হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২০ এএম
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:২৪ পিএম
ছবি : আর আই পারভেজ
সুবিস্তৃত এক প্রাকৃতিক জলাধার চলনবিল। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বদল হয় এর রঙ ও রূপ। অনাদিকাল থেকে এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্গে মিশে আছে বিশাল এ জলাধার। বিলকেন্দ্রিক সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও প্রাণ-প্রকৃতির আদ্যোপান্ত নিয়ে আজকের এ আয়োজন…
‘চলনবিল আর কলম গাঁও/একটানে যায় সাধুর নাও।’ কিংবা ‘চলনবিলের নাইরে জোড়া, চরতারাপুর, বাইশপাড়া।’ শুধু গানেই নয়, আক্ষরিক অর্থেই চলনবিল অতুলনীয়। দেখার সৌন্দর্য তো আছেই সেই সঙ্গে চলনবিলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভয়ের নানা গল্প-কাহিনী। দিগন্তবিস্তৃত এ জলাভূমির নাম শুনলেই ভয়ে গা ছমছম করত। নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার আট উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত চলনবিলের একসময় দিগন্তই খুঁজে পাওয়া যেত না। এই বিলের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ভাসতে থাকা শত শত গ্রামের একটি ডুবিগাঁও। বহুদিনের চেনা সেই গ্রাম কেন্দ্র করে আরও একবার ঘুরে এলাম চলনবিলের পথে ঘাটে। বর্ষায় যেখানে জল ও মাছের উৎসব বাঁধা পড়ে বিনিসুতায়।
শরতের সকাল। উল্লাপাড়ার লাহিড়ী মোহনপুর স্টেশনে নেমে অনেকটা কৌতূহল নিয়ে নৌকাঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। দেখি অনেক কিছুর মতো এ ঘাটটিরও জৌলুস হারিয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও এখানে ভিড়ত শত শত নৌকা। রেললাইনের দুই ধারে প্রায় ১ কিলোমিটার জুড়ে থাকত ছোটবড় নৌকা। দেখে মনে হতো নৌকার হাট। সে ঘাটে দেখা মিলল অল্প কিছু নৌকার। যাত্রীর সমাগমও কম। স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষক রশিদ আহমেদ পাশেই মাছের আড়ত দেখিয়ে বলেন, ‘এখানকার ব্যস্ততা মূলত আড়ত ঘিরে। আশপাশের দু-তিন উপজেলার প্রায় পঞ্চাশ গ্রামের মানুষ এখানে আসে মাছ বিক্রি করতে। খুব ভোরে মাছ কেনাবেচা চলে। আগে নৌকাই ছিল চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। বিলের মধ্য দিয়ে সড়ক হওয়ায় ঘাটের চাহিদা কমে গেছে।’ স্থানীয়রা জানালেন, যাত্রী পারাপারের অনেক মাঝিই এখন পেশা বদল করেছেন।
জলজীবনের জীবিকা
দেশি মাছের আপন বাড়ি হিসেবে খ্যাত এ বিল। নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছ সারা বছরই পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিলপারের প্রায় প্রতিটি পরিবারের জীবনজীবিকা এ মাছকেন্দ্রিক। এখানকার প্রতিটি মানুষ জানে মাছ ধরা এবং নৌকা চালানো। নানান সরঞ্জাম দিয়ে বিলে হরদম মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ে।
আমরা একটা ঘেরজালের নৌকার কাছে যাই। স্থানীয়রা একে বলেন ‘বাদাই’। সাত-আট জন জেলে পানি থেকে জাল টেনে তুলছেন। কথা হয় নৌকায় থাকা বয়স্ক জেলে লিটন প্রামাণিকের সঙ্গে। বললেন, ‘গত বছরের চাইতে মাছ কম। তবে দাম বেশি।’ আগ্রহ নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি পাতিলে রাখা হরেকরকমের মাছ খলবল করছে। লিটন প্রামাণিক বললেন, ‘বাপু, আগে এক টানে দুই পাতিল মাছ পাইছি। হে সম বেচার জায়গা আছিল না। এহন তো মাছ ধরার আগে নিকারিরা কাছে আইসা বসে থাহে। ট্যাহা পাই ভালো। জনপ্রতি এক হাজার হয়, আবার বেশিও পাই। বসে থাকার সময় এহন। বর্ষায় গরুবাছুর পালার খরচ তুলি। কাত্তিকে জমিতে সার-বেচনের (বীজ) টাকা কামাই; এখান থাইক্যায় হয়। আল্লাহ ভালোই চালায়।’ জানতে চাই, বসে থাকার সময় মানে? পাশ থেকে আরেকজন বলে ওঠেন, ‘আমরা তো বাপু গেরস্ত ছাওয়াল। হলদারদের (জেলে) লাহান সারা বছর মাছ মারি না। পানি যে কয় মাস থাকে তত দিন আমরা আছি। এরপর এ যে খালি পানি আর পানি দেখছেন। শুকালে পরে আমরা আবাদে নামি।’ নানা পেশা-শ্রেণির মানুষের বসবাস এখানে। ব্রিটিশ আমলেও এখানকার মাছ, কাছিম ও গরুর দুধ কলকাতায় রপ্তানি হতো। পানি শুকালে এ বিশাল নিথুয়া পাথারে ফলানো হয় ফসল। কৃষিকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই।
শুঁটকির খলা
ফেরার পথে পাঙ্গাসি গ্রামের রাস্তার ধারে দেখতে পাই শুঁটকির খলা। কাছে পৌঁছানোর আগেই মাছের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগে। মাচা করে বাঁশের দীর্ঘ চাটাই বিছানো। তাতে শুকাতে দেওয়া আছে হরেকরকমের মাছ। কথা হয় খলার মালিক ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে। বললেন, ‘শুরু করছি মাত্র। চৈত্র মাস পর্যন্ত এ খলা চলবে। মাছ পাইলে বছরে এক-দেড়শ মণ শুঁটকি তুলি।’ তিনি বললেন, ‘আগে এ এলাকাতে পনেরো-বিশটা খোলা থাকত। এখন কমে গেছে।’ মাছ শুকানোর খলা কমে যাওয়ার কারণ জানালেন এই ব্যবসায়ী। বললেন, ‘এ কাজ করে খাচ্ছি ৩৫ বছর। এখানে নারী-পুরুষ সব মিলিয়ে প্রায় ২০ জন কাজ করে। আগে মাছ কেনাবেচা হতো পাতিল চুক্তিতে। এহন কেজি দরে।’ হাসতে হাসতে বললেন ‘এই ধরে আছি আর কি।’ এ শুঁটকি খলার মালিকের মতো এবার অন্য ব্যবসায়ীদেরও একই পরিস্থিতি। যদিও দেশের বাইরেও এখানকার শুঁটকির চাহিদা রয়েছে।
হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়
একসময়ের ক্ষীর নদী সাগর নামে পরিচিত চলনবিল। যা আয়তনে ছিল বিশাল। ১৯১৫ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলসড়ক চালু হলে চলনবিল দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বিলের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে বসতি। বিলচলনের জলপুত্র আবদুল হামিদের লেখা ‘চলনবিলের ইতিকথা’ থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে শুধু জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। এরপর ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপে আয়তন গিয়ে দাঁড়ায় ১৪২ বর্গমাইলে। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। ১৯৮০-এর দশকে বাঘাবাড়ী-তাড়াশ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক তৈরি হওয়ায় বিলের পানিপ্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে বিলের আয়তন কমে গেছে, অন্যদিকে মাছ উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে। হারিয়ে গেছে অনেক দেশি প্রজাতির মাছ। এ বিষয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহীনূর রহমানের সঙ্গে। মাছ হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্ষার পানি দেরিতে আসে। যেজন্য মা মাছ প্রজননের সময় পায় না। তা ছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বাঁধ এবং সড়ক নির্মাণ করায় মাছ অবাধ বিচরণ করতে পারে না। মা মাছ সহজেই আটকা পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ থেকে সমাধান পেতে বিলের মধ্যে কিছু নো-ফিশিং জোন গড়ে তুললে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।’ এ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, চলনবিলের সিরাজগঞ্জ অংশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। এ জেলায় বর্তমানে বিলের আয়তন ১৯ হাজার ১৯০ হেক্টর।
অফুরান প্রাণের আধার
বিলচলন বর্ষায় উন্মাতাল। শরতে শান্ত। হেমন্তে পাকা ধানের ঘ্রাণ আর সরিষা ফুলের হলুদে ছেয়ে যায় মাঠ। শীতে শিশিরজড়ানো আলপথ। গ্রীষ্মে রুক্ষ। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে এ জলাভূমিও ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়। তবে শরৎ-হেমন্তে বিলজুড়ে বিচরণ করে হরেক রঙের পাখি। জলাভূমিজুড়ে রাজত্ব করে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক, ডাহুক, জলমোরগ, সারস, কাদাখোঁচা, রাতচরা, হারগিলা, নলকাক, চখাচখি, হটহুটি, পেঁয়াজখেকো, ত্রিশূল, বাটুইলা, নারুলিয়া, লালস্বর, শামুকখোল, ঘুঘু, কাক, সাদা খঞ্জনি এবং বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস আর মাছের লোভে শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে উড়ে বেড়ায় শিকারি চিল। এ পাখিদের ডুব দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যও অসাধারণ। বালিহাঁসের ঝাঁক চলনের শোভা অনেকটাই বাড়িয়ে তোলে। এটা নৌ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে চলে ছোটবড় নৌকা। আকাশে ভেসে বেড়ায় শরৎ মেঘের ভেলা। আকাশ তার সমস্ত নীল উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে জলের ওপর। দৃষ্টিসীমাজুড়ে শুধুই জলরাশি। শাপলা, শালুক, ঘেঁচু, কলমি, হেলেঞ্চা, ধইনচা ও পদ্মপাতায় শোভিত এ জলাভূমিতে জন্মে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ। বিলে দেখা মেলে হিজল-বরুণ। গাছের ডালে আশ্রয় নেয় নানা প্রজাতির পাখি। বিলের অন্যতম আকর্ষণ বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ছোটবড় অসংখ্য নদ-নদী। এ নদ-নদীগুলো বর্ষার পানিতে বিলের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এ বিলের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী ও খাল হলো-আত্রাই, গুমানি, বড়াল, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপি, নবী হাজির জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, উলিপুর-মাগুরা খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ি-ছারুখালি খাল, বিল সূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা ইত্যাদি। পৌষ ও মাঘ মাসে এখানে ঘটা করে চলে মাছ ধরার উৎসব। ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ নদ-নদী ও খালই মূলত বাড়িয়ে তুলেছে বিলের আলাদা সৌন্দর্য। যেখানে পাওয়া যায় প্রাণ-প্রকৃতির স্পন্দন।
লোকগানে দিনরাত্রি
ভৌগোলিকভাবে
বিচ্ছিন্ন এ এলাকা। তাই
এখানকার মানুষের জীবনও অনেক সংগ্রামমুখর। প্রায়
ছয় মাস জলমগ্ন থাকে
বিলপারের গ্রামগুলো। পানিবন্দি সময় মাছ ধরা
আর গবাদি পশু পালন ছাড়া
তেমন কোনো কাজ থাকে
না। বিলপারের মানুষ রাতে মাছ ধরে
আর দিনে নৌকা নিয়ে
বাইচ খেলায় মেতে ওঠে। বড়
বড় কোষা ও পানসি
নিয়ে তারা বাইচ খেলে।
নারী-পুরুষ সবাই জড়ো হয়
বাইচ খেলা দেখতে। নৌকা
বাওয়ার সময় বিলের এক
পারের মাঝিরা আরেক পারের মাঝিদের
টিপ্পনী কেটে তৈরি করেন
গান ও লোকছড়া। যেমন,
‘নওগাঁয়ের নয়া কাজি, হাম
কুড়ার খাঁ/ঠেলাঠেলি করে
নাও ডুবাল পানি ছেঁছিল না।’
এ রকম অসংখ্য হাটুরে
কবিতা বা ভাট কবিতা
ছড়িয়ে আছে চলনবিলের মানুষের
মুখে মুখে। এ রকম হাজারো
ধুয়া, জারি, সারি ও জাগ
গান গেয়ে মাঝিমাল্লারা পাড়ি
দেয় চলনবিল। নিজেদের তৈরি করা গল্পগাথায়
কেটে যায় তাদের দিনরাত্রি।