× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দ্বিচক্রযানে উড়িবার সাধ

রাফিক হারিরি

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৪:৩১ পিএম

আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৪:৩২ পিএম

সাইকেল এমনই এক বাহন যা স্বাধীনতা আর দূরদূরান্তে ভ্রমণের দারুণ সুযোগ এনে দেয়। ছবি : সুদীপ্ত দাশ

সাইকেল এমনই এক বাহন যা স্বাধীনতা আর দূরদূরান্তে ভ্রমণের দারুণ সুযোগ এনে দেয়। ছবি : সুদীপ্ত দাশ

ছেলেবেলায় বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলেসন্তান হওয়ার পরও শত আবদারে আমার বাবা আমাকে একটি দ্বিচক্রযান কিনে দিতে রাজি হননি। একটা কারণ অবশ্য ছিল তার আর্থিক অসমর্থতা আর দ্বিতীয়ত তিনি সাইকেল চালানো পছন্দ করতেন না। দ্বিচক্রযান বা দুই চাকার সাইকেলের প্রতি আমার তীব্র মোহমুগ্ধতা জীবনের শুরু থেকেই। 

বড় হয়েছি ঢাকার মগবাজার নয়াটোলায়। আচরণে ভীষণ রকম অন্তর্মুখী আর লাজুক। ফলে প্রায় সময়ই কাটত বন্ধুবান্ধবহীন একা। এমন একাকিত্বের শৈশবে ঠিক উল্টো চরিত্রের দুই দুষ্ট ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আজও বন্ধুত্ব রয়ে গেছে। প্রথমজন ছিল হারজিরজিরে শুকনো আর ফরসা; দ্বিতীয়জন ছিল ব্যায়ামবিদের মতো পেটানো স্বাস্থ্য আর কালো। হারজিরজিরে আমার বন্ধুটার নাক দিয়ে সব সময় সর্দি ঝরত। আর সে উড়ে বেড়াত ফড়িংয়ের মতো। একদিন সে আমাকে নয়াটোলা পাগলা মাজার পার হয়ে নয়াটোলা শিশু পার্ক নিয়ে গেল। তারপর বলল, ভাই দেখো আমি কীভাবে রকেটের মতো সাইকেল চালাই। কথা শেষ করেই সে দুই টাকা দিয়ে বিশ মিনিট সাইকেল ভাড়া করল। আর আমি চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখলাম সে নানা ঢঙে সাইকেল চালাচ্ছে। তখন ছয় টাকায় এক ঘণ্টা সাইকেল ভাড়া নেওয়া যেত। চোখের পলকেই বিশ মিনিট শেষ হয়ে গেলে আমি মন খারাপ করে একই সঙ্গে বিস্ময়ের ঘোরে বাসায় ফিরে এলাম। আমার সেই বন্ধুটার নাম সাইফুদ্দিন। আমার চোখে সাইফুদ্দিন তখন সুপার হিরো। পরদিন আবারও দুই টাকা নিয়ে সাইফুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেল ভাড়া নিলাম। সাইফুদ্দিন আমাকে সাইকেল চালানো শেখাল। সাইকেল চালানোটা আমার কাছে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মনে হলো। সাইফুদ্দিন আমার কাছ থেকে সাইকেল নিয়ে ধুমধাম সাইকেলে উঠে দুই হাত ছেড়ে চালানো শুরু করল। পুরুষের জেদে হয় বাদশাহ, আমি জেদ ধরে সাইফুদ্দিনের সঙ্গে পাল্লা করে ওই এক দিনেই সাইকেল চালানো শিখে ফেললাম।

সেই যে সাইকেলের প্রতি মুগ্ধতা শুরু হলো, হয়তো সাইকেল নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরতে পারলে সে মুগ্ধতা কিছুটা কমত। প্রতি শুক্রবার ভোরে আমি আর সাইফুদ্দিন ওর মামার একটি বিদেশি সাইকেল নিয়ে পেছনে আমি বসতাম সাইফুদ্দিন চালাতÑএভাবে সারা ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতাম। শুক্রবার সকালে ঢাকা শহর ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত আর ঘুমন্ত থাকত। আমি আর সাইফুদ্দিন সাইকেল নিয়ে রমনার পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে যেতাম, ভিসির বাংলোর সামনে বিশাল কড়ি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার ফুলার রোড দিয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে মতিঝিল ফকিরাপুল হয়ে কোথায় কোথায় চলে যেতাম সারা দিন। কী এক মুগ্ধতা আর ক্লান্তিহীন উদ্দীপনা নিয়ে আমরা দুই বন্ধু সারা দিন সাইকেলে ঘুরে বেড়াতাম। সাইকেল চালানো শিখেই আমি আব্বার কাছে বায়না ধরেছিলাম আমাকে যেন একটি সাইকেল কিনে দেওয়া হয়। শত আবদারেও আব্বা সেটা করতে পারেননি। ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর ভেবেছিলাম এবার হয়তো কিনে দেবেন। আমার ভাগ্যে সাইকেল এলো না। আমি তখন খুব স্বপ্ন দেখতাম সাইকেল নিয়ে আমার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে গিয়েছি। সেখানে মেঠো পথ ধরে আমার মামাকে নিয়ে বনজঙ্গল-ক্ষেতখামারের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার দুই পাশ থেকে বুনোফুলের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। কত অজানা জায়গায় চলে যাচ্ছি। কিন্তু সেই সাধ শুধু কল্পনায় থেকে গেল। আব্বা আমাকে সাইকেল কিনে দিলেন না। ধীরে ধীরে জীবনের নানা চাপ, ঘাতপ্রতিঘাত পড়াশোনায় সাইকেলের শৈশবের মুগ্ধতা বালির আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেল। পড়াশোনা শেষ করে পেশাগত জীবনে ঢুকলাম। চাইলেই সাইকেল কিনতে পারি। কিন্তু সে ইচ্ছাটুকু আর আসে না। চাকরি শেষ করে কাটাবন কনকর্ডে বন্ধুদের দোকানে আড্ডা দিতে যাই। তখন আমার এক সহপাঠী বন্ধু মুনতাসির মামুন নামে এক তরুণের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। 

আমার বন্ধু বলল, মুনতাসির সাইকেলে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কদিন পর সে আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণে সাইকেল চালাতে যাবে সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার কাজ করবে। টুকটাক লেখালেখির সুবাদে বাজারে আমার তখন ডজনখানেক বই ঘোরাফেরা করছিল। মুনতাসির সে বইগুলোর খবর জেনে বেশ মুগ্ধতা প্রকাশ করল। 

মুনতাসিরের দুনিয়াজুড়ে সাইকেল চালানোর গল্প শুনে শৈশবের বন্ধু সাইফুদ্দিনের মতো মুনতাসিরও আমার কাছে এক বিস্ময়কর হিরোতে পাল্টে গেল। আমাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মুনতাসির মামুন বিচিত্র ধরনের কাজকর্মে নিজেকে সব সময় ব্যস্ত রাখে। সে পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে, সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘদিন নিজের গাঁটের টাকা আর পরিশ্রম দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মুনতাসিরের উৎসাহে আমি হুট করে একদিন খুব ছোটখাটো একটি ফোল্ডিং বাইসাইকেল কিনে ফেললাম। অদ্ভুতদর্শনের সেই সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরোলে লোকজন হাাসাহাসি করে। সে সাইকেল বিক্রি করে দিলাম। এর মধ্যে মুনতাসির মামুন আমাকে একদিন বলল, ভাই আমাদের সঙ্গে হিলারি রাইডে চলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী আসলে। মুনতাসির বলল, ২০০৮ থেকে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রথম এভারেস্ট আরোহী এডমন্ড হিলারির সম্মানে ঢাকার বাইরে ৮৮+ কিলোমিটার সাইকেল চালাই এক দিনে। এডমন্ড হিলারি ২০০৮-এ মারা যান। তখন তার বয়স ৮৮ বছর। তাই এ রাইডে আমরা ৮৮+ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মহান এ অভিযাত্রীকে স্মরণ করি। আমার কাছে বিষয়টা দারুণ চিত্তাকর্ষক মনে হলো। আমি তখন আরেকটি ভালো দেখে সাইকেল কিনে ফেললাম। ২০১৬ সালে মুনতাসির মামুনদের সঙ্গে আমি জামালপুর-শেরপুর হয়ে সাইকেলে রৌমারি গেলাম। সারা দিনে প্রায় ৯০ কিলোমিটার সাইকেল চালালাম। ভোরে সাইকেল চালানো শুরু হয়েছিল, শেষ হলো সন্ধ্যায়। ভারত সীমান্তের পাশ কেটে গ্রামের সরু পিচঢালা রাস্তা আর দুই পাশে আম-জাম গাছসহ নানা ধরনের বিচিত্র দেশি গাছের ছায়ার ভেতর দিয়ে আমরা সাইকেল চালালাম। ক্লান্ত আর পিপাসিত হয়ে কারও বাড়িতে গেলে তারা সাদরে চেয়ার এনে আমাদের বসতে দিয়ে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করল। মন পাগল করা সবুজ সুন্দর রাস্তা দিয়ে দুই চোখ জুড়িয়ে সাইকেল চালালাম। রাস্তাজুড়ে ভাঁটফুলের তীব্র মোহময় সুবাস। চারপাশে সবুজ ধান ক্ষেত আর মাইলের পর মাইল ভুট্টা ক্ষেতের ছড়াছড়ি। এত অদ্ভুত লাগছিল। সরু রাস্তার ভেতর দিয়ে পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আর বুক ভরে ভাঁটফুলের সুবাস, রাস্তার দুই পাশের সবুজ জঙলার ঘ্রাণ নিতে নিতে মনে হচ্ছিল এ পথ যেন শেষ না হয়। মনের সতেজতা যেমন শরীর চাঙা রাখে তেমন শরীরের ক্লান্তিও মন দুর্বল করে দেয়। ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় আমরা দলবেঁধে যাত্রা শেষ করি।

২০১৬ সালে আমার বাবা মারা যান। তার মাসখানেক পর হয়তো হিলারি রাইডে গিয়েছিলাম। আব্বা মারা যাওয়ার বেশ কিছু দিন পর তিনি যে ফার্মে কাজ করতেন সেখান থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে তার পাওনা বেশ কিছু টাকা পেলাম। সে টাকার কিছু অংশ দিয়ে আমি দামি একটি সাইকেল কিনলাম। মুনতাসির মামুনরা সাইকেলে চড়ে এখনও দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশকে বুকে নিয়ে পৃথিবীর পথে বাইসাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। তারা আমাকে প্রায়ই বলে, ভাই আমাদের সঙ্গে চলেন, প্লেন ভাড়া আমরা দেব, বাকিটা আপনার তবু চলেন। আমি যেতে পারি না। খুব ইচ্ছা করে ওদের মতো স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে। গৃহীমানুষের নানা রকম সমস্যা নিয়ে আমি ঘরের জানালার পাশে বসে থাকি।

আব্বার মৃত্যুর পর তার টাকায় কেনা বাইসাইকেল দিয়ে আমি অন্তমুখী মানুষ এখনও বহির্বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা