× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হারিয়ে যাওয়া পুথির খোঁজে

শিশির কুমার নাথ

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১২:১১ পিএম

পুথিপাঠক আবদুল মালিক। বয়সের কারণে গলায় নেই আগের সেই সুর, তবুও চেষ্টা করেন সেই চর্চা চালিয়ে নিতে। তার পুথির আসরে লেখকসহ অন্যরা। প্রবা ফটো

পুথিপাঠক আবদুল মালিক। বয়সের কারণে গলায় নেই আগের সেই সুর, তবুও চেষ্টা করেন সেই চর্চা চালিয়ে নিতে। তার পুথির আসরে লেখকসহ অন্যরা। প্রবা ফটো

একটা সময় গ্রাম-বাংলায় ছিল পুথিপাঠের চর্চা। কাহিনীর বর্ণনা আর সুরের মূর্ছনায় চলত পাঠ। শ্রোতারাও হতেন মুগ্ধ। সময়ের পালাবদলে হারিয়ে গেছে পুথি। তবুও কেউ কেউ ধরে রেখেছেন সেই চর্চা। তেমনই একজন সিলেটের আবদুল মালিক। তার সংগ্রহ এবং পুথিপাঠ শুনে এসে লিখেছেন শিশির কুমার নাথ

এখনও রাত বাড়ে, হাজার বছরের পুরোনো সেই রাত! আলো-আঁধারিতে পুথিপাঠের আসর জমে না আর। একটা সময় গ্রামে গ্রামে পুথি পাঠ হতো। সাধারণ পাঠকই সুরে সুরে পাঠ করত, পাড়ার লোকের কাছে হয়ে উঠত অসাধারণ পাঠক। সাধারণত সন্ধ্যায় অথবা রাতের বেলা সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করে কোনো এক আঙিনায় জড়ো হতো। হারিকেনের টিমটিমে আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধফালি চাঁদও জাগত। চাটাই অথবা খড় বিছিয়ে চলত আসন পাতার কাজ। জলচৌকিতে পুথি রেখে পাঠক আসন পাতত শ্রোতাদের সামনে। তারপর সুর করে পাঠ চলত। কয়েক লাইন পড়ে পাঠক থামত এবং এর মর্মার্থ সামনে উপস্থিত শ্রোতাদের বুঝিয়ে দিত। কখনও হাসি কখনও বা চোখের কোণে জমত অশ্রু। রাত যত গভীর হতে থাকত পুথিপাঠ ততই জমে উঠত। বাড়ির ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে মহিলারাও পুথি শুনত। এক একটি পুথি পাঠ করে শেষ করতে লেগে যেত অনেক দিন। কখনও কখনও মাসও পারিয়ে যেত। কাহিনীর বর্ণনা, সুরের মূর্ছনা, নানা অঙ্গভঙ্গি আর হাস্যরসাত্মক কথার মধ্য দিয়ে পাঠ শ্রোতাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। গুলে বকাওলি, আমীর হামজা, গাজী-কালু-চম্পাবতী, ভেলুয়া সুন্দরী, দেলদার ও কুমার, জয়গুণ, লাইলি মজনু, ইউসুফ জুলেখাসহ ছিল কত নামের পুথি! যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এসব হারানো সম্পদের প্রতি আমার আগ্রহ বরাবরই। সুযোগ পেলেই সংগ্রহের চেষ্টা করি। কথা বলি পাঠকের সঙ্গে, জানতে চাই সেসব স্মৃতিময় দিনের কথা। এ পথে চলতে গিয়ে জানা হয় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার লামাগংগাপুর গ্রামের পাঠক আবদুল মালিকের কথা। পাঠ শোনা ও সংগ্রহের নেশায় হাজির হই বয়োবৃদ্ধ এ পাঠকের দুয়ারে।

সময় বদলেছে। গুণী এ পাঠকের কণ্ঠে আগের মতো সুর চড়ে না আর। জীর্ণ  খানার ঠাঁই কেবল শিয়রের নিচে। মাঝেমধ্যে বের করে গুনগুন করেন। তবে দৃষ্টি আর সায় দেয় না, কণ্ঠও বাদ সাধে। আবদার রাখলে নিরাশ হতে হয়নি। ঘরোয়া পরিবেশে  পাঠের একটি আয়োজন করা গেল। ছুঁয়ে দেখা গেল বিখ্যাত আমীর হামজা খানা। বইটির কাঠখোদাই ছাপা ছবিগুলো সেই ভুলে যাওয়া শিল্প ও শিল্পীকে মনে করিয়ে দেয়। মুদ্রণশিল্পের সাবেকি ধারাও স্পষ্ট। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, ‘আমীর হামজা মধ্যযুগের দোভাষী  সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাব্য। এতে বীর যোদ্ধা আমীর হামজার যুদ্ধজয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ফারসি ‘দস্তান-ই-আমির হামজা’র অনুসরণে বাংলা ভাষায় প্রথম ১৬৮৪ সালে আমীর হামজা কাব্য রচনা করেন চট্টগ্রামের কবি আবদুন নবী। এরপর ফকির গরিবুল্লাহ ও সৈয়দ হামজা যৌথভাবে একই বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেন। এর প্রথম অংশ গরিবুল্লাহ রচনা করেন আঠারো শতকের মধ্যভাগে, বাকি অংশ তার শিষ্য সৈয়দ হামজা ১৭৯৪ সালে সমাপ্ত করেন। পরে বটতলার ছাপাখানায় এটি মুদ্রিত হয়ে প্রচারের সুযোগ পায় বলে অধিক জনপ্রিয় হয়। কাব্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি প্রেম-সম্ভোগেরও বিস্তর বর্ণনা আছে। লৌকিক-অলৌকিক, ঐতিহাসিক-কাল্পনিক বহু ঘটনা এবং প্রধান-অপ্রধান নানা চরিত্রের সমাবেশে কাহিনী পল্লবিত হয়ে আমীর হামজা মহাকাব্যতুল্য বিশালতা লাভ করেছে। যুদ্ধের প্রাধান্যের কারণে কাব্যখানি ‘আমীর হামজার জঙ্গনামা’ নামেও পরিচিত।

আমীর হামজার পাঠ শুনতে শুনতে কথা হয় আবদুল মালিকের সঙ্গে। জানান,  বিদ্যার হাতেখড়ি বাবার কাছে। মা-ও খুব আদর করতেন। মা নিয়ত করেছিলেন মেয়ে হলে নাম রাখবেন সুন্দরী। কিন্তু ছেলে হওয়ায় আবদুল মালিকের ডাকনাম রাখা হলো সুন্দর। সুন্দর থেকে গাঁয়ের লোকের কাছে হলেন সিন্দু। বললেন, বাবার স্মৃতি এখনও খুব টানে। বাবা আবদুল জব্বার ছিলেন নামকরা পাঠক। নাগরী পড়তে জানতেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসত পাঠের। ফোক আর গান, পাঠকের লড়াই চলত সমানে সমান। ঘুমভাঙানিয়া সে সুরে কত রাত কাবু হয়েছে, কত পথিক থমকে দাঁড়িয়েছে, কত নিশিপাখি সুর ভুলেছে সে হিসাবের খাতা বেশ ভারী! গ্রামের আলী মোহাম্মদ তানভীর জুনেদ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এসব নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটা অজানা। স্কুলে যাওয়া-আসার সময় সুন্দর দাদার কথামালা রাস্তা থেকে শোনা যেত। সোনালি সময় ছিল।’

সিলেটের মুসলমান সমাজে পাঠ ছিল প্রাত্যহিক চর্চার অংশ। এ প্রসঙ্গে নাগরী লিপি গবেষক মোস্তফা সেলিম বলেন, ‘বিশেষত নাগরী লিপিতে লেখা ছিল নিত্যদিনের পাঠ। সহজসরল ভাষায় লেখা এসব মানুষকে যেমন উজ্জীবিত করেছে ধর্মবোধে, তেমন প্রেম-রোমান্টিকতা কিংবা সামাজিক আখ্যাননির্ভরতাও জুগিয়েছে সচেতনা, বিনোদন। পুথিপাঠের আসর ছিল সামাজিক মিলনের, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা তৈরির এক প্ল্যাটফর্ম।’

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় পাঠক এথেন্স শাওন বলেন, ‘মানুষ এখনো পুরোনো বিষয় শুনতে চায়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠকালে দেখেছি তরুণ-তরুণীরা বেশ মুগ্ধ হয়। কিন্তু পাঠক পাওয়া দায়। যদিও নাটকের চরিত্রের প্রয়োজনে কিছুটা চর্চা অব্যাহত রয়েছে।’

পাঠকর্তা আবদুল মালিকও মনে করেন বর্তমানে গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে জানে না কী জিনিস, তা কীভাবে পাঠ করা হতো। তখনকার সময়ের ছেলেমেয়েরা পাঠ বা গ্রামীণ কেচ্ছা-পালাগান শুনে বিনোদন পেত। আর এখন মোবাইল ফোন, টেলিভিশনসহ বহু বিনোদনমাধ্যম রয়েছে। তবে সেকাল আর একালের বিনোদনে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে পাঠ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তা না হলে একসময় তারা জানবেই না বাংলা সাহিত্যেরও একটা স্বর্ণযুগ ছিল। এসব কেবল নির্মল বিনোদনের মাধ্যমই ছিল না, ছিল পাড়াপড়শির মিলনমেলার ক্ষেত্র। সামাজিক বন্ধনও মজবুত হতো এসব সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে। যারা সাহিত্যপ্রেমী, লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, গবেষণা করেন সেসব ব্যক্তি ও সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায়  সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য। সংগ্রহ করে রাখতে হবে প্রাচীন ও এর সুর। কথা বলতে বলতে ৭২ বছরের বৃদ্ধের কাঁপা কাঁপা গলায় পয়ার ওঠেÑ *যেই যাহা রোপে গাছ সেই ফল ফলে।। বদি কৈলে নেকি নাহি হয় কোনকালে * কেবা কোথা শুনিয়াছ বেল গাছে আম।। যেই যাহা করে তাহা পায় পরিণাম * ফকির গরীব কহে এই বাত ছহি।। সেই দড় জাহা আপে করেন এলাহি *। [আমীর হামজা]

ছন্দ, সুর, কথা ও কাহিনীতে জমে ওঠে হারিয়ে যাওয়া পাঠের আসর। মনের ভেতরও যেন বাহুড়ি ডঙ্কা বাজে, ছুটে চলে সবরঙ ঘোড়া। মোহাচ্ছন্নের কাব্যে ঘোর লাগে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা