নাকিব নিজাম
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ১১:২৩ এএম
দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। ছবি : জলছবি
প্রকৃতির অকৃত্রিম, অফুরন্ত সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। আর বাংলার এই অবিচ্ছেদ্য সৌন্দর্যের অংশ সুনামগঞ্জ জেলার হাওর। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। লিখেছেন নাকিব নিজাম
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’ কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে মিলে বলতে হয়, প্রকৃতির অকৃত্রিম, অনাবিল ও অফুরন্ত সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। আর বাংলার এই অবিচ্ছেদ্য সৌন্দর্যের অংশ সুনামগঞ্জ জেলার হাওর। স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটম্বুর সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁওড়। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত সুনামগঞ্জ জেলার ৫১টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত।
যান্ত্রিক জীবনের ধকল কাটাতে অন্যদের মতো অনেকটা হুট করেই প্ল্যান করি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসার। ঠিক হলো, আমাদের গন্তব্য হবে টাঙ্গুয়ার হাওর। পাশাপাশি দেখব ছবির মতো সুন্দর নীলাদ্রি লেক, সীমান্তঘেঁষা লাকমাছড়া ঝরনা, শিমুল বাগান, বারিক্কা টিলা ও জাদুকাটা নদী। সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলবে দূরের মেঘালয়ের পাহাড়ের। ১২ বন্ধু মিলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছুটলাম ‘হাওরকন্যা’ হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জে। ঢাকার মহাখালী, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, এনা, হানিফসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছাড়ে সুনামগঞ্জ রুটে। তাহিরপুর নৌঘাটে পৌঁছানোর পথটা বেশ ছিমছাম। দুই ধারে মাইলের পর মাইলজুড়ে শুধু জলরাশি, মাঝখানে আঁকাবাঁকা পিচঢালা সরুপথ। তাহিরপুর ঘাটে পৌঁছে হাউসবোটের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সকালের উদরপূর্তি সেরেই হাউসবোটে উঠে পড়লাম হাওরের সৌন্দর্য দেখতে। হাউসবোট যতই হাওরের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি ধরা দিচ্ছে। থেকে থেকে চোখে পড়ছে চরে বেশ কিছু জনবসতি। মূলত এই এলাকার মানুষ বর্ষা মৌসুমে হাওরের মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। পানি কমে গেলে জেগে ওঠা জমিতে রবিশস্য ও বোরো ধান, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার করে।
সাদা বকের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে পৌঁছি দুপুর ১টার দিকে। অন্যান্য অংশের তুলনায় পানি স্বচ্ছ বিধায় এখানে সব হাউসবোটই একটা বিরতি দেয় গোসল ও খাবারের জন্য। সামান্য উপার্জনের তাগিদে শিশুরা ডিঙি নৌকা নিয়ে ভিড় জমায় ট্রলারগুলোর কাছে। ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিয়ে হিজল বাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। বেড়ানোর সময় জায়গাটার সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায় রাতারগুলের। তবে শুকনো মৌসুমে হাওরে জল কম থাকলে হেঁটেই পার হওয়া যায়। হাউসবোট যতই এগিয়ে যাচ্ছে, হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড়ের রূপ ততই উঁকি দিচ্ছে। তবে বৃষ্টি থাকায় দূরের পাহাড়গুলো অনেকটাই ঝাপসা লাগল এদিন। বেলা ৩টা ছুঁইছুঁই। প্রচণ্ড ক্ষুধায় দিশাহারা সবাই। খাবার নিয়ে হাউসবোটের ছাদে বসে খেলাম তৃপ্তি নিয়ে। খানিক বিশ্রাম শেষে দল বেঁধে বের হলাম নীলাদ্রি লেকের সৌন্দর্য দেখতে। লেকটি আসলে চুনাপাথরের খনি ছিল একসময়। শহীদ সিরাজ লেক হিসেবে কাগজে-কলমে নাম থাকলেও পর্যটকদের কাছে এটি নীলাদ্রি লেক হিসেবেই সমাদৃত। ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট গভীর স্বচ্ছ পানির আধার এটি। ১৫০ টাকা ভাড়ায় খেয়া নৌকায় সীমান্তঘেঁষা মেঘালয়ের পাহাড় আর লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম বিকালজুড়ে। লেকের ধারে পরিত্যক্ত ক্রেন আর ভাঙা রেলকোচ আজও খনির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
