অহিদুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৪ ১১:৫২ এএম
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৪ ১২:২২ পিএম
নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র যেন মরা খাল। দখলের পাশাপাশি নদের পানি দূষিত হচ্ছে কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে ছবি : শামীম মিয়া
চীন, তিব্বত ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কোথাও ব্রহ্মপুত্র কোথাওবা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের আজ মরণদশা। দেশের কয়েকটি জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এ নদ জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকটি উপনদী। দখল, দূষণ আর চর পড়ে বিপন্ন ব্রহ্মপুত্রের প্রাণ ফেরাতে হাজার কোটি টাকার সরকারি উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে অব্যবস্থাপনার ফলে। এ বিষয়ে লিখেছেন অহিদুর রহমান
দখল-দূষণ, নগরায়ণ, অপরিকল্পিত খনন, ব্রিজ, বাঁধ, পানিপ্রবাহ, ভিন্নমুখকরণ, অতি আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাংলাদেশের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ এখন যেন লাশ। পৃথিবীর বৃহত্তম ১৫তম এ জলধারা হুমকির সম্মুখীন। ১৯৬৯ সালে মানুষ যখন প্রথম চাঁদে পৌঁছে তখন চাঁদ থেকে নভোচারীরা ব্রহ্মপুত্রের জলধারা দেখতে পেয়েছিলেন। চন্দ্রবিজয়ের ৫৫ বছর পর এ বৃহৎ জলধারার কিনারে দাঁড়িয়ে চর ছাড়া ভিন্ন কিছু দেখা যায় না। চীন, তিব্বত, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৩ হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গড়ে তুলেছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৩৫ বর্গ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন অববাহিকা। ব্রহ্মপুত্র নদ তার প্রবাহপথে তিনটি ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করেছে। তিব্বতের সাংপো অববাহিকার সম্পূর্ণ অংশ বৌদ্ধধর্ম অধ্যুষিত, আসামের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় হিন্দুধর্মের প্রভাব। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা অববাহিকায় রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্যের শত শত নিদর্শন।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত ধারা বাংলার দক্ষিণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে। যার আয়তন ৫৯ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের একাধিক মোহনা রয়েছে। যেমন মেঘনা মোহনা। ব্রহ্মপুত্র প্লাবনভূমি এলাকাটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন বৃষ্টিস্নাত অঞ্চল। নদের প্রবাহে অসংখ্য চর রয়েছে এর মধ্যে ‘মাজলি’ নামক চর বা দ্বীপ নদী দ্বারা সৃষ্ট দ্বীপের মধ্যে বিশ্বে সর্ববৃহৎ। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা সবচেয়ে ভূকম্পন এলাকা। ১৭৬২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ৪৬৬ বার ভূকম্পন হয়েছে। বিধ্বংসী ভূকম্পন হয়েছে ১৭৬২, ১৭৮৫ ও ১৮৯৭ সালে। ১৮৯৭ সালের ভূকম্পনে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাতটি নদী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৮৬৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসের সন্ধানে অভিযাত্রীরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ১৮৬৪ সালে অভিযাত্রী এডমন্ড স্মিথ, রবার্ট ডামন্ড ও টমাস ওয়বার, ভারতের দক্ষ অভিযাত্রী নয়ন সিং রাওঘাত, ১৯০৪ সালে অভিযাত্রী সিসিল রলিংস, ক্যাপ্টেন সিএইচডি বাউটার ও লেফটেন্যান্ট এরিক বেইলি, ১৯০৬ সালে সুইডেনের সোয়েন হেডিন, ১৯৩০ সালে ভারতীয় ভূগোলবিদ স্বামী প্রণবানন্দ, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের ড. শহীদ আলম ব্রহ্মপুত্রের উৎসের খোঁজে অভিযান পরিচালনা করেন। সবশেষে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সের সহায়তায় লিউ শাও চুয়াং নামক অভিযাত্রীর কাছ থেকে। তার ভাষ্যমতে, হিমালয় পর্বতমালার উত্তর দিকের অংশে অবস্থিত তিব্বতের বুরাং কাউন্টির আঙ্গসি নামক হিমবাহই হচ্ছে সাংপো বা ব্রহ্মপুত্রের আসল উৎস। শুধু চেমা থংডুং হিমবাহই এককভাবে ব্রহ্মপুত্রের উৎস নয়। বরং প্রধান উৎস হচ্ছে আঙ্গসি নামক হিমবাহ, কুবি ও চেমায়ুংডং। এ তিনটি হিমবাহের অবস্থান তিব্বতের বুরাং নামক কাউন্টিতে। এখানে আছে তিনটি হ্রদ বা সরোবর। যেমন মানস, রাক্ষসতাল ও মাপাস।
