মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৪ ১২:১৩ পিএম
৮৯ বছরের পুরোনো গান্ধী আশ্রম
জামালপুর জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মেলান্দহ উপজেলার নিভৃত পল্লী কাপাসহাটিয়া। ঝিনাই নদীর তীরের এ গ্রাম এখন মানুষের কাছে পরিচিত। কেননা এখানেই রয়েছে ৮৯ বছরের পুরোনো একটি অফিস ঘর, যেটি ‘গান্ধী আশ্রম’ নামে পরিচিত। ঘরটি মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন সময়ের ছবি ও তথ্য দিয়ে সাজানো। এখানে এসে যে কেউ মুগ্ধ হবেন বিভিন্ন গাছপালায় ঘেরা ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ দেখে।
ঢোকার পথে চোখে পড়ল দুর্লভ বিউমন্টিয়ার ঝাড়। ১৯৩৪ সালে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক নাসির উদ্দিন সরকার। তিনি যুবক বয়সেই মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরাধীনতার গ্লানি মোচনে দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সংকল্প নিয়ে অহিংস-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। এ লক্ষ্যে আশ্রমটিতে মানুষকে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে চরকায় সুতা তৈরি, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, কাপড় বোনা, হস্তশিল্পজাত নানা সামগ্রী তৈরি, শিক্ষা ও স্বাবলম্বনের নানা কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবা ও শরীরচর্চা কার্যক্রম চালাতেন। এই আশ্রম তখন পরিণত হয়েছিল ওই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের মিলনমেলায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই আশ্রমের বিভিন্ন কার্যক্রমে আঘাত আসতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালে হামলা চালিয়ে আশ্রমটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, টিকে থাকে শুধু অফিস ঘরটি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২ অক্টোবর গান্ধীর জন্মদিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে পুনরায় শুরু হয় মানবকল্যাণে গান্ধী আশ্রমের নানা কার্যক্রম। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সব কার্যক্রম। নাসির সরকারের ঐতিহাসিক বাড়িটি ঘিরে গড়ে উঠেছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। জাদুঘরটি দোতলা। নিচতলায় আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের একটি মানচিত্র, জামালপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত নানা ইতিহাস। গান্ধী আশ্রম ও মুক্তসংগ্রাম জাদুঘরে স্বদেশী আন্দোলনের সময়কার আশ্রমে ব্যবহৃত চরকা, পুরোনো সিন্দুক, চেয়ার-টেবিল, তখনকার ছাত্রীদের তৈরি নানা সূচিকর্ম ছাড়াও আশ্রমের নাসির উদ্দিন স্মৃতি পাঠাগারে রয়েছে দুর্লভ বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ। এখানে আরও রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের নানা স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি। একই সঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একটি গ্যালারিও। পরিপাটি সাজানো-গোছানো আশ্রম ও জাদুঘরটি বর্তমানে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, ইতিহাসের বাতিঘর, ধারক ও বাহক হিসেবে।
প্রতিদিন কাপাসহাটিয়ায় গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে শিক্ষার্থী ছাড়াও আসেন অনেক দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী। মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের সঙ্গেই রয়েছে নান্দনিক অতিথিশালা। এটি হাজারো দর্শনার্থীর ইতিহাস চেতনাকে করেছে সমৃদ্ধ। এটি এখন ইতিহাস সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়াও এখানে গ্রামের শিক্ষার্থী ও মানুষকে স্বনির্ভর করতে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণ।
বর্তমানে আশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা নাসির উদ্দিন সরকারের নাতি হিল্লোল সরকার বলেন, ‘জামালপুর জেলাসহ দেশের সব জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাদুঘর পরিদর্শন করে ইতিহাসকে জানবে ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও ইতিহাসনির্ভর এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে নতুন প্রজন্ম একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে, তেমনি উদ্বুদ্ধ হতে পারবে দেশপ্রেমের চেতনায়।
যেভাবে আসতে হবে : দেশের যেকোনো জায়গা থেকে ট্রেনে অথবা বাসে জামালপুর এসে, গেটপাড় থেকে অটো বা সিএনজিযোগে হাজীপুর বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে অটোতে কাপাসহাটিয়া।