× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গো-চারণভূমি সংকটে গোয়াল খালি কৃষকের

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫৮ এএম

আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪ ১০:৩০ এএম

গো-চারণভূমি সংকটে গোয়াল খালি কৃষকের

গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ- আবহমান বাংলার এই রূপচিত্র এককালে ছিল সমৃদ্ধির প্রতীক। প্রতিটা গ্রামে প্রায় সব কৃষি পরিবার গরু পালন করত। গ্রামীণ সমৃদ্ধির জানান দিত গোয়াল আর পুকুর- আক্ষরিক অর্থেই। এখন আর কোনো গ্রামেই গোয়াল বা পুকুর সমৃদ্ধির প্রতীক নয়। যদিও গরু ও মাছ দুটিরই উৎপাদন বেড়েছে দেশে, খামার চাষের মাধ্যমে। ছোট-বড় নানা রকম খামারে এখন গরু পালন বা মাছ চাষ করা হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশে।

ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র কৃষক মামুনুর রশিদের কথায়, তিনি দুটি গাভি ও দুটি বকনাসহ ছয়টি গরুর মালিক। অল্প কিছু চাষের জমি আছে তার। এখান থেকে তিনি যে খড় পান তা দিয়ে চলে না। বছরে তাকে অন্তত ১০ হাজার টাকার খড় কিনতে হয়। মামুন বলেন, আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধান কাটার পর জমি কিছুদিন পতিত থাকে। তখন সেখানে গরু চরান। যদিও তাতে গরুর পেট ভরে না। বাকি সারা বছর তিনি তার গরুগুলো বাড়ির পাশে শুকনো জায়গায় বেঁধে রাখেন, যেখানে তারা প্রায় কিছুই খেতে পায় না। তাদের একমাত্র ভরসা প্রক্রিয়াজাত খাবার, যা ব্যয়বহুল।

মামুন বলেন, প্রায় সব জমিই চাষের আওতায় এসে পড়েছে। বিল-ঝিলগুলোয় মাছ চাষ করতে পুকুর করে ফেলা হয়েছে। আগের মতো ঘাসও মেলে না আর। এমন অবস্থায় গরু পালন করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। অনেকেই আগ্রহ হারিয়েছে। কৃষকদের তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ কৃষকই বাড়তি কিছু সুবিধার জন্য গরু পালন করেন, যা মূলত এক ধরনের সঞ্চয়। ব্যয়ের খাতগুলো বাণিজ্যিকভাবে হিসাব করলে যা দাঁড়ায় সেই তুলনায় আয় প্রায় সমান। বরং পরিবারের সদস্যদের শ্রমের ব্যয় ধরলে তা মোট আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায়! এসব কারণে দিন দিন কৃষকের গোয়ালের গরু নেই হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সফরকালে দেখা যায়, যমুনার চরে গরু চরাচ্ছেন কয়েকজন রাখাল। তাদের মধ্যে রমজান আলী একজন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সরকার তার জমি এবং তার মতো অসংখ্য কৃষকের জমি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের জন্য অধিগ্রহণ করেছে। ফলে এ এলাকায় আর মাঠে চরানোর মতো জমি নেই। তাই তারা যমুনার চরে গরু চরান। শুকনো মৌসুমে কয়েক মাস এখানে গরু চরানো যায় বলে তিনি জানান। ওই এলাকার নুরে আলম নামে আরেকজন রাখাল বললেন, ‘খাসজমি দখল, বিল লিজ নিয়ে মাছ চাষসহ নানা কারণে চারণভূমি সংকট দেখা দিয়েছে।’ বস্তুত শুধু ময়মনসিংহ নয়, সারা দেশেই গো-চারণভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে আবহমান বাংলার ঘরে ঘরে গরু পালনের যে প্রচলন ছিল তা তো আজ আর নে-ই, বাড়িতে গরু পালন করা নিয়ে খুশিও না কোনো কৃষক।

বাণিজ্যিক খামারের সংখ্যা কেমন বেড়েছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায় বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্যে। তাদের তথ্য মতে, পাঁচটির বেশি গরু আছে দেশে এমন খামার ১০ লাখের বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসব খামারে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৮ লাখের বেশি। এসব খামারের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। এবং বিডিএফএর নিবন্ধিত সদস্য ৯ হাজারের কাছাকাছি।

একটি গাভির কী পরিমাণ খাদ্য প্রয়োজন 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অ্যানিমেল নিউট্রিশন সেকশনের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার একেএম বাহারুল ইসলাম তালুকদার জানান, ২০০ কেজি ওজনের একটি গাভির দৈনিক দরকার সবুজ ঘাস ছয় কেজি, খড় দুই কেজি এবং কিছু দানাদার খাবার দুই থেকে তিন কেজি। দানাদার খাদ্য হিসেবে গমের ভুসি, চালের কুঁড়া ও সয়াবিন মিল মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। লবণ দিতে হবে ৬০ থেকে ৮০ গ্রাম। সর্বাধিক তিন কেজি দুধ দেয় এমন গাভির এই পরিমাণ খাবারের চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে যেসব গরু পালন করা হয় তাদের বেশিরভাগকেই কোনো ধরনের হিসাব করে খাবার দেওয়া হয় না। কিন্তু এই হিসাব গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষকের গোয়ালে গরু ফেরাতে দরকার মুক্ত চারণভূমি

প্রক্রিয়াজাত খাবারের খরচ বেশি। এতে গরুর দামও বেশি হয়। কিন্তু সেই তুলনায় বাজারে বেশি দাম পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পলিসি নির্ধারণের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএইউ) অ্যানিমেল নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক ড. আবু সাদেক মো. সেলিম বলেন, গো-চারণভূমির অভাবে সারা দেশেই সাধারণভাবে গরু পালন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, গরু শুধুই গোয়ালে রাখলে হবে না। তাকে মাঠে চরানোর মতো জায়গা দিতে হবে।

কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে একদিকে যেমন আবাসস্থল ও কলকারখানা বাবদ জমির ব্যবহার বেড়েছে তেমনি খাদ্যের প্রয়োজনে অনাবাদি জমি ও সরকারি জমি চাষের আওতায় এসেছে। ফলে মামুনদের মতো চাষিদের জন্য গরু পালন কঠিন হয়ে পড়েছে।

চারণভূমি সৃষ্টির উদ্যোগ কত দূর

দেশের প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় এক বা একাধিক সমবায়ভিত্তিক চারণভূমি সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ২০১১ সালে ‘সমবায় গো-চারণভূমি নীতিমালা’র নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। নীতিমালায় বলা হয়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বেদখল হওয়া প্রায় ৪০০ একর গো-চারণভূমি উদ্ধার করা হবে। সেই সঙ্গে সমুদ্র বা নদীতে জেগে ওঠা চরাঞ্চল, দেশের প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় সরকারি জমিতে সরকারি অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণ করে গো-চারণভূমি সৃষ্টি করা হবে। এসব গো-চারণভূমি হবে প্রতিটি ২০০ থেকে ৪০০ একরজুড়ে।

নীতিমালায় জেলা প্রশাসন, সমবায় অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মিল্কভিটার প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে সমবায় গো-চারণভূমি সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে হাওর ও চরাঞ্চলে হাওর উন্নয়ন বোর্ড এবং চর উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিও এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। কিন্তু নীতিমালা হওয়ার ১২ বছর অতিবাহিত হলেও এ নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। দেশে কী পরিমাণ চারণভূমি আছে এ সম্পর্কে কোনো তথ্যও নেই সরকারের হাতে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ড. হোসেন মো. সেলিম বলেন, ‘চারণভূমির পরিমাণ নিয়ে সঠিক হিসাব এখন পর্যন্ত নেই। সারা দেশে একটি জরিপ কার্যক্রম চলছে। যার ফল আগামী বছর পাওয়া যাবে।’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

জমি বা চারণভূমি বাড়ানো যাচ্ছে না, জনসংখ্যা বৃদ্ধি লাগামহীন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর- এ অবস্থায় কৃষকের গোয়ালে গরু নিরাপদ হবে কীভাবে? বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু চুলচেরা হিসাব কষেছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার ফিনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. রইস উদ্দীন মিঞা বলছেন, আগে কৃষি ছিল জীবনধারণের জন্য। অর্থাৎ চাষাবাদ করে পারিবারিক প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্তটুকু বিক্রি করা হতো। বর্তমানে তার উল্টো। বর্তমানে বাণিজ্যের জন্য চাষাবাদ করা হয় এবং সেখানে বিক্রি করার পর পারিবারিক প্রয়োজন মেটানো হয়। তা ছাড়া এখন চারণভূমি মূলত চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগের দিনে গরু মাঠে ছেড়ে দিয়ে বা বেঁধে রেখে আসত চাষিরা, সন্ধ্যায় গিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসত। এখন তা হচ্ছে না। এটি পুরোপুরি গোয়ালে রেখে খাবার দিতে হচ্ছে চারণভূমির অভাবে। ফলে গো-পালন ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। এখন সুফল পেতে হলে প্রয়োজন উন্নত জাতের গরু পালন।

ড. রইস বলেন, লাইভস্টক সেক্টরে কত খরচ হচ্ছে, কত দাম পেলে তাদের পোষাবে তা নিয়ে গবেষণা দরকার। এ খাতে সুদহার কমিয়ে, বিদ্যুৎ, ফিড ও ওষুধপথ্যের দাম কমিয়ে সরকার সহায়তা করতে পারে। সাভার, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও গাজীপুরে বিশাল অংশ লাইভস্টকের জোন। এখানে কিছু ঋণ চালু করে দিতে হবে এবং সেগুলো ফেরত আনার ব্যাপারে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।

ড. রইস আরও বলেন, আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে বিসিক, অর্থনৈতিক জোন, ইপিজেড আছে। তেমনি লাইভস্টকের জন্য জোন করতে হবে। কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় খাস জমিতে ঘাস চাষ করতেই হবে। বিশ্বের অনেক দেশই এসব কাজ করেছে। গরুর খাবারের অন্যতম উপাদান খড়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় সব স্থানেই ধান চাষ হয়। ধানের খড় গরুর অন্যতম খাবার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক ড. আবু সাদেক মো. সেলিম বলেন, ‘গ্রামে ও অন্যান্য স্থানে সরকারি রাস্তার পাশে ও খাসজমিতে সম্মিলিতভাবে উন্নত জাতের ঘাস চাষ করতে হবে। এজন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে কয়েকজন কৃষক সম্মিলিতভাবে ঘাস রোপণ করে দেখাশোনা করবে। তা ছাড়া আমাদের জমিগুলোর যেসব আইল রয়েছে সেখানেও ঘাস চাষ করতে হবে। তা না হলে গো-পালন করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগে যেভাবে গরু পালন করতাম তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা নিয়ে গরু পালন করতে হবে। আধা লিটার বা এক-দুই লিটার দুধের জন্য গরু পালন না করে বরং উন্নত জাতের গরু পালন করতে হবে। এতে খরচটা পোষাবে।’ তিনি মণকে মণ দুধ দেয় এমন গরু পালনের পরামর্শ দেন।

সঠিক খড় ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের খড় যদি সঠিকভাবে সংগ্রহ করা হতো তাহলে গো-খাদ্যের অনেকটা সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আর এসব খড় জমিতে পচাতে পারলেও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত, কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে করা হয় না। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে খড় যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয় না। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে সিলেট ও কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে এসব খড় খুব কম সংগ্রহ করা হয়। বেশিরভাগ কৃষক শুধু ধান কেটে নিয়ে আসতে পারলেই খুশি হয়।’ এজন্য চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা