কনি আইল্যান্ড
ফারুক আহমেদ
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৫৭ এএম
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১৯ এএম
কনি আইল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ ওয়ান্ডার হুইল
নিউইয়র্ক শহর ঘিরে অনেক সমুদ্রসৈকত। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকত অবশ্যই কনি আইল্যান্ড। এই সৈকত ঘিরে সারা বছরই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান লেগে থাকে। ফলে রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই যেন একসঙ্গে করে ফেলেন নিউইয়র্কবাসী। এই জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য নিয়ে আজকের আয়োজন-
নিউইয়র্ক সিটি ঘিরে অগণিত দ্বীপ। মোড় ঘুরে, সুউচ্চ দেয়াল পেরিয়ে দ্রুতই সামনে এসে হাজির হয় এসব দ্বীপের সারি। আটলান্টিক মহাসাগরের ভেতর ঢুকে যাওয়া পৃথিবীর রাজধানীর দ্বীপগুলো একেকটা মুগ্ধতার সরোবর যেন। কসমপলিটান, কিন্তু প্রাণবন্ত-অবারিত স্বস্তি ও সৌন্দর্য লেগে আছে এসবে। কনি আইল্যান্ড তেমনি একটি জায়গা। যার নাম আইল্যান্ড হলেও বাস্তবে মেইনল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত। দ্বীপ নয়, তবে দ্বীপেরই আত্মীয় বলা যায় একেÑ উপদ্বীপ।
কনি আইল্যান্ড নিউইয়র্কবাসী এবং এ শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকের কাছে বিশেষ আকর্ষণের। এর অবস্থান ব্রকলিনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। যাওয়ার প্রধান দুটি মাধ্যমের একটা হলো ব্যক্তিগত গাড়ি, অন্যটি মেট্রো মানে সাবওয়ে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে নিউইয়র্কের সবখানে একই সমস্যা, পার্কিং। এখানেও তাই গাড়ি রাখার বড় জায়গা থাকা সত্ত্বেও। ফলে পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে খুঁজে জীবন হয়রান হয়ে যায়। আর ভুল জায়গায় রাখলে টিকিট, মানে গুনে গুনে ৬০ ডলার জরিমানা।
আমরা, মানে বন্ধু শাকিল আর আমি রওনা হই সাবওয়ে ধরে। ব্রঙ্কস থেকে সাবওয়েতে এক ঘণ্টার খানিকটা বেশি সময় লাগে। প্রথম আপার মানে মাটির ওপরে, এরপর প্রায় সবটাই মাটির নিচ দিয়ে, তারপর শেষ মুহূর্তে মাটি ফুঁড়ে আবার ওপরে উঠে রেল। নিউইয়র্কের সাবওয়ে আরেক রহস্য। এফ ট্রেন, আই ট্রেন, ডি ট্রেনÑ এ রকম অনেকগুলো ট্রেন রয়েছে। নিচেই স্টেশনে নেমে এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেন বদল করতে হয়। নতুন কারও পক্ষে যথাযথভাবে এই বদল সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে বুঝতে পারা যায়, কোন ট্রেন আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে। নিচে ট্রেনের তিন স্তরে প্ল্যাটফর্ম। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে গিয়ে উঠে গেলেই যে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাব, এমন নয়। আপডাউন আছে, আছে বিবিধ নামের ট্রেন। যাহোক ডি, এফ, এন ও কিউÑ এই চারটি ট্রেন যায় কনি আইল্যান্ড। এসব ট্রেনের শেষ গন্তব্যস্থল এই আইল্যান্ড। গন্তব্যভেদে এখানে আসার ট্রেন একেক জায়গা থেকে একেকটা। যাহোক ট্রেন যখন নিচ থেকে মাটির ওপর উঠল, জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সমুদ্রের নীলজল। দেখা গেল সৈকতজুড়ে বিশাল থিমপার্কের নানা অনুষঙ্গও। আমেরিকায় এসে এটাই আমার প্রথম সৈকত দেখা। ফলে ট্রেন থেকেই যেটুকু নজরে আসে তা দেখতে দেখতে ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
সাবওয়ে থেকে নেমে সরাসরি চলে যাওয়া যায় সৈকতে। স্টেশন পেরিয়ে বড় একটি রাস্তা, যেখানে বিভিন্ন রুটের বাস দাঁড়িয়ে আছে, তা পেরোলে বালুকাবেলায় পা পড়ল। আমরা যখন পৌঁছাই, তখন প্রায় বিকাল। কনি আইল্যান্ডের এই বিচ সমৃদ্রস্নান আর সানবাথের জন্য বিখ্যাত। আমেরিকান সাদা সুন্দরীরা গায়ে লোশন লাগিয়ে বালিতে শুয়ে থাকে। গায়ে কিছু থাকে না, থাকলে রোদ তো ঠিকমতো লাগবে না। ফলে তাদের এই শুয়ে থাকার-দেখারই দৃশ্য। না দেখার মতো করে সবাই দেখে। তো তারা সানবাথ করে আর সি-বাথ মানে সমুদ্রস্নান।
