‘এই গল্প আমার দাদার দাদার দাদার এবং তার দাদার...।’
এক দিন কেল্লায় এলেন সুবেদার মীর জুমলা। সুবেদার মানে হচ্ছে তিনি মোঘল সম্রাটের পক্ষে বাংলা, বিহার, উরিষ্যা শাসন করেন। গল্পের আসরে ডাক পড়ল আনার সর্দারের। তাকে সম্মান জানিয়ে আনার সর্দার শুরু করল। ‘হুজুর বিনীতভাবে বলি, একটা কথা মনে রাখবেন কৃপণের ভাঙা ঘোড়া। বেয়াদবের কপাল পোড়া।’গল্পের শুরুতেই উপদেশ? সুবেদার মীর জুমলার পছন্দ হলো না। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘এই কথা ভালো করে ব্যাখ্যা করো। ব্যাখ্যা পছন্দ না হলে শাস্তি।’ আনার সর্দার বলল, ‘হুজুর আমরা তিন ভাই। আমি সবার বড়। বাকি দুজন আমার সৎ ভাই। ওরা আমাকে দেখতে পারে না। সব সময় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি সব সময় ছোটদের মাফ করে দিই। ওদের উপকার করার চেষ্টা করি।’
একদিন কেল্লার সেনাপতি মীর্জা নাথান সাহেব দুই পাঠানকে পাঠালেন আমার খোঁজে। আমি এখানকার সবচেয়ে বড় কৃষক। তিনি সৈন্যদের জন্য আমার কাছ থেকে চাল কিনবেন। কেল্লায় চাল বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ। পাঠানরা কেন আমাকে খুঁজছে এটা বুঝতে পেরে আমার ভাইয়েরা একটা ফন্দি আঁটল। মেঝো ভাই আতা সর্দার পাঠানদের গিয়ে বলল, আনার সর্দার মারা গেছেন। আপনারা তার ভাই মুকুল সর্দারের কাছ থেকে চাল কেনেন। পাঠানরা চাল বিক্রির চুক্তি করতে মুকুল সর্দারকে নিয়ে গেল সেনাপতি মীর্জা নাথানের কাছে। মুকুল সর্দার তার ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো।
কিন্তু কেল্লার গেটে যখন সে পৌঁছাল তখন তার ঘোড়ার পা ভেঙে গেল। ঘোড়ার নখ নিয়মিত কেটে ছোট রাখতে হয়। না কাটলে এটা বেঢপ সাইজের হয়। এই নখ কাটতে নাপিতকে দিতে হয় পাঁচ কেজি সুগন্ধি চাল। কিন্তু মুকুল সর্দার কৃপণ। সে নখ কাটাতে এক কেজির বেশি চাল দিতে রাজি না। এই দরাদরি করতে করতে ঘোড়ার নখ বড় হয়ে গেছে। নখ বড় হওয়ায় সে ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। ফলে কেল্লার সামনে উঁচু জায়গায় উঠতে গিয়ে তার পা গেছে ভেঙে।
ঘোড়ার পা ভাঙার ঘটনা শুনে সেনাপতি মুকুল সর্দারকে চলে যেতে বললেন। তার কাছ থেকে চাল কিনবেন না। কারণ ঘোড়া পালতে যে কিপটামি করে, চাল সংরক্ষণেও সে কিপটামি করতে পারে। এতে চাল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। নষ্ট চাল খেয়ে সৈন্যদের শরীর খারাপ হতে পারে। এজন্য মুকুল সর্দার বাদ।
বাদ পড়লেও মুকুল সর্দার পাঠানদের রাজি করালেন তার ভাই আতা সর্দারকে সেনাপতির কাছে নিয়ে যেতে। যাতে আতা সর্দার কেল্লায় চাল বিক্রি করতে পারে।
এবার আতা সর্দারকে নিয়ে পাঠানরা রওনা হলো। তবে আতাকে নিয়ে কেল্লায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল হয়ে গেল।
বিকাল হয়ে যাওয়াতে সেনাপতি তাকে কেল্লার ভেতরে তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে বললেন। ফজরের নামাজের পরে কথা বলবেন বলে জানিয়ে দিলেন।
ফজরের নামাজের বেশ পারেও আতা সর্দার ঘুম থেকে উঠল না। সে ঘুমিয়েই রইল। সৈন্যরা তাকে জাগাতে গেলে সে বলল, ‘আমার গোলায় পাঁচশ মণ ধান। আমি এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠি না।’
সৈন্যরা গিয়ে সেনাপতিকে এ কথা জানাল। সেনাপতি ভ্রু কুঁচকে আদেশ দিলেন, ‘এই বেয়াদবকে চাঁদ পুকুরে ছুড়ে ফেল। সন্ধ্যা পর্যন্ত পুকুরেই থাকবে।’ যেমন হুকুম তেমন কাজ। সৈন্যরা আতা সর্দারের চার হাত পা ধরে কেল্লার পাশের চাঁদ পুকুরে ফেলে দিল।
তবে এর মধ্যে সৈন্যরা সবচেয়ে বড় কৃষক আনার সর্দারের খোঁজ পেয়ে গেছে। তাকে নিয়ে আসা হয়েছে কেল্লায়। তার কথাবার্তা খুবই মার্জিত। সেনাপতি তাকে পছন্দ করলেন। তার কাছে থাকা সমস্ত চাল সৈন্যদের জন্য কেনা হলো। বাজারদরের চাইতে প্রতি মণে আনার সর্দার এক পয়সা বেশি চেয়েছিল। সেনাপতি তার কথায় খুশি হয়ে এক পয়সা করে বেশি-ই দিল। আনার সর্দার দেখতে দেখতে ধনী কৃষকে পরিণত হলো।