× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আপন পরিচয়ে মধুপুরের আনারস

মিজি মৃ : যার হাত ধরে মধুপুরের আনারস

হাসনাত মোবারক

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম

আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৫২ পিএম

বাজারে নেওয়া হচ্ছে মধুপুর গড়ের আনারস 	ছবি : মো. রাতুল

বাজারে নেওয়া হচ্ছে মধুপুর গড়ের আনারস ছবি : মো. রাতুল

‘নদী চর খাল বিল গজারির বন; টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন।’ সম্প্রতি এ শাল-গজারির বন অধ্যুষিত মধুপুর গড়ে উৎপাদিত আনারস ফল ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ উপলক্ষে স্থানীয় কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। এ মুহূর্তে তারা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছেন আনারসের আঁতুড়ঘর নামে খ্যাত মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের মিজি মৃকে। জানা যায়, প্রায় আশি বছর আগে এ অঞ্চলে আনারস চাষ শুরু করেন গারো সম্প্রদায়ের মিজি মৃ। তার হাত ধরে পরম্পরায় মধুপুর এখন আনারসের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখান থেকেই মূলত বাংলাদেশের অন্যত্র রসালো এ ফল চাষের বিস্তার ঘটে।
ইদিলপুর গ্রামের মাতৃতান্ত্রিক গারো সম্প্রদায়ের মিজি মৃর উত্তরাধিকার বহন করছেন অরবিন্দু সাংমা। ৬২ বছর বয়সি অরবিন্দুও পেশায় কৃষক। মিজি সম্পর্কে তার নানির নানি। অরবিন্দু জানান, মিজিকে তিনি বড়মা ডাকতেন। মিজিকে তিনি শৈশবে দেখেছেন। মিজির নিয়ে আসা চারা থেকে আজকের মধুপুর গড়ের আনারস সুখ্যাতি পেয়েছে দেশজুড়ে। স্বীকৃতিও মিলেছে। এ প্রসঙ্গে তার অনূভূতি জানতে চাইলে অরবিন্দু বলেন, ‘এটা ভালো লাগার মতোই বিষয়। এতে আমরা অনেক গর্ব করছি।’ অরবিন্দুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিজি মৃ এবং আরও কয়েকজন ভারত থেকে কিছু আনারসের চারা নিয়ে আসেন। সে সময় এ গহিন বনের মধ্যে ছিল না কোনো রাস্তা। অরণ্যের মধ্য দিয়ে চলাচলের বাহন ছিল গরুর গাড়ি। তাই মিজি মৃ অনেক কষ্ট করেই জায়ান্টকিউ জাতের অল্প কিছু চারা নিয়ে এসেছিলেন। চারাগুলো লাগিয়ে দিলেন বসতবাড়ির আঙিনায়। ফল পাকার পর দেখলেন এ গড়ের লালচে মাটি আনারস চাষের উপযোগী। বিশাল আকারের আনারস ফলতে শুরু করল। সেগুলো খেতেও বেশ সুমিষ্ট। স্বাদে ও ঘ্রাণে অতুলনীয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মধুপুর গড়ে জুম চাষ কেন্দ্র করে মান্দিদের বসতি গড়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে গড়ের এক বিশাল অংশ হয়ে যায় ‘রাষ্ট্রীয় বনভূমি’। এখানে কয়েকশ বছর ধরে বসবাসরত মান্দি-কোচেরা তাদের জমির মালিকানা হারান। ফলে চালাজমিতে জুম চাষ নিষিদ্ধ হয়। তখন মান্দিরাও বাধ্য হয়ে নামা বা বাইদ জমিতে বাঙালিদের মতো লাঙলভিত্তিক কৃষিকাজ শুরু করেন। বসতবাড়ির পাশে অল্পবিস্তর চালাজমিনে শুরু হয় আনারস-পেঁপে-থাবুলচু-আদা-হলুদ-মান্দিকচু-কাঁঠালের মিশ্র বাগান। অর্থাৎ চালাজমিতে চাষের অধিকার হারিয়ে মধুপুরে এ আনারস চাষের সূচনা।
এখন এ অঞ্চলে ২৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫৪২ হেক্টরে আনারস চাষ করা হয়। বাঙালি এবং সংখ্যালঘু জাতিসত্তা উভয়েই এ ফল চাষের সঙ্গে জড়িত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আনারস চাষ।
মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের গোলচত্বরে পৌঁছালে দেখা মেলে বিশালাকারের তিনটি আনারসের ভাস্কর্য। এটি মূলত দর্শনার্থীদের নিশ্চিত করে এ অঞ্চল আনারসের রাজধানী। আরও একটু এগোলে দেখা মেলে আনারসের বাজার। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল, কেউ আবার ট্রাক ও পিকআপে তুলছেন আনারস। চাষিরা বিক্রির উদ্দেশ্যে সারিবদ্ধভাবে আনারসের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে অটোরিকশা ও ছোট পিকআপযোগে যার যার গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধুপুরের জলছত্র বাজারটি আনারসের বিখ্যাত হাট। মৌসুমে প্রতিদিন এখানে কোটি কোটি টাকার বেচাকেনা চলে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে নিয়ে যান। আকারভেদে ২০ থেকে ৪৫ টাকা দরে প্রতিটি আনারস বিক্রি হয়। সুমিষ্ট এ ফল চাষে কৃষি বিভাগের নানামুখী উদ্যোগে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চাষির সংখ্যা। মধুপুর থেকে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সারা দেশে এখন আনারস যায়। এতে দরিদ্র চাষিদের ভাগ্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে। নারী-পুরুষ উভয়েই আনারস চাষের সঙ্গে জড়িত। মধুপুরে ৮-১০ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন।
মধুপুরের আনারস নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী কামরুল ইসলাম। এ কৃষিবিদের সঙ্গে কথা বলে কিছু অপ্রিয় সত্য জানা গেল। অনেক কৃষকই ফল পাকার আগে বাজার ধরতে নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন; যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, আনারস যেহেতু আঠারো মাসের ফল, কৃষক এত দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন না। তাই তাদের যথেষ্ট পরিমাণে প্রণোদনা প্রয়োজন। ১ হেক্টর জমিতে প্রায় ২৪ হাজার আনারসের ছাকা (চারা) রোপণ করা যায়। কৃষক যদি রাসায়নিক সার ব্যবহার না করেন তাহলে শতকরা ৭০টি আনারস টেকে। তাই কৃষক শতভাগ চারা থেকে ফল পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন।
স্থানীয় চাষিরা জানান, আগে উৎপাদন খরচ কম ছিল। কিন্তু এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় আনারসের দর ভালো হলেও পোষায় না তাদের। খরচ অনুযায়ী দাম পাচ্ছেন না বলে জানান কৃষক। যে আনারস মৌসুমের সময় বাজারে উঠবে সেটা অতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করে আগে বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে।
মধুপুর উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলায় ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর। ২ লাখ ৮২ হাজার টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে। আনারস থেকে উদ্যোক্তাদের জ্যাম, জেলি, জুস ও আচার উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়া হয়। বিদেশেও রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্মীর সঙ্গে আনারস প্রসঙ্গে কথা হয়। এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে প্রচুর পরিমাণে আনারস চাষ হয়। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আনারস বিদেশে রপ্তানির পথ আরও একটু সুগম হলো। এতে এখানকার কৃষকেরও ভাগ্যের উন্নয়ন হবে।’ তিনি আরও জানান, আনারসকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা হলে জুস, জেলি, বিস্কুটসহ পণ্য তৈরির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। কৃষকও লাভবান হবেন।’ 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা