ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০২ পিএম
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০৬ পিএম
ফাইল ফটো
ইউরোপে কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। প্যাকিং শ্রমিকের অভাব, কুলিং চেম্বারের অভাব, কার্গোতে অতিরিক্ত ভাড়াসহ নানা কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি খাত।
রপ্তানিকারকরা জানান, ইউরোপে কৃষিপণ্যের বাজার পেতে হলে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হয়। দেশে একটি প্যাকিং হাউস করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই নেই। রাজধানীর শ্যামবাজারের একটি বেসরকারি হিমাগার থেকে পণ্যগুলো হিমায়িত করেন তারা। কিন্তু প্রায়ই শেষ পর্যন্ত মান রক্ষা করতে পারেন না বলে জানান আরআর এন্টারপ্রাইজ নামে একটি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার রাজিব দে।
এনএইচবি করপোরেশন নামে আরেকটি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাজমুল হায়দার ভূঁইয়া বুলবুল বলেন, বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিমানগুলো বেশি ভাড়া নেয়। কলকাতা থেকে পণ্য পাঠাতে যেখানে ৩০-৩৫ টাকা খরচ হয়, সেখানে ঢাকা থেকে পাঠাতে খরচ হয় ১০০ টাকা।
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, বাংলাদেশ বিমানের কার্গোতে স্থানস্বল্পতার কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাঠাতে পারেন না। আগে জায়গা কম থাকায় লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ পেয়ে রপ্তানি করা হতো। ইদানীং কাঁচা কৃষিপণ্যের জায়গা কমিয়ে তৈরি পোশাককে বেশি স্থান দিচ্ছে। এজেন্টদের মাধ্যমে বুকিং সিস্টেম চালু করেছে। এতে কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এভাবে রপ্তানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে পিছিয়ে পড়ছেন।
২০২২ সালের মে মাসে ‘কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির রোডম্যাপ’ নামে একটি পরিকল্পনা হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনটিতে কৃষিপণ্যের বিমানে স্পেস না পাওয়া সম্পর্কে অধিক ভাড়াকে দায়ী করে বলা হয়, প্রতিটি বিমানে কৃষিপণ্যের জন্য ২০-২৫ শতাংশ স্পেস রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিমানের কার্গো শাখার জেনারেল ম্যানেজার রাশেদুল করিম জানান, বাংলাদেশ বিমান শুধু লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে যাতায়াত করে থাকে। এখানে কার্গো বহনের পরিমাণও কম। লন্ডনে একটি ফ্লাইটে ১২-১৪ মেট্রিক টন ও ম্যানচেস্টারে ৯ টনের মতো পণ্য পাঠানো সম্ভব হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে তাদের কার্গো নেই। এসব দেশে অন্যান্য এয়ারলাইনস যাতায়াত করে থাকে। তা ছাড়া কৃষিপণ্যের চেয়ে অন্যান্য খাতের পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া এবং একটি সিন্ডিকেটের কাছ থেকে জায়গা কিনতে হয়Ñ এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ চান রাশেদুল করিম।
প্রশিক্ষিত প্যাকিং শ্রমিকের সংকট
কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানটিতে নিজস্ব কোনো শ্রমিক নেই। সেখানে কর্মরত সব শ্রমিকই রপ্তানিকারকদের। তাদের দেওয়া হয়নি কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ। সরেজমিন কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস পরিদর্শন করে দেখা যায়, এখানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লোকজন ইউরোপে পণ্য পাঠানোর জন্য প্যাক করছেন। তারা জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে করতে শিখেছেন। প্রশিক্ষণ পেলে ভালো কাজ করতে পারবেন বলে তারা মনে করেন।
ল্যাবের কাজ কত দূর
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাইসে স্থাপিত ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্পের পরিচালক ড. শামীম আহমেদ জানান, রপ্তানিযোগ্য পণ্যগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ১০টি ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। কাজ শেষ হলে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানেই করা যাবে। তখন ইউরোপের সুপার শপগুলোতে পণ্য পাঠানো যাবে। এখন সেখানকার প্রবাসীরা বা কিছুটা নিম্নআয়ের মানুষ কৃষিপণ্যগুলো কিনছে। এসব ল্যাবের সার্টিফিকেট দেওয়া গেলে বাংলাদেশ ইউরোপের মূল বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। তিনি বলেন, ল্যাবের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ হয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার টেন্ডার দেওয়া হবে।
কুলিং চেম্বারসহ প্যাকিং হাউসের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার গত ২৫ মে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেসব সমস্যার মধ্যে কিছু সমাধান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসের উপপরিচালক এসএম খালিদ সাইফুল্লাহ। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অর্থ বরাদ্দ পেলে টেন্ডার দেওয়া হবে। তা ছাড়া অন্যান্য কিছু সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দ্বিতীয় একটি বিদ্যুৎলাইননের সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি ১ হাজার ১৫৫ টন বেড়েছে। এক দিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ পণ্য পাঠানো হয়েছে ১৩০ টন। আর গত বছরের চেয়ে ১৩ লাখ টাকা বেশি আয় করা হয়েছে। এতে নতুন রপ্তানিকারক যুক্ত হয়েছেন ২০ জন। প্যাকিং হাউসের সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে রপ্তানি হু হু করে বাড়বে।
কৃষিপণ্য রপ্তানির ব্যাপারে ওয়াহিদা আক্তার বলেন, কুলিং চেম্বার চালু করতে যা করা দরকার, দ্রুত করতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রবাসীরা বাস করেন। তারা দেশীয় শাকসবজি ও তরকারি পছন্দ করেন। এসব কৃষিপণ্য পেলে তারা খুবই খুশি হন।
যেভাবে ইউরোপে যাত্রা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চাহিদার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে সরকার রাজধানীর শ্যামপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিজস্ব জায়গায় কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউস নির্মাণ করে। ২০১৭ সালের ১৬ মে ইউরোপে আম রপ্তানির মাধ্যমে ল্যাবের আংশিক কার্যক্রম চালু হয়। ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১৫৬ কোটি ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ১০টি ল্যাব স্থাপনে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
কর্মচারীদের দুঃখবোধ
কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসের প্রত্যেক কর্মকর্তাকে ২৪ ঘণ্টা করে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এখানে মাত্র ১৩ জন স্থায়ী ও কিছু সংযুক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। নেই কোনো বিশ্রামাগার। ফলে কোনো কর্মকর্তাই বেশি দিন এখানে কাজ করতে চান না। পণ্যের গুণগতমান না থাকলেও ছাড়পত্র দিতে অস্ত্রের মুখে বাধ্য করা হয়। প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সশস্ত্র জনবল নিয়োগের আবেদন তাদের।