বিশ্ব বাবা দিবস
সামিহা তাসনিম ইরা
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৪ ১৫:২২ পিএম
বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সন্তানের এগিয়ে চলায় যার থাকে নীরব ভূমিকা তিনি বাবা। আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রিয় বাবার প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করে খোলা চিঠি লিখেছেন পাবনা থেকে শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সামিহা তাসনিম ইরা
প্রিয় বাবা,
ঠিক দুই বছর আগের এই সময়টার কথা তোমার মনে আছে? জুনের মাঝামাঝি। ঠিক দুই বছর আগের এ তারিখেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। ওই দিনটার কথা মনে পড়ে তোমার? যেদিন বিকালে কলেজ থেকে ফিরে দেখলাম তুমি শুয়ে আছো। আমি কলেজ ড্রেস পরেই আমার ফাইল ভরা সার্টিফিকেট আর কবিতার খাতা তোমার সামনে রেখে রাগে কাঁদতে কাঁদতে বললাম ‘বাবা আমি আর কোনো দিন এই কলেজে যাব না’। সেদিন কি সাহস ছিল আমার চোখে মুখে! কি ভীষণ রাগ! এখন এই যে লিখছি আর মনে করছি, এতেই আমার গা কাঁটা দিচ্ছে। তুমি সেদিন আমায় কিছু বলোনি।
বলেছিলে শান্ত হতে, বসে কী হয়েছে বলতে। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সব বলেছিলাম তোমাকে। তুমি চুপ করে শুনেছিলে। আমি অনেক চিল্লাচিল্লিও করেছিলাম। কিন্তু তুমি কিছুই বলোনি আমায়। আচ্ছা তুমি কি জানতে অতিরিক্ত রাগ হলে আমার কথা বলতে অসুবিধা হয়, আমি কেঁদে ফেলি? তুমিতো এত শান্ত মানুষ নও!
সেদিন আমার এক কথায় তুমি তিন দিনের মধ্যে আমার কলেজ পরিবর্তন করে দিলে। আমি খুব করে বুঝেছি কত লোক কত কাহিনী বানিয়েছে এটা নিয়ে; কিন্তু কখনও তোমার মধ্যে এটা নিয়ে খারাপ লাগা দেখিনি। তুমি বললে, ভালো করে পড়ে সবাইকে দেখিয়ে দাও। ডাক্তার হবে তুমি। আমি জানি তুমি পারবে। আমার সে বিশ্বাস আছে।
আমি ঠিক করে রান্না করতাম না। হলে ভালো খাবার দিত না। কেনা খাবার পছন্দ ছিল না। তাই বলে বাড়ি থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বের ওই কলেজে তুমি শুধু ফল কিনে দিতে। যাওয়ার ইচ্ছা কই থেকে পেতে? জানো, বড় আপুরা আমায় ভাগ্যবতী বলত।
আচ্ছা বাবা, যেদিন আমি তোমায় ফোন করে বললাম আমি মেডিকেলে পড়তে চাই না, সেদিন তোমার কেমন লেগেছিল? সেদিনও কেন তুমি আমায় কিছু বলোনি, বকোনি?
উল্টো তুমি আম্মুকে বললে, মেডিকেলে পড়া খুব কষ্টের, এত কষ্ট করবার দরকার নেই আমার। তুমি কি সেদিন আমায় বাঁচিয়ে দিলে? তুমি কি সেদিন একবারও তোমার স্বপ্ন, তোমার ইচ্ছার কথা ভাবোনি?
এর পরপরই তো রেজাল্ট বের হলো আমার। এ প্লাস মিস করলাম। আমি অনেক অনেক পড়েছিলাম তবু কেন করলাম জানি না। তুমি বললে মন খারাপ না করতে। আল্লাহ নিশ্চয়ই এর চেয়ে ভালো কিছু রেখেছেন। আমি বাড়ি চলে এলাম। কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিলাম না। ইচ্ছে করল না। তুমিও জোর করলে না। সাত মাস ঘরে বসে থাকলাম। তুমি তবু কিছু বললে না।
শুধু একদিন কথায় কথায় বললে, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় বোঝা সন্তানের লাশ, আর কারওর না।’ আচ্ছা সেদিন কেন এটা বললে? তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে যে আমি ওমন কিছুই ভাবছি? আসলেই কি আমি চলে গেলে তুমি খুব কষ্ট পেতে?
দেখো, আমার সব বন্ধু আমায় ফেলে চলে গেছে। আমার আর একটাও বন্ধু নেই। পোষা বিড়ালটাও থাকল না। যে মানুষ, সম্পর্ক নিয়ে আমার এত গর্ব ছিল, শুধু একটা রেজাল্টে তারা আমার সঙ্গে সব হিসাবনিকাশ শেষ করছে। তারা ভুলে গেছে আমার অতীত জীবনের সব অর্জন। আমায় খুব করে বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে হেরে যাওয়া মানুষের কোনো জায়গা নেই। দৌড়ে পিছিয়ে থাকা মানুষকে কেউ দেখতে চায় না। কেউ তোমার মতো বলল না তুমি এগিয়ে যাও, আমি আছি। তুমি কেন এমন বাবা? এখনও দুধ গ্লাসে ঢেলে খাওয়াও। তালশাঁসটা ছুলে দাও।
তোমার চুলে পাক ধরছে বাবা। আমার খুব ভয় করে। তুমি বুড়ো হয়ে গেলে এত মানুষের থেকে আমায় আগলে রাখবে কে! আমায় তো তুমি ছাড়া আর কেউ বুঝল না বাবা। আমায় কেউ বিশ্বাস করল না। শুধু তুমি করলে। আমি কি কোনো দিনও তোমার গর্ব হব না বাবা?