সারা বিশ্বে নদ-নদীর তালিকায় পানি নিষ্কাশনের দিক থেকে নবম এবং দৈর্ঘ্যের হিসাবে পৃথিবীর ১৫তম বৃহত্তম ব্রহ্মপুত্র জলধারা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৫ কোটি বছর আগে টেকটোনিক প্লেটের মহাসংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট হিমালয়ের কৈলাস শৃঙ্গের মানসসরোবরের আঙ্গসি হিমবাহের ৫ হাজার ২১০ মিটার উঁচু (১৭ হাজার ৯৩ ফিট) থেকে জন্ম নেওয়া ব্রহ্মপুত্র সৃষ্টি হয়ে তিব্বতের বুকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম উপত্যকা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতের আসাম হয়ে পরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পাখিউড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার পাগলার চর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলে পদ্মায় প্রবাহিত হয়েছে যমুনা নদী হিসেবে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ; শেরপুরের সদর, নকলা; ময়মনসিংহের সদর, ফুলপুর, ত্রিশাল, গফরগাঁও; কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, ভৈরব, কটিয়াদী, কুলিয়ারচর; গাজীপুরের শ্রীপুর; নরসিংদীর বেলাবো অতিক্রম করে ভৈরব বাজারের দক্ষিণে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং মেঘনার সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। অঞ্চলভেদে সাংপো (তিব্বত), ইয়ারলুং জাংবো (চীন), লৌহিত্য, লোহিত, দিহাং (আসাম), পুরাতন ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশ) নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক এ নদটিকে সাধারণত বাংলাদেশে এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নামে ডাকা হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদ তার যাত্রাকালে বেশ কিছু উপনদীর জন্ম দিয়েছে। উপনদীর সংখ্যা ১৮ আর ১৭ শাখা নদী। বাংলাদেশের ভেতরে উপনদীর মধ্যে ধরলার দৈর্ঘ্য ৭৫, তিস্তার ১১২, মৃগীর ৬২, গিরাইয়ের ৫৬ কিমি। এ ছাড়া আছে গঙ্গাধর, দুধকুমার, দিবাং, লৌহিত, ধানসিঁড়ি, কামেক, রায়ডাক, জলঢাকা, কালজানি, তোরসা, নাগর, দুপচাঁপিয়া, যমুনেশ্বরী, আত্রাই নদী। শাখা নদীর মধ্যে আছে ঝিনাই ১৩৩, আইমান ৬১, আখিলা, বানার ৯৬, সুতিয়া ৩৭, শীতলক্ষ্যা ১০৮, নরসুন্দা ৫৭, আড়িয়াল খাঁ ৬০, ঘাগট ১৯২ কিমি। এ ছাড়া আছে বাঙালি, বড়াল, গঙ্গা, নারদ, তুলসীগঙ্গা, শিববরনাই, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা।
এ নদের যাত্রাপথে অসংখ্য চর ও দ্বীপের জন্ম হয়েছে। এ নদের মাজুলি দ্বীপকে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী-দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উৎস থেকে চীন ও ভারতে ব্রক্ষপুত্রে মিশেছে বুঢ়হিদিহিং, দিখু, কপিলা, সুবানসিরি, কামেং, মানস, সংকোষের মতো জলপ্রবাহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পুরাতন ব্রহ্মপুত্রকে ‘নদী’ এবং ব্রহ্মপুত্রকে ‘নদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া উত্তর-পশ্চিম হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলে যমুনা, তিস্তা ও ধরলার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনা নদীতে মিশেছে। ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকা ৫ হাজার ৪৩১ বর্গ কিলোমিটার। আইডি নম্বর : ১৭৭। ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুরের নদ ব্রহ্মপুত্র তিব্বতের কৈলাসটিলার মানসসরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীতে মিশেছে। ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের অববাহিকা ২ হাজার ৫৯০ বর্গ কিলোমিটার। আইডি নম্বর : ২১১। নদী খতিয়ানে যদি এরা উভয়েই ‘ব্রহ্মপুত্র’ হয় তবে রাষ্ট্রীয় দলিলে এ জলধারার একক পরিচয় এবং একক আইডি থাকাটা খুবই দরকার।
যাতায়াতের সুবিধার জন্য নদীতীরে গড়ে ওঠে নগর, জনপদ। যোগাযোগের জন্য ব্রহ্মপুত্র ছিল যেন এক তরল মহাসড়ক। নদীপথে লঞ্চ, স্টিমার দিয়ে ব্যবসা চলত। নদীতীরে নগর, বন্দর, গ্রাম, থানার প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। যেমন বেপারী নৌকা দিয়ে ব্যবসা চলত, ধানপাট, লাকড়ি, কাঠ, বাঁশ ও মাছের ব্যবসা। নদীর তীরে গড়ে ওঠে জেলেপাড়াগুলো। সঙ্গত কারণেই জেলেরা পেশা, জীবনজীবিকার জন্য সম্পূর্ণভাবে ব্রহ্মপুত্র নদের জলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। নদীতে মাছ ধরে বংশপরম্পরায় তাদের জীবন চলত। নদী বিলুপ্তি, দখল-দূষণের ফলে জেলেরা ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে বহু নদী হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া সেসব নদীর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক জলজ প্রাণবৈচিত্র্য। মাঝখানে লাভ হচ্ছে দখলদারদের ও ঠিকাদারদের।
ব্রহ্মপুত্র নদসহ ময়মনসিংহের অনেক নদী এখন ভয়ানকভাবে বিপন্ন। তাই নদীর প্রাণবৈচিত্র্যও এখন ভীষণভাবে সংকটাপন্ন। একসময় যেসব নদী ছিল প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, আজ সেসব পরিণত হয়েছে প্রায় প্রাণশূন্য সংকীর্ণ স্রোতধারায় কিংবা বিষাক্ত নর্দমায়। একসময়ের বিস্মৃত অতল জলরাশি ভরা ব্রহ্মপুত্র নদ এখন দেখা যায় অবিস্তীর্ণ অগভীর বালিয়াড়ি ভরা এক শীর্ণকায় স্রোতস্বিনী হিসেবে। আবার কোনো কোনো জায়গায় নদী সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়ে তৈরি হয়েছে ফসলের ক্ষেত কিংবা স্থাপনা।
বাংলাদেশের প্রধান ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র পললগঠিত অঞ্চল-৯। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অববাহিকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। প্রবহমান জলধারা উভয় পারের মাটিকে পলিধারা করেছে উর্বর ও বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাসভূমি। এ অঞ্চলের মাটি বিশ্বের সেরা উর্বর মাটির অন্যতম। এমাটিতে ধান, গম, ডাল, তেলজাতীয় ফসল, চা, বৈচিত্র্যময় সবজি, বাদাম, আলু, আখ, ভুট্টা, পাট, মসলা জাতীয় ফসল, আগরজাতীয় সবচেয়ে সুগন্ধিজাতীয় কাঠ উৎপাদন হয় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়। বর্তমানে পানি না থাকার কারণে হাজার হাজার কৃষক ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকার ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে আয়রন ও আর্সেনিক। এখন আর ব্রহ্মপুত্রে পানি নেই। স্রোত নেই। কৃষকের কৃষি খরচ বেড়ে গেছে। খাদ্য উৎপাদনও কমে যায়।
ব্রহ্মপুত্র যেন এক সাংস্কৃতিক বলয়। ময়মনসিংহ গীতিকার অনেক গল্প, কাহিনী, শ্লোক, ছড়া, নদী কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদী যত বিলুপ্ত হচ্ছে, মানুষ ততই দিনদিন প্রকৃতি থেকে সরে যাচ্ছে। প্রকৃতি থেকে যত সরে যাবে তত বেশি মানুষ সংস্কৃতিহীন, বিপন্ন হয়ে উঠবে।
চিন্তার বিষয় হলো এশিয়ান ওয়াটার টাওয়ার, এশিয়ার প্রধান নদ-নদী এশিয়ান ওয়াটার তিব্বতের মালভূমি। এ তিব্বত থেকে উৎপত্তি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, সিন্ধু, কার্নালি, কোশি, সালুইন, ইরাবতী, মেকঙ, ইয়াংসি, ইয়েলোর মতো এশিয়ার বড় নদী। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনামের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ তার জীবনজীবিকার জন্য সরাসরি নির্ভরশীল নদীর ওপর। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিব্বতের মালভূমিতে যখন দুর্যোগের অভিঘাত লাগে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। কারণ ব্রহ্মপুত্রসহ আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীর মাধ্যমে ভাটির দেশে চলে আসে পানি, শুরু হয় বন্যা, পাহাড়ধস, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ, কৃষি, জীবনজীবিকা। নদীপ্রণালি হলো এ অভিঘাত আসার রাস্তা।