রাতে বর্ডারের উঁচু পাহাড়ে সোডিয়ামের হলদে আলো এলাকাজুড়ে এক মায়াময় দৃশ্যের জন্ম দেয়। টেকেরঘাটের দোকানপাট রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খোলা। ভ্রমণপ্রেমীদের মোবাইল ফোনের চার্জ দেওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি চার্জে ১০ টাকা নেন দোকানিরা। তবে বসে থেকে পুরো চার্জ করিয়ে নেওয়াই ভালো। খাবার শেষে ভরা পূর্ণিমায় হাওরের বুকে হাউসবোট নোঙর করে গল্প-আড্ডা দিয়েই রাতটা পার করি আমরা।
হাওরে হাউসবোট
টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হলো নৌকায় থাকার দিনগুলো। এই অভিজ্ঞতাটিই টাঙ্গুয়ার হাওরের ট্যুরকে আলাদা করে অন্য সব ট্যুর থেকে। বৃষ্টির সময়ে নৌকায় বসে চায়ের চুমুকে দূর মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর দৃশ্য যেন জাগিয়ে তুলে যে কারও ভেতরের কবিকে। একসময় মনে করা হতো এই হাওরে হয়তো শুধু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওর ঘুরে আসা সম্ভব। এমনই একটি হাউসবোট হলো ‘জলছবি’। এ হাউসবোটে যা যা সুবিধা পাবেন তা হলোÑ ছয়টি কেবিন অ্যাটাচ ওয়াশরুম (হাই কমোড), একটি ডিলাক্স কেবিন, রুফটপ ডাইনিং। এ ছাড়াও সার্বক্ষণিক চা/কফি, দিন-রাতে নির্দিষ্ট সময়ে জেনারেটর সার্ভিস, লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া ও অভিজ্ঞ বাবুর্চির মাধ্যমে হাওরের বড়-ছোট মাছ, হাঁসের মাংসসহ বাহারি স্বাদের লোকাল খাবার। বুকিং করতে কিংবা যেকোনো তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুনÑ মোবাইল ফোন-০১৭১৩৩৮৮৪৯২।
এ ছাড়াও নিতে পারেন জলতরঙ্গ-Joltarongo প্যাকেজ। প্যাকেজে থাকবে হাওরের সম্পূর্ণ খাবার ও জলতরঙ্গ বোটে দুই দিন এক রাত থাকা। এ ছাড়া নীলাদ্রি লেক, শিমুল বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, টেকেরঘাট, জাদুকাটা নদী, টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ তো থাকছেই। যোগাযোগ-০১৮২৫৬৯৭১১৭।
ট্যুর প্যাকেজ নিয়ে টাঙ্গুয়ায় ঘুরে আসতে পারেন টিজিবির সিন্দাবাদ তরী হাউসবোট নিয়ে। বোটে রয়েছে ৮টি কাপল কেবিন/রুম, যার ৬টি-ই অ্যাটাচ বাথসহ। বিস্তারিত জানতে ০১৮৭৭৭২২৮৫৪।
ঝুম বর্ষার শীতল ফোঁটা, হাওরের বুকে জেগে থাকা জলাবন, জাদুকাটার মুগ্ধ করা স্বচ্ছ পানি আর বারিক্কাটিলা থেকে মেঘ জমে থাকা ভিউ সবকিছুই যেন এক পরিপূর্ণতা এনে দেয় হাওরাঞ্চলকে। তা দেখতেই স্বল্প বাজেটে ভ্রমণ করতে পারেন সাম্পান (Shampan- A Premium Houseboat)-এ। বিস্তারিত জানতে : ০১৮৮৬৩৯১০৫১।
হাওরে সাধারণত যে হাউস বোটগুলো আছে, সেগুলোর স্বত্বাধিকারী পুরুষ। প্রচলিত এধারা ভেঙেছে Behula- The Houseboat। এই হাউসবোটের স্বত্বাধিকারী ও পরিচালনাকারী সবাই নারী। আলাদা করে তাই তাদের সাধুবাদ দিতেই হয়। এই বোটে মোট ৮টি কেবিন রয়েছে। আছে সিঙ্গেল ও কাপল প্যাকেজ। জনপ্রতি খরচ পড়বে ৪৫০০ থেকে ৬৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাচ্ছেন সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি। যোগাযোগ : ০১৮৮৬৭৬৫৬৪৩
কীভাবে যাবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার জন্য প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি সুনামগঞ্জে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট হয়ে সেখান থেকেও সহজেই সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর যেতে হবে লেগুনা কিংবা অটোরিকশায়। এ ছাড়া এ পথে মোটরবাইকেও যাত্রী পরিবহন করা হয়। তাহেরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন রকম নৌকা ভাড়ায় পাওয়া যায়। এ নৌকাগুলো সাধারণত টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল প্রবেশমুখ গোলাবাড়িতে নোঙর করে। হাওরের ভেতরের পাখির অভয়ারণ্যে কোনো ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর অনুমতি নেই। তাই সেখান থেকে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোট নৌকা ভাড়া করতে হবে।