× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্মল নিসর্গে অপরূপ স্থাপত্য

জুলিয়া পারভীন

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:০৩ পিএম

আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:২১ পিএম

মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানে আছে পাহাড়ি উচ্চতায় আলপাইন হ্রদ, পৃথিবীর ছাদ খ্যাত পামির মালভূমি ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন হিসোর দুর্গ।

মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানে আছে পাহাড়ি উচ্চতায় আলপাইন হ্রদ, পৃথিবীর ছাদ খ্যাত পামির মালভূমি ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন হিসোর দুর্গ।

মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানে আছে পাহাড়ি উচ্চতায় আলপাইন হ্রদ। আছে পৃথিবীর ছাদ খ্যাত পামির মালভূমি ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন হিসোর দুর্গ।  জুলিয়া পারভীন ও সিমন আলম দম্পতি নিসর্গের কোলে অপরূপ সে স্থাপত্যশৈলী দেখতে বেরিয়ে পড়েন। মধ্য এশিয়া এবং ইউরেশিয়ার ককেশাস অঞ্চল ভ্রমণের রোমাঞ্চকর এক গল্প ঘুরিয়ার পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন জুলিয়া পারভীন

মধ্য এশিয়া মোটরহোম ঘোরার জন্য আদর্শ হলেও সময়ের অভাবে আমাদের গাড়ি ছাড়াই বের হতে হয়েছে। আমাদের ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু হয় ‘বাহা’ নামের এক ছোট তাজিক ভাইয়ের বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে। এর পর আমরা সড়কপথে কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান ঘুরতে চাই। দুবাই ফেরার আগে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়া ঘুরব। কাজের সূত্রে আমরা প্রায় দীর্ঘ এক দশক আফগানিস্তানে বসবাস করি, এজন্য এই যাত্রায় দেশটি আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে নেই। এ ছাড়াও ২০০৯ সালে আফগানিস্তান থেকে আমু দরিয়ার নীলজল পেরিয়ে উজবেকিস্তানের তাসখন্দ, সমরখন্দ, বুখারা এবং তাৰ্মিজের মতো ঐতিহাসিক শহরগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।

এই রোড ট্রিপটি শেষ হলে আমরা মধ্য এশিয়া এবং ইউরেশিয়ার ককেশাস অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে অন্বেষণ করব। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে চীন, দক্ষিণে ইরান ও আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর। ৫.৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই অঞ্চলটি কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের পাঁচটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র নিয়ে গঠিত; যা ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।

মধ্য এশিয়া ঘোরার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে আমরা কেনিয়ার মোম্বাসা থেকে গত ১৪ আগস্ট যাত্রা শুরু করি। দুবাইয়ে পাঁচ দিন অবস্থান করে আমরা প্রয়োজনীয় ভিসা সংগ্রহ করি এবং এর পর ২০ আগস্ট দুশাম্বে পৌঁছাই। দুই দিনে আমরা দুশাম্বের জাতীয় জাদুঘর, ইসমাইল সোমোনি এভিনিউ, স্বাধীনতা স্কয়ার, রুদাকি পার্ক এবং হিসার ফোর্ট পরিদর্শন করে তাজিকিস্তানের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্পর্শ পাই। ২৩ আগস্ট আমরা দুশাম্বে থেকে প্রায় ১৮৯ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে খুজান্ডে পৌঁছালাম। খুজান্ড তাজিকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আমরা খুজান্ড যাওয়ার পথে নদীর পাশের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত ‘চারবেট’ নামক রেস্তোরাঁয় সুস্বাদু তাজিক শাশলিক দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। হিসার উপত্যকার মধ্য দিয়ে যাত্রাটি ছিল এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য উপভোগ। হিসার ও গিসার পর্বতমালা, পঞ্জ নদীর স্বচ্ছজল, প্রাচীন স্থাপত্যের ছোঁয়াযুক্ত ছোট ছোট গ্রামÑ সবমিলে এক অপরূপ সৌন্দর্যের জগৎ। বিশেষ করে বিপজ্জনক টানেলগুলো দিয়ে যাত্রা করার অভিজ্ঞতা খুবই রোমাঞ্চকর ছিল।

