মো. আমান উল্লাহ, বাকৃবি
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪ ১০:০৮ এএম
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪ ১৫:৪৩ পিএম
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবন করা স্বয়ংক্রিয় আলু বাছাইকরণ যন্ত্র। প্রবা ফটো
কয়েক বছর ধরে দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে আলু উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ভাবন করেছেন স্বয়ংক্রিয় আলু বাছাইয়ের যন্ত্র (অটোমেটেড পটেটো গ্রেডিং মেশিন)। তাদের উদ্ভাবিত এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি আলুর আকার, রঙ ও ত্রুটি নির্ণয় করে বাছাই করতে পারবে। এতে আলুর সংরক্ষণ-পরবর্তী ক্ষতি অনেকটাই কমে যাবে।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ‘মেশিন ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলুর জন্য স্বয়ংক্রিয় গ্রেডিং পদ্ধতি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যন্ত্রটির গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা অর্থায়ন করেছে বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস)। যন্ত্রটির অধিকতর উন্নয়নের জন্য গবেষক দল কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। গবেষণাপত্রটি সায়েন্টিফিক জার্নাল ‘স্মার্ট এগ্রিকালচার টেকনোলজি’তে জমা দেওয়া হয়েছে এবং তা প্রাথমিকভাবে প্রকাশনার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন, যথাযথ প্রযুক্তির অভাবে দেশের কৃষকরা হাত ও চোখের আন্দাজেই আলু গ্রেডিং ও সংগ্রহ করেন। এতে আলু সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা নিয়ে বিপাকে পড়েন তারা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টনের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে আলু উৎপাদন হয় ১১ মিলিয়ন টনেরও বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে পণ্যটির সংকট দেখা দেয় এবং বাজারে দাম বেড়ে যায়। যথাযথ গ্রেডিং ও সংরক্ষণের অভাবেই অতিরিক্ত আলু নষ্ট হয়, যা প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সমমূল্যের। সঠিকভাবে আলু সংরক্ষণ করা গেলে অতিরিক্ত উৎপাদিত ৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন টন আলু রপ্তানি করা যেত। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই শুরু হয় যন্ত্রটি উদ্ভাবনের কাজ।
তিনি আরও বলেন, মাঠ থেকে আলু তোলার পর সংরক্ষণের জন্য আকার, রঙ ও ত্রুটি অনুযায়ী বাছাই (গ্রেডিং) করা অন্যতম প্রধান কাজ। খালি চোখে বা কোনো ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সেটি গ্রেডিং করা হলে নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া খালি চোখে আলুর আকার ও রোগ ভালোভাবে ধরা যায় না। এতে রোগাক্রান্ত আলু থেকে যায় এবং সংরক্ষিত আলু নষ্ট করে ফেলে। উদ্ভাবিত গ্রেডিং যন্ত্রটি এ সমস্যা দূর করবে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি সরবরাহকৃত প্রতিটি আলুর ছবি নেবে এবং তা প্রক্রিয়াকরণ করবে। এরপর যন্ত্রটি আলুর রঙ, আকার ও রোগাক্রান্ত অংশ শনাক্তকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে কোন আলু কোন গ্রেডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে অনুযায়ী মোটরের মাধ্যমে আলু বাছাই করবে যন্ত্রটি। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের আলু বাছাইয়ে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির সফলতার হার ৮৬ শতাংশ। প্রতি ঘণ্টায় এটি ৩০-৩৫ কেজি আলু গ্রেডিং করতে পারে। যন্ত্রটির অধিকতর উন্নয়ন হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় আরও বেশি পরিমাণে আলু গ্রেডিং করা এবং তার সফলতার হার আরও কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি করা নিয়ে কাজ করছি।
যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে গবেষণাকাজে নিযুক্ত একই বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটিতে রয়েছে মোটরচালিত ৭ ফুট দীর্ঘ ও ১ দশমিক ৫ ফুট প্রস্থের কনভেয়ার বেল্ট (আলু পরিবহনের জন্য), ছবি তোলা ও বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা, এলইডি লাইটিং সিস্টেম এবং প্রতিটি গ্রেডের আলুকে সুনির্ধারিত স্থানে রাখতে সার্ভো মোটর ও মাইক্রোকন্ট্রোলারের সমন্বয়ে নিক্ষেপণ পদ্ধতি। যন্ত্রটিতে ছবি বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাটল্যাব প্রোগ্রাম, যা খুব সহজ ও দ্রুত আকার নির্ধারণ এবং পূর্বনির্ধারিত আলুর আকারের সঙ্গে তুলনা করে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন আকারের আলু বাছাই করতে পারে। কম্পিউটার প্রযুক্তনির্ভর হওয়ায় হাতে গ্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিগোচর না হওয়া সব ত্রুটিও ধরা পড়বে যন্ত্রটিতে। ফলে যথাযথভাবে কম সময় ও পরিশ্রমে আলু সংরক্ষণ সম্ভব হবে। ফলে উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রার্জনে সফল হবেন কৃষকরা।