নদীরক্ষা কমিশন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের দখলদারের তালিকায় দেখা যায় ময়মনসিংহ শহরে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন, মেয়র ও তার পরিবার, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ময়মনসিংহ জেলায় নদ-নদী ও খাল দখলের তালিকায় ১৩ উপজেলায় ২ হাজার ১৬০টি দখল আছে। সদর উপজেলাতেই ১ হাজার ৫০৪ ও নান্দাইল উপজেলায় ৩৪২টি। সিটি করপোরেশন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানার বেশিরভাগ বর্জ্য এ নদে ফেলা হয়। কিশোরগঞ্জের কটিয়াটীতে ব্রহ্মপুত্র দখল করে পুকুর করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পুকুরপারে করা হয়েছে আমবাগান। দুই তীর দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, অফিস, বাসাবাড়ি, গাড়ির গ্যারেজ, বাসস্ট্যান্ড। চলছে খনন, বালু ব্যবসা।
১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন হলে নাব্য ফিরে আসবে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা (সদ্যপদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী) ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠে নির্বাচনী জনসভায় ব্রহ্মপুত্র খননের কথা বলেছিলেন। ২০০৯ সালে ময়মনসিংহের নাগরিকসমাজ নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র খনন নিয়ে মতবিনিময় করে। ২০১০ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ দল ব্রহ্মপুত্র পরিদর্শন করে। ২০১৯ সালে নদের নাব্য, যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল, কৃষিজমি, মৎস্যসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ফুলছড়ি উপজেলার পাগলার চর যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল থেকে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিমি এলাকা ড্রেজিং করার জন্য চার বছর মেয়াদি ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকার ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ বছর প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু অপরিকল্পিত অকার্যকর এ প্রকল্প কোনো কাজেই আসছে না। যেখানেই খনন করা হচ্ছে সেখানেই চর জাগছে, নদটি একটি সরু খালে পরিণত হচ্ছে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে ঠিকাদার ও বালু ব্যবসায়ীরা। নদ-নদী বাঁচাতে হলে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। জরিপ করে নদ-নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে, পরিবেশনীতির বাস্তবায়ন, দূষণ হ্রাসকরণ, নদ-নদী, উৎসমুখ, শাখা নদী, উপনদী, সংযোগ খাল খনন করতে হবে, অপরিকল্পিত বাঁধ, সেতু নির্মাণ করা যাবে না, জনসচেতনতা তৈরি করা, নদী দখলকারীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়া, ব্যাংক ঋণ না দেওয়া বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জলধারা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি জনপদ বিপন্ন হয়ে যায়, নদী হারিয়ে যায়, প্রকৃতির সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্র তীরে হেঁটে আমরা বুকভরা নির্মল বাতাস গ্রহণ করেছি। নৌকায় চড়ে নতুন বিয়ে করে জামাই শ্বশুরবাড়ি গেছে, বউ আনন্দে নাইওর করেছে। নদীর জলে অবাধ সাঁতার কেটেছে বালক-বালিকা, নারী-পুরুষ সবাই মাছ ধরেছে জাল দিয়ে, বড়শি দিয়ে, নৌকা ভ্রমণ করেছে সাথিরা মিলে। ব্রহ্মপুত্র বিলুপ্তির কারণে পানির জন্য আজ হাহাকার, ভূগর্ভের পানি আজ অনেক নিচে নেমে গেছে। নদীর জলে এখন আর গোসল করতে পারে না। নদীর দখল-দূষণ আমাদের শুধুই আহত করে। ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে ধু-ধু বালুচর, পারে ময়লার স্তূপ, পানিতে ময়লা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাদেকুর রহমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানির গুণগত মান নিয়ে ২০১৯ সালে এক গবেষণায় জানিয়েছিলেন, এ পানিতে জলজপ্রাণী বাঁচতে পারবে না। মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য।
ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় টিকে থাকার জন্য নদের অস্তিত্ব চাই, স্বাভাবিক প্রবাহ চাই, নদ কেড়ে নিক আমার বসতভিটা, আমার গোয়ালের গরু, ফসলের জমিন, গোলার ধান, সেটা নদ-নদীরই অধিকার। নদী এপার ভেঙে ওপার গড়েছে, পলি জমিয়েছে আমার ফসলি জমিতে, চর জাগিয়েছে, ওপারে নতুন বসতি গড়ে তুলেছি। আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে ব্রহ্মপুত্র বাঁচানোর আন্দোলন। ব্রহ্মপুত্র বাঁচলে এ জনপদ বাঁচবে, বাঁচবে প্রকৃতি।