আমরা দুই বন্ধু যখন পৌঁছালাম, ততক্ষণে স্নান করার দৃশ্যাবলির সমাপ্তি ঘটেছে, এখন ধীর পায়ে সূর্য নেমে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। সৈকতজুড়ে সিগার্ল উড়ে বেড়াচ্ছে আর ছড়ানো-ছিটানো কিছু মানুষ। দুয়েকজন পানিতে তখনও আছে। এখানের সিগার্ল মানুষ পেলে দলবেঁধে তার ওপর জড়ো হয়, পাখা ঝাপটায়। ঢাকার আশপাশে শীতের আগে আগে গেলে, সন্ধ্যায় মাথার ওপর অনেক মশা যেমন জড়ো হয়ে ভনভন করে, তেমনি এখানকার পাখিগুলো। সাদা পাখার ঝাপটায় এমনভাবে ঘিরে রাখে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এ রকম দৃশ্যের ভেতর দিয়েই আমরা হাঁটতে শুরু করি সৈকত ধরে। খানিকটা সামনে একটা লম্বা ব্রিজ, যা সমুদ্রের ভেতর অনেকটা ঢুকে গেছে। সে ব্রিজ ধরে অনেকে হাঁটছেন। যারা প্রেমিক-প্রেমিকা তারা হাত ধরে, যারা পরিবার তারা বাচ্চাদের হাত ধরে। ব্রিজের একদম শেষ মাথায় বসেছে কয়েকজন মাছ শিকারি বড়শি নিয়ে। এসব বড়শিতে বড় বড় মাছ ধরা পড়ে। এরা আসেও সারা দিনের জন্য। মাছ ধরে গাড়ি ভরে নিয়ে যায়। আমরা দুজন সেই ব্রিজের কাঠের পাঠাতলে বসে থাকি বেশ কিছুক্ষণ।
কনি আইল্যান্ডের এই সৈকতের দৈর্ঘ্য ৫.৬ কিলোমিটার। সৈকতের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত কাঠের অপূর্ব পাঠাতন। এই পাঠাতন ধরে সৈকতের প্রায় পুরোটা ঘুরে ফেলা যায়। আবার এই ওয়াকওয়ে থেকে সৈকতে নেমে যেতে চাইলেও টুপ করে নেমে পড়া যায়। কনি আইল্যান্ডের মুল আকর্ষণ দুটি, একটি হলো এর সৈকত, অন্যটা থিম পার্ক। সৈকতের বিরাট এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে লুনা নামে থিমপার্কটি। সৈকত এবং পার্ক ঘিরে সারা বছরই নানারকম ইভেন্ট লেগে থাকে। কনসার্ট, ওয়ার্কশপ, নানারকম শো (ফায়ার, গোস্ট, সি) বা এক্টিভেটিজের শেষ নেই। শুধু থিম পার্কেই পুরো একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। নানারকম রাইড রয়েছে এতে- এক্সট্রিম থেকে শুরু করে বাচ্চাদের জন্য, বহু রকম রাইড।
কনি আইল্যান্ডের এই সৈকত এবং ব্রিজ বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রে ঢুকে আছে। হলিউড বা বলিউড অনেক সিনেমায়ই এই সৈকত উপস্থিত। হলিউডের ব্রকলিন, ওয়ান্ডার হুইল বা এ রকম অনেক সিনেমার শুটিংই হয়েছে এখানে। আমাদের সৈকতের তুলনায় খুব বেশি বড় না হলেও এতসব আয়োজন এ সৈকত ঘিরে যে, তা দেখে শেষ করা যাবে না।
কনি আইল্যান্ডে প্রথম পা পড়ে জিওভানি দা ভেরাজ্জানো নামে এক ইতালীয় নাবিকের। প্রথম বসবাস শুরু করে ডাচ থেকে আসা অভিবাসীরা। এরপর আস্তে আস্তে এতে নানা দেশের মানুষের বসবাস বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের একটা অংশ এখানে বাস করে। একটা সময় কনি আইল্যান্ডে নিউইয়র্কবাসী আসত ভগ্ন স্বাস্থ্য উদ্ধারে। কেননা এখানকার সমুদ্রের বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী।
আমরা পুরো বিকাল এবং সন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালাম। ওয়াকওয়ে ধরে সান্ধ্যভ্রমণে এসেছেন অনেকে। রাতের কনি আইল্যান্ডের আরেক চেহারা। বার বা ক্যাসিনিওগুলো জেগে ওঠে। সামারে চলে নানা রকম প্রদর্শনীর নাইট শো। এ ছাড়া বড় বড় কনসার্টও হয়ে থাকে এই সৈকতে। চারদিকে বার, নানা রকম খেলনার দোকান, রেস্টুরেন্ট, স্যুভেনিরশপ ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। তার থেকে খুঁজে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে মুরগি এবং ভেড়ার মাংসের এক মধ্যপ্রাচ্যীয়ও খাবার খেয়ে নিলাম। আরও কিছুক্ষণ থেকে আমরা চলে এলাম সাবওয়ে স্টেশনে। ট্রেন দাঁড়িয়েই ছিল। কনি আইল্যান্ডও নিজের মতো দাঁড়িয়ে আছে তার বহুবিদ তৎপরতা নিয়ে। আমরা সন্ধ্যার অন্ধকারে জেগে থাকা অদূরে সমুদ্রকে রেখে শহরের দিকে রওনা হয়ে গেলাম।