তাজিক বিবাহ

তাজিক বিবাহ হলো এক অনন্য সংস্কৃতির প্রতিফলন। এই বিবাহগুলোতে সাধারণত একাধিক অনুষ্ঠান থাকে, যেমন বাগদান, বিবাহের প্রস্তুতি, মূল বিবাহ অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসব এবং হানিমুন। বাহার বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আমাদের তাজিক সংস্কৃতি খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাদের ঐতিহ্যবাহী সংগীত, নৃত্য এবং বিশেষ করে প্লভ ও সুরবোর মতো সুস্বাদু খাবারগুলো দারুণ। তাজিক বিবাহের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের পোশাক। পাত্র-পাত্রীরা ঐতিহ্যবাহী তাজিক পোশাক পরে। বিবাহ অনুষ্ঠানের সাজসজ্জাও ঐতিহ্যবাহী শৈলী অনুসরণ করে; যাতে ফুল, পর্দা এবং অন্যান্য সাজসজ্জার উপাদান ব্যবহার করা হয়। বিবাহের পরদিন আমরা নবদম্পতি এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে খুজান্ড শহরের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখেছি। খুজান্ড ফোর্টের প্রাচীরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, আমি কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলাম। খুজান্ড জাদুঘরে তাজিক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া আমাদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। দুপুরে খুজান্ড নদীতে নৌকা ভ্রমণ করেছিলাম। পরদিন আমরা দুশাম্বের উদ্দেশে রওনা দিলাম।

পৃথিবীর ছাদ পামির

‘পৃথিবীর ছাদ’ নামে পরিচিত মধ্য এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতমালা ‘পামির’। প্রকৃতির এক অদম্য প্রাচীর। এই প্রাকৃতিক বাধার মধ্যেও মানুষের সাহসিকতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলো পামির হাইওয়ে, যা একসময় সিল্ক রোডের একটি  গুরুত্বপূর্ণ ধমনি ছিল। পামির পর্বতমালা যেমন প্রকৃতির শক্তির প্রতীক, তেমনি পামির হাইওয়ে মানুষের অধ্যবসায়ের স্মৃতিস্তম্ভ। মার্কো পোলো, আলেকজান্ডার দাগ্রেটের মতো বিখ্যাত অন্বেষকদের পাশাপাশি অসংখ্য সভ্যতা এই পথকে পৃথিবীর সবচেয়ে মহাকাব্যিক রাস্তাগুলোর একটি করে তুলেছে। একদিকে স্বর্গীয় সৌন্দর্য, অন্যদিকে প্রকৃতির কঠোরতা। এ যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের এক অনন্য নিদর্শন।

বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম হাইওয়েটি তাজিকিস্তানের দুশাম্বে থেকে কিরগিজস্তানের ওশ শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাথমিকভাবে এটি একটি সামরিক প্রয়োজনে নির্মিত হয়েছিল। ১৯০০ শতাব্দীর শেষ দিকে রাশিয়া ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার প্রভাব বিস্তারের জন্য চলা একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা ‘দ্য গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত ছিল। ‘পামির হাইওয়ে’ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল। মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে রাশিয়া ফেরগানা উপত্যকাকে আলাই উপত্যকার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য এই কৌশলগত সড়কটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় এই সড়কটি আরও উন্নত করা হয় এবং পামির পর্বতমালাজুড়ে সম্প্রসারিত করা হয়। পামির হাইওয়ে ভ্রমণের স্বপ্ন আমাদের বহু দিনের ছিল। কিন্তু কীভাবে যাব, তা নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছিল। পামির হাইওয়েতে যাত্রা বিভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে। আমরা নিজে গাড়ি ভাড়া করে যেতে চেয়েছি, কিন্তু তাজিকিস্তান থেকে কিরগিজস্তানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা একজন ড্রাইভার নিয়ে গাড়ি ভাড়া করলাম, যেন আমাদের ইচ্ছামতো যেখানে ইচ্ছা গাড়ি থামিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরতে পারি।

পামিরের বিখ্যাত পর্বতমালা এবং পামির হাইওয়ে ভ্রমণের জন্য আমাদের একাধিক কাগজপত্র লেগেছিল। আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছে থাকায় এই এলাকায় যাওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি ছিল বাধ্যতামূলক। পামির হাইওয়ে এবং গর্নো-বদাখশান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (জিবিএও) ভ্রমণ করার জন্য আমাদের তাজিক ভিসার পাশাপাশি দুশাম্বের অভিমুখী অফিস থেকে ১০ মার্কিন ডলার ফি দিয়ে জিবিএও পারমিট নিতে হয়েছিল। কারাকুল-সারি তাশ সীমান্ত পার হয়ে কিরগিজস্তানে প্রবেশ করার জন্য আমাদের ড্রাইভার ১৫ মার্কিন ডলার দিয়ে সীমান্ত পারমিট ম্যানেজ করেছিল। জিবিএও পারমিটটি রাস্তার বিভিন্ন চেকপোস্টে পরীক্ষা করা হয়, তাই আমরা আমাদের জিবিএও পারমিট এবং পাসপোর্টের দশটি কপি চেকপোস্টগুলোতে উপস্থাপনের জন্য ফটোকপি করে নিয়েছিলাম। পামির হাইওয়ে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এই সময়কালে আবহাওয়া সাধারণত পরিষ্কার থাকে এবং তাপমাত্রাও অনুকূল থাকে, যা পাহাড়ি এলাকার সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার জন্য আদর্শ। এই সময়কালে বৃষ্টিপাত কম হয় এবং সড়কগুলো ভালো অবস্থায় থাকে। তবে শীতকালে তুষারপাত এবং বরফের কারণে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়ে। 

পামির হাইওয়ে ভ্রমণের খরচ, ধরন এবং সময়কালের ওপর নির্ভর করে। গড়ে আট দিনের একক ভ্রমণে জনপ্রতি প্রায় ১ হাজার ৩৫০ ডলার খরচ হতে পারে। এতে খাবার, থাকা, পরিবহন এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত। আবাসন জনপ্রতি ১৪০ ডলার, পরিবহন জনপ্রতি ৭০০ ডলার (ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়ি ভাড়া করা), খাবার জনপ্রতি ২১০ ডলার, অ্যাক্টিভিটি জনপ্রতি ১০০ ডলার, অন্যান্য খরচ জনপ্রতি ২০০ ডলার (প্রবেশ ফি, অনুমতিপত্র এবং স্মারক সামগ্রীসহ)। সম্পূর্ণ খরচ হবে জনপ্রতি ১,৩৫০ ডলার। এই খরচগুলো আনুমানিক। ভ্রমণের ধরন অনুযায়ী এটি বাড়তে বা কমতে পারে। যেমনÑ কেউ যদি ভালো হোটেলে থাকেন বা হাইকিং, ওয়াটার রাফটিং, বাইকিং-এর মতো অতিরিক্ত কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে খরচ আরও বাড়তে পারে এবং ভ্রমণের সময়কালও বেড়ে যেতে পারে।

পামিরের ডাকে : দুশাম্বে থেকে কালাইখুম্ব

পামির হাইওয়ে তার ৪ হাজার ৬৫৫ মিটার উচ্চতার জন্য বিখ্যাত আর তাই উচ্চতা অভিযোজনের জন্য তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশাম্বে থেকে এই অভিযান শুরু করাই ভালো। চাইলে কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ওশ থেকে শুরু করা যায়, তবে দুশাম্বে কম উচ্চতায় অবস্থিত, যার ফলে হাইওয়ে বরাবর ধীরে ধীরে ওঠা সম্ভব। এই ধীর উচ্চতা বৃদ্ধি আমাদের শরীরকে কম অক্সিজেনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে সাহায্য করে এবং উচ্চতা রোগের ঝুঁকি কমায়। অন্যদিকে, ওশ থেকে শুরু করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্চতার বৃদ্ধি ঘটে, যা উচ্চতা সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। শহর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে ওঠে। আমরা উঁচু পর্বত এবং সবুজ উপত্যকার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। প্রায় ৬০ কিলোমিটার যাত্রার পর আমরা নুরেক জলাধারে পৌঁছাই।

বিশাল নুরেক বাঁধটি ভাখশ নদীর পানিকে আটকে রেখে নুরেক হ্রদ গঠন করেছে। ৩১০ মিটার উচ্চতায় এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাঁধ ছিল। তাজিকিস্তানের দক্ষিণে ভাখশ নদীর ওপর নির্মিত রোগুন বাঁধ সম্পূর্ণ হলে নুরেক বাঁধের এই অবস্থান পরিবর্তিত হতে পারে। যাই হোক ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত নুরেক হ্রদ, দুশাম্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার এবং শহরের জন্য জলবিদ্যুৎ শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। হাইওয়ের পাশঘেঁষে ভিউ পয়েন্ট হতে নুরেক জলাধারের নীল রঙের দৃশ্য যে কাউকেই মুগ্ধ করে তুলবে। জলাধারের কেন্দ্র থেকে বেশ কয়েকটি ছোট, বাদামি রঙের দ্বীপগুলো যেন জলাধারটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কিছু ছবি এবং ভিডিও ধারণের পর আমরা কুলোবের হাইওয়ে ধরে আমাদের যাত্রা অব্যাহত রাখি। ডাঙ্গারার মধ্য দিয়ে এবং হুলবুক দুর্গ এবং জাদুঘর অন্বেষণ করার জন্য ভোসে একটি চক্কর দিয়েছিলাম। কুলোব থেকে আমরা কালাইখুম্বের দিকে রওনা হলাম। আমরা মনোমুগ্ধকর চিলদুখতারন উপত্যকা পরিদর্শন করেছি, এটি একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণের শিলা গঠনের জন্য বিখ্যাত। যা তাজিক ভাষায় ‘ফর্টিগার্লস’ নামেও পরিচিত।

শুরোবোদ অতিক্রম করে চেকপোস্ট পার হওয়ার পর, আমরা পঞ্জ নদী এবং আফগানিস্তান দেখতে পেলাম। যখন আমরা কালাইখুম্বের দিকে নামছিলাম। একটি রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড ইআরএস আফগানিস্তানের উপস্থিতি নির্দেশ করেছিল। আমরা দূর থেকে একটি আফগান গ্রাম পর্যবেক্ষণ করেছিলাম এবং আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাতের পতাকা লক্ষ করেছিলাম, যার পটভূমি সাদা এবং কালো শাহাদা লেখা ছিল। আমরা রোমা গেস্টহাউসে রাত কাটিয়েছিলাম, যা নদীর তীরে অবস্থিত এবং সাইক্লিস্ট এবং বাইকারদের মধ্যে জনপ্রিয়। শহরটি ঘুরে দেখার এবং ডিনারের পর আমরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। কারণ আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ভোররাত তিনটার দিকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল।

কালাইখুম্ব থেকে খোরোগ

আমাদের যদিও আজকের যাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। অন্ধকারের মধ্যেও বোঝা যায় যে, রাস্তাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। রাস্তায় দ্রুতগতিতে ছুটে চলল আমাদের গাড়ি, ড্রাইভিংয়ে একটু ভুল হলে আর বাঁচার সম্ভাবনা এখানে একেবারেই কম। শুধু পাহাড়ি বাঁক না, রাস্তা এত্ত সংকীর্ণ যে অন্যপাশ থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা খেয়ে, গাড়ি যেকোনো সময় পাহাড়ের ক্লিফে গিয়ে পরবে সেই ভয়ে তটস্থ ছিলাম।  অবশেষে আমরা অক্ষতভাবে খোরোগে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তি পেলাম! খোরোগ ছিল পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত একটি চমৎকার শহর। এখানে একটি মনোরম নদী এবং একটি সবুজ পার্ক রয়েছে। আমরা ঐতিহ্যবাহী পামির বাড়িতে ছিলাম। আমাদের ঘরটি এত সুন্দরভাবে সজ্জিত ছিল যে, মনে হয়েছিল যেন একটি জাদুঘরে এসেছি। খোরোগ মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত শহর হিসেবে পরিচিত। 

হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ : ওয়াকান উপত্যকা

বেশিরভাগ ভ্রমণকারী আমাদের মতোই এম৪১ সড়কের পরিবর্তে ওয়াকান উপত্যকার দিকে একটি পার্শ্বপথ নেন। এই অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো, গাড়ি চালানোর সময় নদীর ওপারে আফগানিস্তান স্পষ্ট দেখা যায়।আমরা প্রথম বিরতি নিলাম ইশকাশিমে, যেখানে আফগানিস্তানের সীমানা। প্রতি শনিবার নদীর দুই পাড়ের গ্রামবাসীরা এখানে বাজারে মিলিত হয়। এটা দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম যে, উত্তরাঞ্চলীয় আফগানিস্তান এত শান্ত, সুন্দর এবং নিরিবিলি। সাধারণ ধারণার বিপরীতে, এটি একটি চিত্রসুন্দর অঞ্চল। লাঞ্চের পর আমরা কাঁচা রাস্তা ধরে যাত্রা চালিয়ে গেলাম এবং ওয়াকান উপত্যকার বিভিন্ন আকর্ষণ দেখলাম। দুটি প্রাচীন দুর্গ এবং একটি গরম ঝরনা অন্বেষণ করলাম। 

