নাজমুল করিম ফারুক
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৪ ০৯:৫৪ এএম
আপডেট : ২৭ মে ২০২৪ ০৯:৫৪ এএম
সোনাকান্দা জল দুর্গ, নারায়ণগঞ্জ। ছবি : লেখক
সোনাকান্দা দুর্গ মুঘল আমলে নির্মিত একটি জল দুর্গ। এটি ১৬৫০ সালের দিকে তৎকালীন বাংলার সুবাদার মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এটি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। সপ্তদশ শতকে ঢাকা শহরকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে যে তিনটি জল দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল সোনাকান্দা দুর্গ তার মধ্যে অন্যতম।
১৫৫৭ সালে মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের কাছে দাউদ খান কিররানির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আসে। মুঘলরা বাংলায় একটি প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে দৃঢ় নীতি গ্রহণ করেছিল। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলাকে তৎকালীন বাংলা প্রদেশের সুবাদার বা গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি জলদস্যু দ্বারা বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে লুটতরাজ চালানোর ব্যাপারে অবগত ছিলেন। জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকাকে রক্ষা করতে তিনি ঢাকার আশপাশে তিনটি জল দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গ তার মধ্যে একটি। বাকি দুটি হলো হাজীগঞ্জ দুর্গ ও ইদ্রাকপুর কেল্লা।
সোনাকান্দা দুর্গ নির্মাণের তারিখসংবলিত কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, এটি ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। দুর্গটিতে রয়েছে ইস্টক নির্মিত পুরু দেয়াল, একটি বিশাল কামান প্ল্যাটফর্ম এবং উত্তরমুখী একটি প্রবেশ তোরণ। দুর্গটিতে মূলত দুটি প্রধান অংশ লক্ষ করা যায়। এক. আত্মরক্ষামূলক প্রাচীর যার মধ্যে গোলা নিক্ষেপের জন্য বহুসংখ্যক প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে; যা থেকে বন্দুক এবং হালকা কামান ব্যবহার করে জলদস্যুদের দিকে শেল নিক্ষেপ করা যেত। অপরটি হচ্ছে পশ্চিম দিকের উঁচু মঞ্চ, যা দুর্গকে জলদস্যুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হচ্ছে দুর্গের বিশাল কামান প্ল্যাটফর্ম। গোলাকার কামান প্ল্যাটফর্মের একটি সিঁড়ি রয়েছে, কামান প্ল্যাটফর্মের উঁচু মঞ্চে শক্তিশালী কামান নদীপথে আক্রমণকারীদের দিকে তাক করা থাকত। এটি মুঘলদের জল দুর্গের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখানে অষ্টভুজাকৃতির চারটি বুরুজ দুর্গের চার কোণে রয়েছে। দুর্গের একমাত্র প্রবেশ তোরণটি উত্তর দিকে। প্রবেশদ্বারটি একটি আয়তকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। এই দুর্গ নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কারও মতে, মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের কন্যার নাম ছিল স্বর্ণময়ী। এক দিন স্বর্ণময়ী তার বান্ধবীদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করতে গেলে জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হন। জলদস্যুরা তাকে বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাট এলাকার দিকে নিয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংবাদ ঈসা খাঁর কাছে পৌঁছে। তাই তিনি ঘোড়া নিয়ে সৈনিকদের সঙ্গে অভিযান চালিয়ে সদরঘাট এলাকায় দস্যুদের পরাস্ত এবং স্বর্ণময়ীকে উদ্ধার করে সোনাকান্দা দুর্গে নিয়ে আসেন। তারপর জমিদার কেদার রায়কে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে খবর পাঠায়। খবর শুনে কেদার রায় আসেন, কিন্তু মুসলিম ঘরে রাত কাটানোর কারণে হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহণ করবে না- এই ভয়ে তিনি মেয়েকে না নিয়ে চলে যান। এদিকে ঈসা খাঁ পড়লেন বিপদে। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তিনি স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের পর স্বর্ণময়ীর নাম বদল করে রাখা হয় সোনাবিবি।
জানা যায়, ঈসা খাঁ সোনাবিবিকে খুবই ভালোবাসতেন। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এই দুর্গের নাম রাখেন সোনাকান্দা। অনেকে বিশ্বাস করেন, দুর্গটিতে একটি সুড়ঙ্গপথ আছে, যার সঙ্গে ঢাকার লালবাগ কেল্লা এবং সোনারগাঁ দুর্গের সংযোগ ছিল। বর্তমানে সোনাকান্দা দুর্গ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে নারায়ণগঞ্জ শহরের ২নং লঞ্চঘাট থেকে নৌকা পার হয়ে বন্দর উপজেলার ঘাটে নেমে রিকশায় সোনাকান্দা দুর্গে যাওয়া যাবে।