নারী ও শিশু নির্যাতন
তানিয়া সুলতানা
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৪ ১৩:১৭ পিএম
প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা। এমন খবরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যেন আমরা সবাই। কঠোর আইন আছে, আছে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও। তবু কমছে না এসব ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের তুলনামূলক পর্যালোচনা নিয়ে আজকের লেখা।
পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভির পর্দায় সংবাদের শিরোনামে প্রতিদিনই নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। এসব ঘটনা অনেকটা যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে সবার। নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতন হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, হত্যার শিকারও হচ্ছে অনেকে। এসব ঘটনায় মামলা হয়, গ্রেপ্তারও অনেকেই হয়। মামলার হাজিরা দিতে আদালতপাড়ায় দিন কাটে ভুক্তভোগী ও তার স্বজনদের। এ সময়গুলোয় ভুক্তভোগীর মানসিক অবস্থার খবর রাখে কজন।
ইতোমধ্যে চলতি বছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে দেশজুড়ে নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা সংখ্যায় উল্লেখ করলে চমকে উঠতে হয়। লেখার শুরুতে শুধু ধর্ষণের সংখ্যাই উল্লেখ করি। বাকি তথ্য, বিস্তারিত বলছি একটু পরে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ছয় মাসে ২৫০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। হাস্যকর শোনালেও আশার কথা হলো, গত বছর এ সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ২৯৪ জন। দুই বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনামূলক চিত্রে বলা যায়, চলতি বছর ধর্ষণ কিছুটা হলেও কমেছে।
মূল লেখায় প্রবেশের আগে দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। ৩০ জুন রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক নারী। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, তার নয় মাস বয়সি ঘুমন্ত শিশু সন্তানের গলায় ছুরি ধরে তাকে ধর্ষণ করেছে আনু মিয়া নামে এক যুবক। পুলিশ জানায়, ভুক্তভোগীর স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করেন। তিনি নয় মাস বয়সি সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ৩টার দিকে অভিযুক্ত ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত শিশুটির গলায় ছুরি ধরে ভুক্তভোগীকে হত্যার ভয় দেখান। পরে তাকে একটি পুকুরের পাশে নিয়ে ধর্ষণ করে অভিযুক্ত পালিয়ে যান। এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবককে উপজেলার দশদ্রুন গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আরেকটি ঘটে ২৩ জুন রবিবার রাতে। নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলায় ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এক স্কুলছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করা হয়। দুই দিন পর মঙ্গলবার রাতে ভুক্তভোগী ওই স্কুলছাত্রীর মা বাদী হয়ে মোহনগঞ্জ থানায় মামলা করেন। পুলিশ ও মামলার বিবরণ সূত্রে জানা যায়, ভাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা উত্তম বিশ্বাস কিছুদিন ধরে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত। উত্তমের কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে রবিবার ভোরে তার বাড়িতে গোপনে অবস্থান নেয় উত্তম। ভোররাতে স্কুলছাত্রীর বাবা-মা দুজনে বাড়ির পাশের হাওরে মাছ ধরতে যান। এ সুযোগে উত্তম ঘরে প্রবেশ করে স্কুলছাত্রীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। ছাত্রীটির প্রতিরোধের মুখে তার গলা ও ঠোঁটে আঘাত করে যুবক। মেয়েটির চিৎকারে পরিবারের লোকজন এগিয়ে এলে উত্তম পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় ওই ছাত্রীকে মোহনগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ভুক্তভোগী ওই কিশোরী স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সহিংসতার অভাব নেই। গত ছয় মাসে যৌন-হয়রানি-কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছে ১৪৬ জন নারী-পুরুষ, যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছে ১১৩ নারী ও ৩৩ পুরুষ। এর মধ্যে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত ১০১ জন নারী, বখাটেদের উৎপাত কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছে ৩৬ জন। যৌন হয়রানির কারণে একজন নারী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটে কর্তৃক চার পুরুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এ সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ২৫০ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে তিনজন। পাশাপাশি ৫৮ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৬৯ নারী। এর মধ্যে ৮৪ জন স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা হয়েছে ৯৪ নারী।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুনে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল মোট ২৯৪ নারী। গত ছয় মাসে যৌতুক কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ৩৩ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে চার নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৬ জন। এ সময়ে মোট ১০ গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে পাঁচজনের রহস্যমৃত্যু হয়েছে।
শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় আসা যাক এবার। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে মোট ৬৩১ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ২৩৯ এবং তিন ছেলেশিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৫০ শিশু, বিভিন্ন সময়ে মোট ৭৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, এ ছাড়া বলাৎকারের শিকার হয়েছে ২৩ ছেলেশিশু।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মাসিক ধর্ষণচিত্র তুলে ধরা যাক এবার। জানুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৯ নারী। ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ৩৪। এ ছাড়া মার্চে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫১, এপ্রিলে ৩৮, মেতে ৪৯ এবং সর্বশেষ জুনে ৪৯টি। সর্বমোট ২৫০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় দেখা যায় এ বছর ধর্ষণের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৩৫, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪, মার্চে ৪৫, এপ্রিলে ৫৩, মেতে ৬৬ এবং জুনে ৫১টি।
মোট ২৯৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত। বছরের এসব ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১৭টি। আর মামলা হয়নি বাকি ২৩টি ঘটনায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৬৯ নারী। যার মধ্যে স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ৮৪ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ৯৪ জন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০২টি। বাকি ১৬৭ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। মাসের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারিতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে ৪১ নারী। যার মধ্যে স্বামীর হাতে নিহত হয়েছে ১৫ জন, স্বামীর পরিবার দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছে তিনজন এবং আত্মহত্যা করে ১১ জন।
ফেব্রুয়ারিতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় ৫১ নারী। যার মধ্যে স্বামীর হাতে নিহত হয়েছে ১৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ২৪ জন। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৪৫। যাদের ১২ জনকে হত্যা করে স্বামী এবং আত্মহত্যা করে ১৪ জন। এপ্রিলে এমন ঘটনা ঘটে ৪১টি। যার মধ্যে আটজন স্বামীর হাতে নিহত হয় এবং যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ১৭ জন। মেতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় ৪৮ নারী। যাদের ১৯ জনকে হত্যা করে স্বামী, ১৫ জন করে আত্মহত্যা। সর্বশেষ জুনে এমন ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। যাদের ১৭ জন নিহত হয় স্বামীর হাতে, আত্মহত্যা করে ১৩ জন।
শিশুর প্রতি সহিংসতা ও হত্যা
আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে ৬৩১ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৩৯টি। যাদের মধ্যে শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৪৯ এবং ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সির সংখ্যা ১২১।
মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে হত্যার শিকার ৪৪ শিশু। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৬০, মার্চে ৩৫, এপ্রিলে ৩৭, মেতে ২৯ এবং সর্বশেষ জুনে ৩৪ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এসবে মামলা হয়েছে মাত্র ১৮০টি ঘটনায়। ২০২৩ সালের চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথম ছয় মাসে শিশুহত্যা ঘটেছিল ২৪৬টি। যার মধ্যে জানুয়ারিতে ৪২, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪, মার্চে ৪২, এপ্রিলে ৩০, মেতে ৪৫ এবং জুনে ৪৩টি ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩৯২টি। যার মধ্যে জানুয়ারিতে ঘটে ৪৪টি ঘটনা। পাশাপাশি ফেব্রুয়ারিতে ৬৪, মার্চে ৭৮, এপ্রিলে ৪০, মেতে ৮৬ ও জুনে ঘটে ৮০টি সহিংসতার ঘটনা। চারশর মতো ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে মাত্র ২১৭টি।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আছে কঠোর আইন। তবু কমছে না এসবের কিছুই। কেন কমছে নাÑপ্রশ্ন আছে উত্তর নেই কারও কাছেই। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস কেটে গেছে। চলে যাবে বাকি ছয় মাসও। আগামী বছরও হয়তো এমন দুঃখজনক পরিসংখ্যান নিয়ে আরেকটি লেখা লিখতে হবে। তবু স্বপ্ন দেখি, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতাহীন একটি বছর না হলেও অন্তত একটি মাস কাটবে। যে মাসের পরিসংখ্যানে থাকবে সবই শূন্য।