ওয়াকান উপত্যকার গহিনে লুকিয়ে থাকা বিবি ফাতিমা জোহরা স্প্রিং ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যারা নির্জনতা পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই জায়গাটি আদর্শ। ইয়ুমচুম গ্রামের কাছে অবস্থিত এই পবিত্র স্থান স্থানীয় মুসলমানদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীনকাল থেকেই এই এলাকার পানি পান করলে মহিলাদের সন্তান ধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। অন্য মুসলিম দেশের তুলনায় তাজিকিস্তানে ইসলামের প্রভাব কম হলেও এই হট স্প্রিংয়ে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা রয়েছে। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের ফাঁকে অবস্থিত এই হট স্প্রিংয়ে শত শত স্ট্যালাকটাইট ঝুলছে, যা একদম জাদুর মতো। গরম পানি পাহাড়ের ফাটল থেকে বের হচ্ছিল। অনেক মহিলা এখানে নগ্ন অবস্থায় স্নান করছিলেন।

স্থানীয় মহিলারা আমাকে বলেছিলেন যে, এই পানিতে স্নান করলে বন্ধ্যত্ব দূর করে। তারা আমাকে গুহার ভেতর থেকে পানি নিয়ে শরীরে ছিটিয়ে দিতে বলেছিলেন। আমিও তাই করেছি। অন্য এক মহিলাকে দেখলাম সে গুহার ভেতরে ঢুকে গেছে। গুহাটি এত ছোট যে স্লিম না হলে ভেতরে ঢোকা কঠিন। আমিও ভেতরে ঢুকেছিলাম। পানি আমার চিবুক পর্যন্ত এসেছিল। আমি পুরো শরীরটা পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। স্থানীয় মহিলারা পানি বোতলে করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের বিশ্বাস, এই পানিতে স্নান করলে সন্তান হবে। আমরা এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই গল্প সত্যি কি না, সে আমাকে তার বাচ্চা দেখিয়ে বললেন, তার বাচ্চা এই ঝরনার আশীর্বাদ। 

অন্ধবিশ্বাস বাদ দিলে, বিবি ফাতিমা জোহরা স্প্রিংয়ের পানি সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন এবং অন্যান্য উপাদানসহ এর সমৃদ্ধ খনিজ উপাদানের জন্য সুখ্যাত। পাহাড়ের এত উঁচু জায়গায় হওয়া সত্ত্বেও পানির তাপমাত্রা সব সময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। আমরা সেখানে এক রাত কাটিয়েছিলাম এবং পরের দিন মুরগাবের দিকে রওনা হয়েছিলাম।

ওশের পথে : আমাদের পামির রোড ট্রিপের শেষ স্টেশন

কিরগিজস্তানের দক্ষিণের রাজধানী ওশের দিকে রওনা হওয়ার আগে আমরা সারি-মোগলে গাড়ি বদলাই। ওশ, কিরগিজস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, দেশের দক্ষিণাংশে ফেরগানা উপত্যকায় অবস্থিত এবং প্রায়শই ‘দক্ষিণের রাজধানী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওশের দিকে যাত্রা করতে করতে আমাদের মনে পড়ে গেল পামির হাইওয়ের সেই অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পামিরের স্মৃতি নিয়ে আমরা ওশে পৌঁছলাম। সভ্য সুবিধার জন্য অধীর আগ্রহে থাকলেও আমরা গভীরভাবে দুঃখিত হয়েছিলাম যে, আমাদের পামির হাইওয়ে যাত্রা শেষ হয়ে গেল। পামিরের শান্তি যেন একটি স্বপ্ন, আর ওশের সভ্যতা যেন জাগরণের কঠিন বাস্তবতা।

ছবি : লেখকের সৌজন্যে
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা