অন্ধ গায়ক বিকাশ সূত্রধর
সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১২:০২ পিএম
অন্ধ গায়ক বিকাশ সূত্রধর। প্রবা ফটো
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর অন্ধ গায়ক বিকাশ সূত্রধর। মা হারিয়েছেন শৈশবে। এরপর থেকে জীবনজুড়ে তার দারিদ্র্যের কশাঘাত। নিজের অক্ষমতায় ভিক্ষা না করে গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে করছেন উপার্জন। তাকে নিয়ে লেখা
‘গুরু উপায় বলো না, জনমদুঃখী কপাল পোড়া গুরু আমি একজনা’, ‘আমি এক অন্ধ, কপাল মন্দ, ভবের দুনিয়ায় গুরু, মা হারা আমি এক অসহায়’ অথবা ‘আর কতকাল ভাসব আমি দুঃখের সাগরে’Ñ পথে পথে এসব হৃদয়ছোঁয় গান গেয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছয় বছর ধরে কাটছে মা হারা জন্মান্ধ বিকাশ সূত্রধরের দিন।
শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ নিজের অক্ষমতা পুঁজি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ার হাজারো উদাহরণ রয়েছে সমাজে। কিছু ব্যতিক্রম চিত্রও দেখা যায়। যারা নিজের অক্ষমতা উপেক্ষা করে কাজ দিয়ে পরিবারের অন্নসংস্থানে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনি এক জন্মান্ধ প্রতিবন্ধী কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পৌরসভার চড়িয়াকোনা গ্রামের আঠারো বছর বয়সী হরিবল সূত্রধরের ছেলে বিকাশ সূত্রধর।
সম্প্রতি সরেজমিনে বিকাশ সূত্রধরের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ছাউনির টিনগুলো মরিচা পড়ে ছিদ্র হয়ে গেছে। সেগুলো বন্ধ করতে পলিথিন বিছিয়ে তার ওপর ইট ও খড়ির চাপা দিয়ে দিয়েছে প্রতিবেশীরা। দরজা-জানালার কপাট ভেঙে গেছে। এসব জানালা-দরজা চটের বস্তা দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করেছে প্রতিবেশীরা। তার নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। তাই প্রতিবেশীদের কাছেই থাকে বিকাশ সূত্রধর। এ সময় স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ঘরটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে ঘরের ভেতর পানি পড়ে। শীতের সময় ঠান্ডা লাগে। এতে বিকাশ সূত্রধর নানা সমস্যার মধ্যে থাকলেও সরকারিভাবে তা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, বিকাশ সূত্রধর জন্মের পর থেকেই অন্ধ। আট বছর আগে বিকাশের মা সন্তান প্রসবের সময় মারা যান। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে বিকাশ মেজো। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন রয়েছে সঙ্গে। বিকাশের মা মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেন বাবা। সৎ-মা সংসারে আসার পর থেকে কষ্ট আরও বাড়তে থাকে। তাকে বাড়তি বোঝা মনে করেন সব সময়ই। একসময় ভিক্ষায় নেমে পড়ে বিকাশ। একদিন তার কাছে মনে হয়, ভিক্ষা করলে মানুষের কাছে ছোট হতে হয়। তাই আর হাত পাতা নয়। বিকাশ সিদ্ধান্ত নেয়, ভিক্ষার বদলে গান গাইবে। আর গান গেয়েই টাকা আয় করবে। যে কথা সে কাজ। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে বিকাশ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া শুরু করে।
বিকাশ সূত্রধর বলে, ‘আমি দুঃখের গান গাই, সুখের গানও গাই। দর্শকের পছন্দের গানও গাই। গান গাই জীবনধারণের জন্য।’ বিকাশ গান গেয়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে। কখনও কখনও ১ হাজার টাকাও হয়। এ টাকা দিয়েই চলছে জীবন। বিকাশ আরও বলে, ‘অনেকে আমাকে ভিক্ষা করতে বলে কিন্তু কারও কাছে হাত পেতে সাহায্য চাওয়া মানে নিজেকে অন্যের কাছে বিলিয়ে দেওয়া।’ বিকাশ জানায়, যত দিন বেঁচে থাকব, গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাব। তবু ভিক্ষা করব না।’ কথা শেষ করে চলে যাওয়ার সময় গুনগুন করে গাইতে থাকে ‘আমি এক অন্ধ, কপাল মন্দ’।
কটিয়াদী পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে থাকে বিকাশ। মূলত পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের লেখা এবং আবদুল আলীম, আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া গানই বেশি গেয়ে থাকে। তার সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে মানুষ জড়ো হয়। তারা খুশি হয়ে যে অর্থ দেয়, তাই দিয়েই চলে বিকাশ সূত্রধরের জীবন।
স্থানীয় সাইদুর রহমান বলেন, ‘ভিক্ষার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে গান গেয়ে মানুষকে খুশি করাই বিকাশের কাছে আনন্দের। দুঃখ ভুলে থাকবার একমাত্র অবলম্বন গান। তাই গানকেই জীবনধারণের উপায় করে নিয়েছে বিকাশ সূত্রধর।’
সাংস্কৃতিক সংগঠক ও কটিয়াদী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বদরুল আলম নাঈম বলেন, ‘বিকাশ জন্মান্ধ। তবে তার গলায় সৃষ্টিকর্তা যে সুর দিয়েছেন, মুগ্ধ হতে হয়। সময় ও সুযোগ পেলে তার জন্য কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে।’
কটিয়াদী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আবুল খায়ের বলেন, ‘বিকাশ সূত্রধর শারীরিক প্রতিবন্ধী এটা আমার জানা ছিল না। আমি নতুন এসেছি। তার একটি হুইলচেয়ার প্রয়োজন যেটা আপনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আমাদের অফিস প্রতিবন্ধীদের হুইলচেয়ার দিয়ে থাকে। আমাদের এখানে আবেদন করলে আমরা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করে দেব।’
এ বিষয়ে কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদুজ্জামান মোবাইলে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
উপজেলা অফিসে ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতির বিষয়ে সাধারণের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, অফিস থেকে কেউ বলেন, তারা বাইরে কাজে আছেন। আবার অনেকে বলেন, বিভিন্ন মিটিংয়ে আছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে বাড়ি চলে যান।
উপজেলা পরিষদে আসা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তদারকি না থাকায় বেশিরভাগ দপ্তরের অফিস সময় মেনে চলছেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের দেরিতে আসা এবং ছুটির আগেই চলে যেতে দেখা যায় দিনের পর দিন। এতে ব্যাহত হচ্ছে এসব দপ্তরের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড।