলার একসময় পৌঁছে যায় মাধবী দীঘিতে। দীঘির পারে মেহগনির বন। আমরা ট্রলার মেহগনি বনে ঘাট করি, তারপর অবস্থান নিই মেহগনি বনে। কী আশ্চর্য নীরবতা চারদিকে। মেহগনির বনে দাঁড়িয়ে যতটা চোখ যায় আড়িয়াল বিলটাকে দেখে নিই। এরপর দৃষ্টি ফেরাই মাধবী দীঘিতে।

আড়িয়াল বিল বিখ্যাত এসব দীঘির জন্য। যার স্থানীয় নাম ডেঙ্গা। পুরো আড়িয়াল বিলে কম হলেও ৫০০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এমন সব ডেঙ্গা বা দীঘি রয়েছে। মাধবী দীঘি এর মধ্যে অন্যতম। আমরা মাধবী দীঘি থেকে সাগরদীঘিতে যাই। যেতে যেতে চোখে পড়ে একদল কচুরিপানা সংগ্রাহকের। এসব কচুরিপানা আর বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হবে পুরো দীঘি বা ডেঙ্গা। যাতে বিলের পানি নেমে গেলেও ডেঙ্গা বা দীঘিতে মাছ থেকে যায়। ডেঙ্গা দেখা শেষে এবার দেখা হয় একঝাঁক সাদা বকের সঙ্গে। এভাবেই সময় শেষ হয়ে আসে। মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল ভ্রমণে আপনি চাইলে তালিকায় আরও কিছু গন্তব্য রাখতে পারেন। 

বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ এক ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। এই জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক প্রাচীন জনপদের চিহ্ন, যা অনেকেরই অজানা। সংরক্ষণ, সংস্কার ও প্রচার না থাকায় ঐতিহ্যবাহী এই জেলার অনেক কিছুই ভ্রমণপিপাসুদের নজর এড়িয়ে যায়। হাজার বছরের পুরোনো মনীষী অতীশ দীপংকরের জন্মভিটা যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে মুঘল আমলের নিদর্শন লালবাগ কেল্লার মতোই। তবে আকারে ছোট ইদ্রাকপুর কেল্লা। আছে বিশাল রামপাল দীঘি, ধলেশ্বরী নদী, ইছামতী নদী, পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল, অসংখ্য খাল, আর আড়িয়াল বিল তো এখনই ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের পদ্মহেম ধাম গ্রামে প্রতি বছর শীতে হয়ে থাকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালন গানের উৎসব। ক্যাম্প করে রাত কাটানোর জন্য পদ্মহেম ধাম এক আদর্শ জায়গা। মুন্সীগঞ্জ শহর ও এর আশপাশের ছায়াঘেরা রাস্তাগুলা রিকশা/অটোয় ঘুরে বেড়ালে আপনাকে মুগ্ধ করতে পারে। 

বিখ্যাত ও খ্যাতিমান মানুষের জন্মের জন্যও বিখ্যাত বিক্রমপুর। বাংলাদেশের একমাত্র ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাসের জন্মস্থান যেমন বিক্রমপুর; তেমনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রের পৈতৃকভিটাও মুন্সীগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদ ছাড়াও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্মভিটাও মুন্সীগঞ্জ জেলায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস হয়তো পড়েছেন অনেকেই কিন্তু জানেন না মানিকের জন্মস্থান প্রাচীন বিক্রমপুর নগরীতেই। 

মাওয়ার ইলিশ ভোজন : রোদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে নাকাল অবস্থা তখন আমাদের সবার, এর মাঝে ভরদুপুরে গাড়ি নিয়ে মাওয়া ঘাটে গেলাম ইলিশ ভোজনে! পরিচিত এক এলাহি দোকানে ঢুকে অনেক সিরিয়াল মেইটেইন করার পর খাবার টেবিলে বসার সুযোগ পেলাম। প্রতি পিস ইলিশ ভাজা ৯০ টাকা, ইলিশের ডিম ১৫০, মাছভর্তা ২০, বেগুন ভাজা ১০ টাকা দামে ভরপুর খেয়ে-দেয়ে একেকজন ঢোল হয়ে গাড়িতে উঠলাম।

শ্যামসিদ্ধির মঠ : মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর বাজারের পশ্চিম দিকে শ্যামসিদ্ধি গ্রামে এর অবস্থান। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু মঠ! যদিও আমরা এটা দেখতে গাড়ি থেকে নামিনি। স্যার জগদীশের বাড়ি যাওয়ার পথে হাতের ডানে দেখেছিলাম।

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি : মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার রাড়িখাল গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি। ৩০ একর আয়তনের সুবিশাল জায়গাটি ঘিরে এখন কমপ্লেক্স করা হয়েছে। ভেতরটা পার্কের মতো। 

মালাই চা : জগদীশ কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে রাড়িখাল বাজারে মুন্সীগঞ্জের বিখ্যাত মালাই চায়ের স্বাদ নিয়ে আমরা তখন উৎফুল্ল। 

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে আড়িয়ল বিলে এক দিনেই ঘুরে আসা যায়। ঢাকার গুলিস্তান থেকে ‘ইলিশ’ গাড়িতে করে মাওয়া ফেরিঘাটের দিকে রওনা দেবেন। মাঝপথে শ্রীনগরের ভেজবাজারে নেমে পড়বেন। সেখান থেকে ভালো একটা ট্রলার সারা দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে ঘুরে আসুন আড়িয়ল বিল। একটা জিনিস বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে যাবেন, এ দেশের সবকিছুই আমাদের। কাজেই এগুলো কোনোভাবেই আমরা নষ্ট করব না। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন ও অপচনশীল কিছু ফেলব না।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা