মো.আমান উল্লাহ, বাকৃবি
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৫ পিএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৫ পিএম
বাকৃবির উদ্ভাবন ‘বাউ সরিষা-৯’ ২৫ শতাংশ বেশি ফলন দেবে। প্রবা ফটো
উৎপাদনকাল ৭৮ থেকে ৮২ দিন। বীজে তেলের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ; যা দেশে প্রচলিত সরিষার সাধারণ জাতের চেয়ে প্রায় ৭ থেকে ১২ শতাংশ বেশি। জাতটির ফলনও অধিক। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ২ টন; যা প্রচলিত অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি সরিষার জাত থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি।
স্বল্পমেয়াদি, উচ্চ ফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী এবং লবণসহিষ্ণু নতুন এ জাতের উদ্ভাবক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। গবেষক দলটি সরিষার উদ্ভাবিত জাতটির নাম দিয়েছে ‘বাউ সরিষা-৯’। সেটি এ বছরের ৩১ মার্চ জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে নিবন্ধন পেয়েছে।
উদ্ভাবিত বাউ সরিষা-৯ ছাড়করণ উপলক্ষে গতকাল বুধবার বাকৃবির কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে গবেষকের অফিসকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে সরিষার নতুন এই জাতের নানা দিক তুলে ধরেন জাতটির উদ্ভাবক ও প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. আরিফ হাসান খান রবিন। গবেষণা সহযোগী হিসেবে ছিলেন ওই বিভাগের একাধিক স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক আরিফ হাসান জানান, বাউ সরিষা-৯ জাতের উৎপাদনকাল ৭৮ থেকে ৮২ দিন। এই সরিষার বীজে তেলের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ; যেখানে দেশে প্রচলিত সরিষার সাধারণ জাতে থাকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। উদ্ভাবিত জাতটির আড়াই কেজি সরিষা থেকে ১ লিটার তেল পাওয়া যাবে। হেক্টরপ্রতি ফলন প্রায় ২ টন; যা প্রচলিত অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি সরিষার জাত থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি।
তিনি বলেন, ‘বাউ সরিষা-৯ চাষের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে অল্টারনারিয়া ব্লাইট (সরিষার সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ), পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ খুবই কম। জাতটি পরিমিতরূপে বন্যা ও লবণসহিষ্ণু হওয়ায় উৎপাদন প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি।’
অধ্যাপক আরিফ হাসান জানান, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর এবং বাকৃবির কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজননের গবেষণা মাঠসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় জাতটির পরীক্ষামূলক চাষ করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া গেছে।
এর গুণাগুণ তুলে ধরে এই গবেষক বলেন, ‘উদ্ভাবিত নতুন এ জাতে অলিক এসিডের পরিমাণ ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ, ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের অনুপাত ২৫:১, যা সয়াবিন তেলে ১৮:১। বাউ সরিষা-৯ থেকে প্রাপ্ত তেলের স্মোক পয়েন্ট ২৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড; যা সয়াবিন তেলের তুলনায় প্রায় ১৪ ডিগ্রি বেশি। সরিষার তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনোলেট বিশ্লেষিত হয়ে আইসো থায়োসায়ানাইট তৈরি হয়, যা ক্যানসার প্রতিরোধী। ফলে ভোজ্য তেল হিসেবে বাউ সরিষা-৯ সরিষার তেল সয়াবিন তেলের তুলনায় অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।’
জাতটি চাষ করে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন এর উদ্ভাবক। বলেন, ‘দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়। উৎপাদিত সরিষার তেলের বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই উৎপাদন দিয়ে দেশের মোট ভোজ্য তেলের চাহিদার মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। এ কারণে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকার সরিষা, সয়াবিন এবং পাম তেল আমদানি করতে হয়। দেশীয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ৪০ শতাংশ ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।’
‘এমতাবস্থায় বাউ সরিষা-৯ জাতটি চাষে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। প্রচলিত অন্যান্য সরিষার জাতের তুলনায় বাউ সরিষা-৯ চাষে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৪ হাজার টাকা বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। সে হিসাবে বছরে ২৪ বিলিয়ন টাকার সরিষার বাজার তৈরি করা সম্ভব,’ যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক আরিফ হাসান বলেন, ‘পাশাপাশি জাতটি স্বল্পমেয়াদি হওয়ায় আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে এটি চাষ করা যাবে। ফলে একই জমিতে বছরে চারটি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা ফসলের নিবিড়তাও বৃদ্ধি করবে।’
উদ্ভাবিত জাত সম্পর্কে এই গবেষক বলেন, ‘বাউ সরিষা-৯ ব্রাসিকা ন্যাপুস প্রজাতির, যাদের জীবনকাল গড়ে ৮০ দিন। কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সংরক্ষিত ২৫০টিরও অধিক জেনোটাইপের মধ্য থেকে স্বল্প জীবনকালীন পাঁচটি জেনোটাইপ প্রজাতিভেদে বাছাই করা হয়। পরে জেনোটাইপগুলোর ডায়ালাল মেটিং পদ্ধতিতে উচ্চতর গবেষণা করে বাউ সরিষা-৯ স্বল্পজীবনকালীন প্রজাতিটির উদ্ভাবন করা হয়।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) তিনটি প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সাল থেকে সাত বছর যাবৎ এই জাতটি উদ্ভাবনের গবেষণা করা হয়েছে। প্রকল্প তিনটি হলোÑ জার্মপ্লাজম অ্যানহান্সমেন্ট অ্যান্ড জেনেটিক পিউরিটি ফর বায়োটিক স্ট্রেস রেজিজটেন্স অ্যান্ড শর্ট ডিউরেশন ইন রাপসিড অ্যান্ড মাসটার্ড, ডায়ালাল মেটিং ইন ওয়েল সিড ব্রাসিকা জেনোটাইপস টু সিলেক্ট ফর শর্ট ডিউরেশন অ্যান্ড এবায়োটিক স্ট্রেস টলারেন্স লাইনস ফ্রম এফ-২ পপুলেশন এবং সিলেকশন ফর শর্ট ডিউরেশন, অল্টারনারিয়া ব্লাইট অ্যান্ড স্যালিনিটি স্ট্রেস টলারেন্স ইন দ্য অ্যাডভান্সড ব্রিডিং লাইনস অব রাপসিড অ্যান্ড মাস্টার্ড।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রগুলো স্বনামধন্য ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বিশিষ্ট জানার্লে প্রকাশিত হয়েছে এবং বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্যে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বর্তমানে জাতটির অধিকতর উৎকর্ষ সাধনে উচ্চতর গবেষণা চলমান রয়েছে এবং আরও কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।