জাপানের রূপকথা
মৃত্যুঞ্জয় রায়
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১১:১৯ এএম
আপডেট : ২০ জুন ২০২৪ ১১:২৩ এএম
এ সুন্দর ছবিটি এঁকেছে অর্নিলা ভৌমিক। সে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী
এক দেশে ছিল এক গরিব কাঠুরে। সে রোজ বন থেকে বাঁশ কেটে বাজারে বিক্রি করত। এক সন্ধ্যায় বাঁশ কেটে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ একটি বাঁশঝাড়ে তার চোখ গেল। তাকিয়ে দেখে একটি বাঁশের কঞ্চিগুলোর আড়াল থেকে নীলাভ কোমল আলো বেরোচ্ছে। আলোয় অন্ধকার বাঁশঝাড়ের সে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। কাছে এগিয়ে দেখে, একটি ছোট্ট মেয়ে বাঁশের কঞ্চির ওপরে বসে আছে। মেয়েটি এতই ছোট যে, লম্বায় মাত্র কয়েক ইঞ্চি। কিন্তু মেয়েটি দেখতে একেবারে পরীর মতোই। কাঠুরে ভাবল, মেয়েটি হয়তো তাকে দেখে ভয় পাবে, কিন্তু আসলে সে তা পেল না। আবার ভাবল, মেয়েটি হয়তো সত্যি একটি পরীর মেয়ে, ধরতে গেলেই ফুড়ুত করে উড়ে যাবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ছোট্ট মেয়েটিকে সে আলতো করে হাতের তালুতে তুলে নিল।
মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে কাঠুরে বাড়ি ফিরল। ফিরে সে তার বউকে সব ঘটনা খুলে বলল, কীভাবে তাকে পেয়েছে তা-ও বলল। সব শুনে বউ বলল, ‘ভালোই হয়েছে। আমাদের তো কোনো ছেলেপুলে নেই, মেয়েটিকে আমরা আমাদের মেয়ের মতোই রাখব।’ বউয়ের কথায় কাঠুরেও সায় দিল। দুজনই মেয়েটিকে নিয়ে আনন্দিত। মেয়েকে রোজ আদর করে, খাওয়ায়, গোসল করায়। ওরা খেয়াল করল, মেয়েটি যেখানেই থাকে, একটা কোমল আলো ওকে অনুসরণ করে। দেখতে দেখতে মেয়েটি বড় হয়ে উঠল। তরুণী হলো। সে দেখতে এতই সুন্দরী যে, তার দিকে তাকালে চোখের পলক পড়ে না। সে আবার অনেক দয়ালু। মা-বাবার মতোই কাঠুরে আর কাঠুরেবউকে ভালোবাসে, তাদের সেবা করে।
সে দেখতে এতই রূপসী হলো যে, সাত দেশের রাজকন্যারাও তার রূপের সঙ্গে পেরে উঠল না। এজন্য সবাই তার নাম দিল ‘বাঁশবনের রাজকন্যা’। দেখতে দেখতে তার রূপের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দেশবিদেশ থেকে লোকজন একনজর তাকে দেখতে কাঠুরের বাড়িতে ভিড় করতে লাগল। বাড়ির বাইরে দিনের পর দিন মানুষ বসে থাকে, কখন মেয়েটি ঘর থেকে বেরোয়। এক পলক দেখেই খুশি হয়ে তারা ফিরে যায়। কেউ কেউ আবার ফিরে আসে আরও একবার দেখার জন্য।
একদিন পাঁচ দেশের পাঁচ রাজপুত্র এলো তাকে দেখার জন্য। তারা বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন সে ঘরের বাইরে আসে। তাদের প্রত্যেকেই মনে করল, বাঁশবনের রাজকন্যা হলো তেমনই রূপসী, যার মতো রূপসী এর আগে তারা কখনও দেখেনি। প্রত্যেকেই মনে মনে আশা করল সে-ই হবে তার স্বামী। তাই তারা প্রত্যেকে কাঠুরের কাছে বাঁশবনের রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পত্র দিল। অবাক ব্যাপার হলো, সব পত্রই কাঠুরের কাছে এলো একসঙ্গে। কাঠুরে পড়ল মহাচিন্তায়। কী করা যায়? কার সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায়? পাঁচ রাজপুত্রের মধ্যে যেকোনো একজনের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিলে অন্য চার রাজপুত্র ভীষণ রেগে যেতে পারে। তাতে ক্ষতি হতে পারে। কাঠুরেকে চিন্তিত দেখে বাঁশবনের রাজকন্যা প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে বাবা? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’
‘বড়ই ভাবনায় পড়েছি রে মা। পাঁচজন রাজপুত্র প্রস্তাব পাঠিয়েছে তোকে বিয়ে করার জন্য। কাকে পছন্দ করা উচিত হবে, ঠিক বুঝতে পারছি না। সবার সঙ্গে তো আর তোর বিয়ে দেওয়া যাবে না।’
‘ও এই কথা? তুমি ওদের পাঁচজনকে একই দিনে একই সময়ে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। তারপর যা করার আমি করব।’
‘দেখিস, আবার নিজের কোনো বিপদ যেন ডেকে আনিস না।’ এই বলে কাঠুরে চলে গেল রাজপুত্রদের নিমন্ত্রণ করতে।
যথারীতি পাঁচ রাজপুত্র এলো কাঠুরের বাড়িতে। তারা সবাই বাঁশবনের রাজকন্যাকে আর একবার দেখতে পাওয়ার জন্য ভীষণ খুশি হলো। প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবতে লাগল, রাজকন্যা বুঝি তার গলাতেই মালা দেবে। কিন্তু রাজকন্যা ওদের কাউকেই বিয়ে করতে রাজি হলো না। সে তার পিতা-মাতার কাছেই সারা জীবন থাকতে চাইল। ওদের সেবাযত্ন করেই যেন সে বেশি আনন্দ পায়। তাই বুদ্ধি করে সে প্রত্যেক রাজপুত্রকে বলল, ‘হ্যাঁ আমি আপনাদের মধ্যে একজনকে বিয়ে করতে পারি যে আমার জন্য একটি কাজ করতে পারবেন।’
রাজপুত্ররা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘কাজটা কী?’
বাঁশবনের রাজকুমারী আসলে তাদের প্রত্যেককে এমন একটি কাজের কথা বলল যা করা অসম্ভব। প্রথম রাজপুত্রকে বলল, ‘নেপালে যান। সেখানে এক পাহাড়চূড়ায় বিশাল একটি পাথরের বুদ্ধমূর্তি আছে। সেটি সেখান থেকে এখানে এনে দিতে হবে। কোনো গাড়ি বা জাহাজে করে আনা যাবে না।’ দ্বিতীয় রাজপুত্রকে বলল, ‘হাওয়াই দ্বীপে একটি ভাসমান পাহাড় আছে। সে পাহাড়ে আছে একটি রত্নগাছ। সে গাছের একটি ডাল আমাকে এনে দিতে হবে।’ তৃতীয় রাজপুত্রকে বলল, ‘আমার জন্য একটি বিশেষ পোশাক তৈরি করে দিতে হবে যা হবে ইঁদুরের চামড়ায় বানানো। আর সেই ইঁদুরের চামড়া নিতে হবে ইঁদুরকে পুড়িয়ে।’ এবার চতুর্থ রাজপুত্রের পালা। সে ভাবল, নিশ্চয়ই বাঁশবনের রাজকন্যা তাকে পছন্দ করেছে। তাই তাকে ওদের মতো কঠিন কোনো কাজ দেবে না। সে রকমই আশা করে সে বাঁশবনের রাজকন্যার দিকে তাকাল। বাঁশবনের রাজকন্যা এবার চতুর্থ রাজপুত্রকে বলল, ‘আপনি কি আমাকে সাগর ড্রাগনের গলার মালা থেকে হীরের খণ্ডটা এনে দিতে পারেন? ওই ড্রাগন থাকে প্রশান্ত মহাসাগরে ১০ কিলোমিটার পানির নিচে।’
পঞ্চম রাজপুত্রকে বলল, ‘ভারতের দক্ষিণে তিন সাগরের মোহনায় একটা গাছের কোটরে কিছু শস্যদানা আছে। সেসব বীজ পাহারা দিচ্ছে দুটি বড় কেউটে সাপ। সাপ দুটি ওই কোটেরেই থাকে। কোটরের অনেক গভীরে সেসব বীজ আছে। বীজগুলো সেখান থেকে বের করে বরফের মধ্যে এক সপ্তাহের মধ্যেই তার গাছ বানাতে হবে। তারপর সে গাছ নিয়ে আসতে হবে আমার কাছে।’
রাজপুত্ররা সবাই ভাবল, যে তার কাজটা আগে সম্পন্ন করে বাঁশবনের রাজকন্যার কাছে ফিরে আসতে পারবে, সে বোধহয় তাকেই বিয়ে করবে। এই ভেবে সবাই দ্রুত ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়ল যে-যার কাজটা করতে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। পাঁচ রাজপুত্রের কেউ আর কাজ শেষ করে বাঁশবনের রাজকন্যার কাছে ফিরে এলো না। তাই তারও আর ওদের কাউকে বিয়ে করতে হলো না। বাঁশবনের রাজকন্যা মহা আনন্দে কাঠুরে আর তার বউয়ের সঙ্গে রয়ে গেল। কত বছর সে ওদের সঙ্গে ছিল, তা আর আমার জানা নেই।