আফসানা সুমি
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪ ১৩:২৯ পিএম
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই হামলার শিকার হন গণমাধ্যমকর্মীরা। ছবি : সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় নিহত ও আহত হয়েছেন একাধিক গণমাধ্যমকর্মী। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তারা হামলার শিকার হয়েছেন। শুধু এবারই নয়, প্রায়ই সংঘাত-সংঘর্ষে সাংবাদিকরা হন সবারই আক্রোশের শিকার। এ বিষয়ে লিখেছেন আফসানা সুমি
কাজ করতে গিয়ে বারবারই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন। প্রথম দফায় বেঁচে গেলেও দ্বিতীয় দফায় গুলিবিদ্ধ ও আহত হন। তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথম দফায় আমি ও আমার ক্যামেরাম্যান রিশাদ কিছু অভিভাবক দাবি করা ব্যক্তির উস্কানিতে ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হই। তারা আমাদের লোহার গ্রিলের ভাঙা অংশ নিয়ে আঘাত করলেও বড় কোনো ইনজুরি হয়নি। পরে আন্দোলনকারীদের এক অংশের সহায়তায় বেরিয়ে যেতে সক্ষম হই। ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষ চলাকালে আন্দোলনকারীরা তেড়ে আসে। তখন পুলিশ এগিয়ে আসায় তারা দ্রুত পিছিয়ে যায়। আমরাও দ্রুত পেছাতে থাকি। সে সময় আমার গলার ডান দিকে এবাং বাঁ বাহু ও ডান পায়ের পাতায় শটগানের গুলি লাগে। ক্যামেরাম্যানের গায়েও গুলি লাগে। তবে সেটা গলা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার বলেছেন বিপন্মুক্ত। আমার হাত ও পায়ের গুলি বেরিয়ে গেছে। গলারটা আটকে আছে। ভাইটাল নার্ভ সেখানে থাকায় এখনই অপারেশন করলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। প্যারালাইসিস হওয়ার আশঙ্কাও আছে।’
এ অবস্থায়ই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও সব সময় সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে নিরাপত্তার সরঞ্জাম অফিস থেকে দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি কোনো কোনো অফিসে বৈষম্য হয়। আমি দীর্ঘদিন কাজ করি তাই অফিসের হয়তো আমার প্রতি বিশ্বাস আছে; সে জায়গা থেকে এ কাজে আমাকে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও দেওয়া হয়েছে। অনেক অফিসে নারী সাংবাদিকদের এ সে সুযোগটা নেই।’ পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ঢাকায় এত বাজে অবস্থা আগে কখনও দেখেননি বলে জানান তিনি।
একটি স্বনামধন্য পত্রিকায় কাজ করা এক নারী সাংবাদিক তার হেনস্থার কথা জানিয়ে বলেন, ‘মেয়েদের প্রতিষ্ঠান থেকেও সমস্যার মুখে পড়তে হয়, বাইরে থেকেও আঘাতটা আসে। আমাকে পুরোটা সময় কারফিউ কাভার করতে হয়েছে। আমার অফিসের ডিজিটাল বিভাগকে নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেওয়া হলেও প্রিন্ট বিভাগকে দেওয়া হয়নি। সংঘর্ষের সময় আমাদেরও তো নিউজটা করতে হয়। কারও না কারও তোপের মুখে পড়তে হয়। অনেকেই নারীদের আঘাত করাটাকে এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।’
শুধু নারী নয়, এ সময়ে আক্রান্ত হয়েছে পুরুষও। আবার নাদিয়া শারমিনের মতো অনেক সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আহত অবস্থায়ই। গুলিতে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। গুলি এখনও বের করেননি তিনি। বলেন, ‘হালকা ধরলে ব্যাথা লাগে তবে কাজের জন্য তো বেরুতে হয়। হাসপাতালে ভিড় কমলে অপারেশন করাব।’
সাম্প্রতিক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত চারজন সাংবাদিক মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। হাসান মেহেদী ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর সহিংসতার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক পরীক্ষানিরীক্ষার পর মৃত ঘোষণা করেন।
১৯ জুলাই দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে আন্দোলনের ছবি তোলার সময় ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক তৌহিদ জামান প্রিয় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
একই দিনে সিলেটে দায়িত্ব পালনের সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকার সাংবাদিক এ টি এম তুরাব গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ১৮ জুলাই দৈনিক ভোরের আওয়াজের গাজীপুর গাছা প্রতিনিধি শাকিল হোসেন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
তবে সাংবাদিক ঠিক কতজন আহত-নিহত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া যায় আহত হয়েছেন ২০০-এর বেশি সাংবাদিক। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় আছেন অনেকেই।
ঢাকা মেডিকেলে গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন বাংলাদেশ সমাচারের সংবাদকর্মী আমিনুল ইসলাম ঈমন। পাঁচ সন্তানের জনক আমিনুল পরিবারে একাই রোজগার করেন। তিনি আর কাজে ফিরতে পারবেন কি না সন্দেহ। তার হাতে বুলেটের দাগ। সে রাতে কী ঘটেছিল, সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শরীর ডাক্তাররা দেখে ভয় পাচ্ছেন। কোমরের নিচে গোপনাঙ্গের পাশ থেকে গুলি বেরিয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি। এভাবে মানুষ মারে তারা।’
সেদিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে অফিস শেষ করে ফেরার পথে চিন্তা করলাম, বাসা তো নদীর ওই পারে। মালিবাগ রেলগেটের মোড় থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার হয়ে কেরানীগঞ্জ চলে যাব। আমার পরনে প্রেসের পোশাকও ছিল। রেলগেটের মোড়ে আসতেই আমার গুলি লাগে। ওদিকে আরও রিকশাচালক ছিল, ওরাও পড়ে গেছে। আমিও নিচে পড়ে যাই। চোখ খুলতে না পারলেও শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি যখন যাই, মালিবাগের মোড়ে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। ডিবির সিভিল গাড়ি ছিল দাঁড়ানো। সে সময় সেখানে কেউ ছিল না, কিন্তু হঠাৎ গুলি এসে লাগে। এর মধ্যেই পুলিশ এসে বলাবলি করছে, উনি তো প্রেসের লোক। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পাঠাও। আমাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হলো। তারপর ওখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। এদিকে রক্ত ঝরার কারণে শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। আমি বন্ধ চোখে ওদের বললামÑ আমাকে বাঁচান, আমার ছোট ছেলেমেয়ে আছে।’
আমাদের সময়ের চিফ রিপোর্টার শাহজাহান আকন্দ শুভ বলেন, ‘আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করার সময় ১৯ জুলাই কাকরাইল ও আজিমপুর আমার ওপর হামলা করা হয়। আমি মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছিলাম। এ সময় আন্দোলনকারীরা আমাকে সময় টেলিভিশনের রিপোর্টার ভেবে হামলা করে। ফটোসাংবাদিক মনজুরুল বাবুর হাত ভেঙে গেছে, মাথায় একাধিক সেলাই লেগেছে।’
এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দওয়া, ক্যামেরা ভাঙা ও প্রেস কার্ড ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হেনস্থার স্বীকার হয়েছেন নারী সাংবাদিকরাও।
বাংলা ট্রিবিউনের একাধিক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। স্টাফ রিপোর্টার আরমান ভূঁইয়া বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করার সময় তেজগাঁওয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলা করেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক বলেন, ‘সবাই সাংবাদিকদের শত্রু ভাবে। আসলে সাংবাদিকরা তো কারও শত্রু না। সাংবাদিকরা কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। আমরা গণমানুষের কথা বলি।’
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একাধিক সাংবাদিক নানাভাবে হেনস্থা হয়েছেন। ফটোসাংবাদিক আলী হোসেন মিন্টু জানান, তার প্রেস কার্ড কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ায় মারধরের শিকার হন স্পোর্টস রিপোর্টার রুবেল রোহান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে মারতে আসে, পরে প্রেস কার্ড দেখে আরও মরধর শুরু করে।’
হামলায় আহত হয়েছেন নাগরিক টেলিভিশনের সিইও দীপ আজাদ। তিনি বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে দুর্বৃত্তদের হামলায় অনেকে আহত হয়েছে। আমাদের টেলিভিশনের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।’
বেশিরভাগ টেলিভিশনের গাড়ি, বুম ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া হয়নি কোনো সেফটির সরঞ্জাম।
এটিএন বাংলার তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করে পোড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া এশিয়া টেলিভিশন, এনটিভি, একুশে টিভি, ইনডিপেনডেন্ট টিভি, যমুনা টিভিসহ প্রায় সব কটি টিভির গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।