ফারহাত মাইশা অর্পা
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৬:৪১ পিএম
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অভয়ারণ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা কুকুরের প্রজনন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে আসছে।
একটা সময় ছিল যখন ঢাকার রাস্তায় নিরাশ্রয় প্রাণীদের দুর্ভোগ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকাত না। তবে সময় বদলেছে। কয়েকটি মানবিক সংগঠন এগিয়ে এসেছে এ অবহেলিত প্রাণীদের পাশে।
সেই দিনটার কথা মনে পড়ে শফিকের, যখন রাস্তার ধারে আহত একটি কুকুর দেখে তিনি থমকে দাঁড়ান। মানুষের ভিড়ে কেউই তার দিকে তাকায়নি, কিন্তু শফিকের মন সাড়া দিয়েছিল। তিনি জানতেন কিছু একটা করতে হবে। এভাবেই শুরু হলো তার যাত্রা, যা পরে রূপ নেয় একটি প্রাণিকল্যাণ সংগঠনের, যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য কুকুর, বিড়াল এমনকি পাখিও পাচ্ছে নতুন জীবন।
মুক্তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যারা এ নীরব সংগ্রামে অংশ নিচ্ছেন। তারা নিজেদের অল্প সম্পদ দিয়ে প্রাণীদের চিকিৎসা, খাবার ও আশ্রয় দিচ্ছেন। এসব প্রাণী শুধু তাদের কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করছে না, বরং একেকটি নতুন গল্প হয়ে উঠছে মানবিকতার জয়গান।
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (PAW Foundation) প্রাণীদের অধিকার, কল্যাণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এ এনজিওটি ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিটি প্রাণীদের সুরক্ষায় নিয়োজিত। PAW Foundation-এর অধীনে রয়েছে তিনটি ভেটেরিনারি ক্লিনিক, যেখানে পোষা প্রাণী এবং রাস্তার অসহায় প্রাণীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া রেসকিউ করা প্রাণীদের জন্য রয়েছে বিশেষ চিকিৎসাসুবিধা এবং একটি আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে বর্তমানে ৫০টির বেশি প্রাণী চিকিৎসাধীন।
প্রাণীদের সুরক্ষায় ফাউন্ডেশনটির অন্যতম সেবা হলো ‘সবার ভেট’ সার্ভিস। এ সেবার মাধ্যমে যেকোনো সময় অ্যাম্বুলেন্সসহ দ্রুততর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় প্রাণীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রোধে জনসচেতনতা তৈরিতেও কাজ করে এ সংগঠনটি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘প্রাণীদের নিয়ে কাজের মূল চ্যালেঞ্জ হলো সচেতনতার অভাব। বাংলাদেশের মানুষ এখনও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়। এজন্য আমরা প্রতিনিয়ত জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। যেমন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনে গ্রাফিতি অঙ্কন এবং বিভিন্ন মানববন্ধনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেবল সচেতনতা তৈরি করলেই হবে না, এ উদ্যোগগুলো নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং সেগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে আইন কার্যকরে রাষ্ট্রেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের কাছে ছয় দফা দাবি পেশ করেছি।’
প্রাণিকল্যাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাণীদের নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং বাস্তবিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে কাজ করতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে প্রাণিকল্যাণ কীভাবে করা যায়, সে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে।’
PAW Foundation-এর এ প্রচেষ্টা প্রাণীদের জীবনে যে আলোর পথ দেখাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অভয়ারণ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা কুকুরের প্রজনন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে আসছে। প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমেদ প্রথমে রাজধানীর রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি কুকুরদের বন্ধ্যাকরণ এবং ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। অভয়ারণ্য ফাউন্ডেশন কুকুরদের বন্ধ্যাকরণ এবং ভ্যাকসিনেশনের পর তাদের কানকে ‘V’ আকারে কেটে চিহ্নিত করে, যা নির্দেশ করে যে এ কুকুরটি নিরাপদ এবং সেবা পেয়েছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় Cat Neuter Vaccinate Return (CNVR), যা বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার কুকুরকে এ প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে থাকে।
অভয়ারণ্য ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাওসার শাকিল বলেন, ‘কুকুরের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে অঢেল রিসোর্স দিয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এ সমস্যা খুবই প্রকট। সরকারের সহায়তা পেলে আমরা পুরো ঢাকা শহরে এ অপারেশন চালাতে পারব এবং আগামী ১০ বছরের মধ্যে এ সমস্যা পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হবে। আমাদের কাজটি করতে তিন বছর লাগবে এবং পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে এর ফল দৃশ্যমান হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অফিসাররা যখন কোনো এলাকায় গিয়ে কুকুরদের সেবা দিতে যান, তখন এলাকাবাসীর ভুল বোঝাবুঝির কারণে মারধরের শিকার হন। সচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সরকারকে বোঝানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ যে এ কাজটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
অভয়ারণ্য ফাউন্ডেশন কুকুরের প্রজনন নিয়ন্ত্রণে যে অভূতপূর্ব কাজ করে চলেছে, তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রাণিকল্যাণে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
কেয়ার ফর পজ একটি প্রাণিকল্যাণ সংগঠন, যা রাস্তায় আহত এবং অবহেলিত মালিকানাহীন কুকুর-বিড়ালদের উদ্ধার করে। এ সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক দল এ ধরনের প্রাণীদের সংগ্রহ এবং তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও যত্ন প্রদান করে। যখন প্রাণীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন সংগঠনটি ফেসবুকে সুস্থ হয়ে ওঠা প্রাণীদের ছবি আপলোড করে। ফেসবুকের এ পোস্টের মাধ্যমে প্রাণীপ্রেমী মানুষ তাদের দত্তক নিতে এগিয়ে আসেন।
সংস্থাটির কর্মকর্তা তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রমের ফলে আমরা কেয়ার ফর পজ নামে একটি পশু হাসপাতাল গড়ে তুলেছি, যা সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা সেবা প্রদানে সক্ষম। এখানে আহত কুকুর-বিড়ালের চিকিৎসা, যত্ন এবং জলাতঙ্কসহ অন্যান্য রোগের টিকা প্রদান করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, যদি সবাইকে সচেতন করা যায় তাহলে একদিন প্রাণীদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাবও দূর হবে। এ সচেতনতা ছড়ানোই আমাদের সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য।’
এ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান, ‘আমরা ভবিষ্যতে আরও বড় এবং আধুনিক একটি পশু হাসপাতাল গড়ার স্বপ্ন দেখি, যেখানে কোনো অসহায় প্রাণী চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না। এ ছাড়া আমরা এমন একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যা মানুষের হাসপাতালের মতোই সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করবে এবং পশুপাখির সব রোগের উন্নত চিকিৎসা সম্ভব হবে। দেশের জন্যও স্বপ্ন দেখি। আশা করি একদিন বাংলাদেশ জলাতঙ্কমুক্ত হবে এবং আমাদের দেশের মানুষ ও অসহায় প্রাণী নিরাপদ থাকবে।’